নিজস্ব প্রতিবেদক : দেশের বেসরকারি ব্যাংক ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন আখতারুজ্জামান বাবু। পরবর্তী সময়ে তার ছেলে সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ ইউসিবির চেয়ারম্যান হন। জাবেদের স্ত্রী রুকমিলা জামানও চেয়ারম্যান হন। জাবেদের ভাই আনিসুজ্জামান চৌধুরী জনিও ওই ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। ব্যাংক পরিচালনার দায়িত্বে থেকে এই পরিবারটি গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অনেক টাকা আত্মসাৎ করে এবং বিদেশে সেই টাকা পাচার করে বলে অভিযোগ রয়েছে। সম্প্রতি পরিবারটির দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে সরকার। তবে এরই মধ্যে তারা দেশ ছেড়েছেন বলেও জানা যাচ্ছে।
আরও জানা গেছে, দুবাইয়ে প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা অর্থ পাচারের অভিযোগে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে মামলা করেছে সিআইডি। পাচারের অর্থ দিয়ে দুবাইয়ে ২২৬টি ফ্ল্যাট কেনার পাশাপাশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান স্থাপন, ব্যবসায় বিনিয়োগ ও পরিচালনার সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার জসীম উদ্দিন খান এসব তথ্য গণমাধ্যমকে জানান।
সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী ২০১৪ সালের ১২ জানুয়ারি থেকে পর্যায়ক্রমে ভূমি মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ও মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়া তিনি ইউসিবির নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। শিল্পপ্রতিষ্ঠান আরামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির তিনবারের সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন সাইফুজ্জামান চৌধুরী।
অনুসন্ধানকালীন প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনায় দেখা যায়, সাইফুজ্জামান চৌধুরী ২০১৬ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সংযুক্ত আরব আমিরাতের আল বারশা সাউথ থার্ড, বারশা সাউথ, বারশা সাউথ ফোর্থ, থানিয়া ফোর্থ, থানিয়া ফিফথ, জাদ্দাফ, হাইবা সিক্সথ, গালফ কমার্শিয়াল, খাইরান, ইয়ালায়েস ২, বুর্জ খলিফা, জাবাল আলি, ওয়ার্ল্ড আইল্যান্ড, জাবিল সেকেন্ড, মার্শা দুবাই, মে’আইসেম দ্য ফার্স্ট, নাদ আল শেবা ফার্স্ট, ওয়াদি আল সাফা-৩ সহ বিভিন্ন স্থানে ২২৬টি ফ্ল্যাট কিনেছেন।
এসব ফ্ল্যাটের মূল্য ৩৩ কোটি ৫৬ লাখ ৫৭ হাজার ১৬৮ দিরহাম। এছাড়া তার স্ত্রী রুকমীলা জামানের নামে দুবাইয়ের আল বারশা সাউথ থার্ড এলাকায় এলাকায় ‘কিউ গার্ডেন্স বুটিক রেসিডেন্স-ব্লক বি’ নামে দুটি সম্পত্তির তথ্য পাওয়া যায়, যার মূল্য ২২ লাখ ৫০ হাজার ৩৬৯ দিরহাম।
এছাড়া সাইফুজ্জামান চৌধুরীর নামে ও তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নামে দুবাই ইসলামী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক ও ফার্স্ট আবুধাবি ব্যাংকের দুটি হিসাবসহ মোট চারটি ব্যাংক হিসাবের তথ্য পাওয়া যায়। এসব ব্যাংক হিসাবে বিভিন্ন অঙ্কের দিরহাম ও মার্কিন ডলারের লেনদেন-সংক্রান্ত তথ্য পাওয়া যায়, যা তৎকালীন সময়ের মুদ্রার বিনিময় হার অনুযায়ী বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৩১১ কোটি ২৬ লাখ ৬ হাজার ৭৯৫ টাকা।
সাইফুজ্জামান চৌধুরী ও রুকমীলা জামান এবং তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের পারস্পরিক যোগসাজশে সংযুক্ত আরব আমিরাতের (দুবাই) রাস আল খাইমাহ ইকোনোমিক জোনের অনুমতিক্রমে বিল্ডিং অ্যান্ড কন্সট্রাকশন ম্যাটারিয়াল প্রোডাক্ট ব্যবসার জন্য জেবা ট্রেডিং এফজেডই এবং কম্পিউটার সফটওয়্যার ব্যবসার জন্য র্যাপিড র্যাপটর এফজেডই নামে দুটি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান স্থাপন, বিনিয়োগ এবং পরিচালনার তথ্য পাওয়া যায়।
বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত রেকর্ডপত্র পর্যালোচনায় জানা যায়, বিদেশে কোম্পানি নিবন্ধন, বিনিয়োগ ও সম্পত্তি অর্জনের জন্য সাইফুজ্জামান চৌধুরীর অনুকূলে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো অনুমতি দেয়া হয়নি। এভাবে তিনি বিদেশে সম্পত্তি ক্রয়, কোম্পানি নিবন্ধন এবং
ব্যাংক হিসাবে অর্থ জমা করার মাধ্যমে প্রায় ১ হাজার ২০০
কোটি টাকা সংযুক্ত আরব আমিরাতে পাচার করেছেন, যা মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২ (সংশোধনী ২০১৫) মোতাবেক শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
এই অর্থপাচার-সংক্রান্ত অভিযোগটির অনুসন্ধান শেষে অভিযোগ-সংশ্লিষ্টÑ১. সাইফুজ্জামান চৌধুরী (৫৬), পিতা আখতারুজ্জামান চৌধুরী, মাতা নুর নাহার জামান এবং ২. রুকমীলা জামান (৪৬), পিতা আবদুল রাজ্জাক, মাতা সাদেকা চৌধুরী, স্বামী সাইফুজ্জামান চৌধুরী, উভয় বর্তমান সাং: ভলকার্ট হাউস, ০৭, সার্সন রোড, ডাকঘর: দামপাড়া, থানা: কোতোয়ালি, জেলা: সিএমপি, চট্টগ্রাম এবং স্থায়ী সাং- হাইলধর, ০৭নং ওয়ার্ড, থানা: আনোয়ারা, জেলা: চট্টগ্রামসহ অজ্ঞাতনামা পাঁচ-ছয়জনের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানায় সিআইডি বাদী হয়ে নিয়মিত মামলা (মামলা নং- ১০, তারিখ ০৪.০৯.২০২৫ ইং, ধারা: মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ (সংশোধিত ২০১৫)-এর ৪(২) রুজু করেছে।
অপরাধের পূর্ণাঙ্গ তথ্য উদ্ঘাটন, অজ্ঞাত অপরাপর সদস্যদের শনাক্ত ও গ্রেপ্তার করার স্বার্থে সিআইডির তদন্ত এবং অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটলে পালিয়ে যান সাইফুজ্জান চৌধুরী জাবেদ ও তার পরিবার। এরপর বেরিয়ে আসতে থাকে লন্ডনে তার সম্পত্তির পাহাড়। এ নিয়ে আলজাজিরায় একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনও প্রকাশ করা হয়। তারপর থেকে জাবেদ ও তার স্ত্রীসহ পরিবারের কারওই কোনো হদিস মেলেনি।

Discussion about this post