Print Date & Time : 5 August 2025 Tuesday 2:31 am

বাম রাজনীতি মানেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম?

নুসরাত রুষা : গত শতকের নব্বইয়ের দশক বা তার আগের সময়ে ছাত্রসমাজে বাম রাজনীতির একরকম মোহ ছিল। কর্নেল তাহেরের মতো মানুষ বা বিপ্লবী নেতাদের প্রতি আকর্ষণ, শ্রদ্ধা কিংবা একধরনের অনুপ্রেরণা কাজ করত। সেই সময়কার তরুণরা মনে করত, রাজনীতি মানেই আদর্শ আর বাম রাজনীতি মানেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম। ভাষা আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ—এসব আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বামপন্থিরা একটা অবস্থান তৈরি করতে পেরেছিল। কিন্তু আজকের দিনে সেই আকর্ষণ আর আগ্রহ খুঁজে পাওয়া যায় না। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গেলে টের পাওয়া যায় তরুণদের এক বিরাট অংশ বাম রাজনীতিকে অবহেলার চোখে দেখে। তারা রাজনীতিতে যুক্ত থাকলেও সেটা হয় মূলত ক্যারিয়ার, পরিচিতি, সুবিধা কিংবা ক্ষমতার প্রশ্নে। আদর্শভিত্তিক রাজনীতি তাদের মধ্যে ক্রমেই দুর্লভ হয়ে উঠেছে।

আজকের তরুণরা যখন বাম রাজনীতির দিকে তাকায়, তখন প্রথমেই তারা একটা বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে যায়—এত দল, এত মত, এত মতভেদ! কেউ মার্ক্সবাদী, কেউ বিপ্লবী, কেউ ইউনাইটেড। কার সঙ্গে যাবে, কারটা বিশ্বাস করবে—সেটাই বোঝা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এক আদর্শের মধ্যেই এত বিচ্ছিন্নতা থাকলে সেখানে নতুন কেউ আসবে কীভাবে? যারা সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছে, তাদের অনেকেই এগুলোকে দেখে হাস্যকর মনে করে, কারণ এখানে ঐক্যের বদলে বিভাজনই বেশি। একসঙ্গে মিছিল করে, পরে নিজেদের মধ্যে তর্কে লিপ্ত হয়; কে আসল বিপ্লবী আর কে না, সেটা নিয়েই কাটাকাটি চলে। এমন বিভক্ত ও আত্মকেন্দ্রিক রাজনীতি তরুণদের আকর্ষণ করতে পারে না।

এছাড়া তরুণদের মধ্যে একটা ভয় কাজ করে—সামাজিকভাবে ট্যাগ খাওয়ার ভয়। কেউ যদি বাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়, তাহলে চারপাশ থেকে নানা মন্তব্য আসতে শুরু করে—‘ওরা তো গোসল করে না’, ‘ওরা তো শুধু সিগারেট খায়’, ‘ওরা ধর্ম মানে না’,  ‘ওরা ফ্রি মিক্সিং করে’ প্রভৃতি। এমন বহু নেতিবাচক ধারণা সমাজে প্রচলিত। ফলে যারা একটু ভিন্ন পরিবেশ থেকে এসেছে, যারা ধর্ম মানে, পরিবারে রক্ষণশীলতা আছে, তারা এসব মন্তব্যের শিকার হতে চায় না। তার ওপর নারীরা যদি বাম রাজনীতিতে যুক্ত হয়, তাহলে তাদের নিয়ে আরও বাজে কথা হয়; যেমন ‘মিছিলে গেলে মেয়েরা ছেলেদের সঙ্গে মেশে’—এসব গুজব বা কুসংস্কার তরুণদের সাহসী করে না, বরং পিছিয়ে দেয়। ফলে রাজনীতিতে যোগদানের আগ্রহ থাকলেও অনেকে চুপচাপ সরে দাঁড়ায়।

তরুণদের অনাগ্রহের আরেকটি বড় কারণ হলো, বর্তমান বাম দলগুলোর সাংগঠনিক দুর্বলতা। অনেক দলই এখনো পুরোনো কাঠামো ধরে রেখেছে। নতুন প্রজন্মের চিন্তা, ভাষা, জীবনযাত্রা—এসবের সঙ্গে কোনো মিল নেই তাদের কথাবার্তায় বা কার্যকলাপে। কোনো নতুন মুখকে সামনে আনা হয় না, বরং বছর বছর একই নেতৃত্ব ঘুরেফিরে আসে। মিছিলে যারা স্লোগান দেয়, বক্তৃতা করে, পোস্টার লেখে, তারাই ১০ বছর পরেও নেতার আসনে বসে থাকে। এতে তরুণরা উৎসাহ হারায়। সংগঠনের মধ্যে অংশগ্রহণের সুযোগ না পেলে কেউ সেখানে থাকতে চায় না।

বাম রাজনীতি যেহেতু মূলত আদর্শনির্ভর, তাই তার ভাষাও হওয়া দরকার মানবিক, জীবন্ত ও প্রাসঙ্গিক। কিন্তু এখন অনেক সময় দেখা যায়, এই রাজনীতি একটি নির্দিষ্ট ভাষার গণ্ডিতে বন্দি, যেটা নতুন প্রজন্মের কাছে বোধগম্য নয়। মার্ক্স, লেনিন, মাও, বিপ্লব, শ্রেণি, সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদ—এই শব্দগুলো যতবার উচ্চারিত হয়, ততবারই তরুণদের একটা অংশ বিরক্ত হয়, কারণ এসব কথা বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মেলে না।

বাম রাজনীতি নিজেদের সবসময় ‘জনগণের রাজনীতি’ বলে দাবি করে এসেছে। কিন্তু আজ বাস্তবে দেখা যায়, প্রান্তিক জনগণ, যাদের হয়ে বাম রাজনীতি কথা বলে, তাদের অনেকেই জানেই না—এই রাজনীতি ঠিক কী চায়। কৃষক, শ্রমিক, ভ্যানচালক, গার্মেন্ট কর্মী, মেথর, রিকশাওয়ালা কিংবা ভূমিহীন মানুষ, যারা রাষ্ট্রব্যবস্থার সবচেয়ে নিপীড়িত অংশ, তাদের সঙ্গে বাম রাজনীতি অনেক সময়েই সংযোগ তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে।

প্রথমত, বাম সংগঠনগুলোর একটা বড় সমস্যা হলো—তারা শহরকেন্দ্রিক ও ক্যাম্পাসনির্ভর হয়ে পড়েছে। নেতারা উচ্চশিক্ষিত, শহুরে, মধ্যবিত্ত; তাদের কথা, ভাষা, জীবনধারা—সবকিছু প্রান্তিক মানুষের জীবন থেকে আলাদা। ফলে যখন একজন শ্রমিক শোনে—‘সাম্রাজ্যবাদী দমননীতির বিরুদ্ধে বিপ্লব ঘটাতে হবে,’ তখন সে সেটা নিজের জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে নিতে পারে না। তার কাছে ‘গরুর খাবার দামে’ বাজার, ‘মালিকের গালাগালি’, ‘মাইনের দেরি’—এই জিনিসগুলোই বাস্তব। আর সে বাস্তবতার ভাষায় কথা বলার লোক বাম রাজনীতিতে অনেক কম।

বাম সংগঠনগুলোর মাঠে থাকা, লড়ে যাওয়া, ঘরে ঘরে যাওয়া—এই সাংগঠনিক চর্চা অনেকটাই কমে গেছে। তারা কখনো হয়তো গার্মেন্ট শ্রমিকদের জন্য মিছিল করেছে, কখনো চা শ্রমিকদের পাশে দাঁড়িয়েছে, কিন্তু তা নিয়মিত হয়নি, আন্তরিকভাবে হয়নি। বরং অনেক সময় তাদের আন্দোলন বা কর্মসূচি হয়ে গেছে প্রতীকী শাহবাগে দাঁড়ানো, স্মারকলিপি দেয়া, ফেসবুকে বিবৃতি দেয়া প্রভৃতি। গ্রামের কৃষক এসব দেখে না, তার সঙ্গে এর কোনো যোগ নেই।

আর একটা বড় কারণ হলো ভাষা। বাম রাজনীতি এখনও এমন সব তাত্ত্বিক শব্দ ব্যবহার করে, যেগুলো সাধারণ মানুষের কাছে দুর্বোধ্য। ‘শ্রেণিসংগ্রাম’, ‘সাম্রাজ্যবাদ’, ‘পুঁজিবাদের শোষণ’, ‘নব্য উদার নৈতিকতা’—এই শব্দগুলো দিয়ে একজন খেটে খাওয়া মানুষকে বোঝানো যায় না, সে কীভাবে নিপীড়িত। তার দরকার এমন ভাষা যা সরাসরি বলে, ‘তোমার যে কাজের পরেও সংসার চলে না, সেটার কারণ কী’ বা ‘যে জমি তুমি চাষ কর, তার মালিক তুমি নও কেন?’

একটা সময় ছিল, যখন বাম রাজনীতি সত্যিই মানুষকে অক্ষর শেখাত, গান শেখাত, কবিতা পড়াত। তারা রাতের পর রাত গ্রামে কাটিয়ে কৃষকের ঘরে ঘুমাত, তর্ক করত, পাশে থাকত। এখন সেই জায়গাগুলো দখল করে নিয়েছে এনজিও, মসজিদভিত্তিক সংগঠন, বা পপুলিস্ট রাজনীতি। বামদের অনুপস্থিতিতে সেই শূন্যস্থান অন্যরা পূরণ করে ফেলেছে। ফলে প্রান্তিক মানুষ জানে না, বাম রাজনীতি আদতে কী বা কার জন্য।

সবচেয়ে কষ্টকর সত্য হলো, বাম রাজনীতি নিজেদের স্লোগানে ‘জনগণের পক্ষে’ থাকলেও বহু সময়েই তারা নিজেরা হয়ে উঠেছে ‘জনগণবিচ্ছিন্ন’। তারা মনে করে, মানুষ তাদের কথা বুঝবে, কিন্তু মানুষ তো নিজের ভাষায় কথা শোনে, নিজের অভিজ্ঞতায় রাজনীতি বোঝে। যদি সেই ভাষা ও অভিজ্ঞতার মধ্যে ঢোকা না যায়, তাহলে প্রান্তিক মানুষের কাছে পৌঁছানো অসম্ভব।

 

শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়