Print Date & Time : 20 November 2025 Thursday 4:57 am

বিদেশিরা কেন বাংলাদেশে বিনিয়োগে দ্বিধাগ্রস্ত

সাইফুল ইসলাম : বাংলাদেশ আজ দক্ষিণ এশিয়ার দ্রুততম বর্ধনশীল অর্থনীতির অন্যতম। তরুণ জনসংখ্যা, বৃহৎ ভোক্তাবাজার এবং তুলনামূলকভাবে সাশ্রয়ী শ্রমব্যয়—সব মিলিয়ে এই দেশটি বহু বছর ধরেই বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। কিন্তু বাস্তব চিত্রটি কিছুটা ভিন্ন, অর্থাৎ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ ফোরাম ও রিপোর্টে বারবার উঠে এসেছে, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশের প্রতি আগ্রহী হলেও বাস্তব বিনিয়োগে দ্বিধাগ্রস্ত। প্রশ্ন জাগে—কেন এমনটি হচ্ছে?

নীতিগত অস্থিরতা আস্থার প্রথম বাধা: বিনিয়োগের প্রথম শর্ত হলো নীতির স্থিতিশীলতা ও পূর্বানুমানযোগ্যতা। কিন্তু বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত সেই পরিবেশ পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা দেখতে পান অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তে ঘনঘন পরিবর্তন, করনীতিতে অনির্দেশ্যতা এবং নীতিনির্ধারকদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশ ব্যাংক, বিএসইসি ও এনবিআরের নীতিমালার মধ্যে প্রায়ই অসামঞ্জস্য দেখা যায়। একদিকে রপ্তানি আয়ের প্রণোদনা বাড়ানো হচ্ছে, অন্যদিকে মুনাফা বিদেশে পাঠানোর অনুমোদনে জটিলতা তৈরি হচ্ছে, এমন দ্বৈত আচরণ বিনিয়োগকারীদের অনিশ্চয়তায় ফেলে দেয়।

তুলনামূলকভাবে ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়া দীর্ঘমেয়াদি ‘ইনভেস্টমেন্ট পলিসি ফ্রেমওয়ার্ক’ তৈরি করে বিনিয়োগকারীর আস্থা ধরে রেখেছে। ভিয়েতনাম ২০০৬ সালে তাদের ‘এন্টারপ্রাইজ আইন’ এবং ‘বিনিয়োগ আইন’ সমন্বিত করে একটি স্পষ্ট কাঠামো দেয়, যেখানে করছাড়, মুনাফা পুনঃপ্রেরণ ও মালিকানার অধিকার স্পষ্টভাবে সংরক্ষিত। বাংলাদেশে এখনও এমন স্বচ্ছ আইনি কাঠামো পুরোপুরি গড়ে ওঠেনি।

আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও ধীর অনুমোদন প্রক্রিয়া: বিনিয়োগ অনুমোদনের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ এখনও পিছিয়ে। বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ‘ওয়ান স্টপ সার্ভিস’ চালু করলেও বাস্তবতায় বিনিয়োগকারীদের একাধিক দপ্তরে ঘুরতে হয়। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা সময়কে টাকার সমান গুরুত্ব দেন; অথচ আমাদের এখানে বিদ্যুৎ সংযোগ, গ্যাসলাইন বা করছাড়ের অনুমোদনে মাসের পর মাস বিলম্ব ঘটে।

বিশ্বব্যাংকের ২০২৪ সালের নতুন ‘বিজনেস রেডি’ রিপোর্ট দেখায়, বাংলাদেশের ব্যবসা পরিবেশ এখনও আঞ্চলিক প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে আছে। এই সূচকে বাংলাদেশ সবচেয়ে কম স্কোর করেছে পাবলিক সার্ভিস খাতে মাত্র প্রায় ৪১ দশমিক ৬০, যা সরকারি সেবা গ্রহণের জটিলতা, ধীরগতি ও প্রশাসনিক অকার্যকারিতার প্রতিফলন। রেগুলেটরি ফ্রেমওয়ার্ক স্কোরও মাত্র ৫৭-এর মতো, যা নিয়মকানুন থাকলেও তাদের বাস্তব প্রয়োগ দুর্বল থাকার ইঙ্গিত দেয়। বিপরীতে প্রতিবেশী ভারত ও ভিয়েতনাম উল্লেখযোগ্যভাবে ভালো স্কোর করেছে, বিশেষত দ্রুতগতির সরকারি সেবা, স্বচ্ছ অনুমোদন প্রক্রিয়া ও ব্যবসাবান্ধব সংস্কারের কারণে। ফলে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে বিনিয়োগের আগে দ্বিধায় পড়ে, কিন্তু ভারত ও ভিয়েতনামকে বেশি আকর্ষণীয় মনে করে। স্পষ্টতই নীতিমালা নয়, বাস্তবায়নই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এবং সরকারি সেবা ও প্রশাসনিক দক্ষতা বাড়ানো ছাড়া বাংলাদেশ এই প্রতিযোগিতায় এগোতে পারবে না।

বৈদেশিক মুদ্রা সংকট ও রেমিট্যান্স বাধা: সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ডলার সংকট ও রিজার্ভের পতন বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সবচেয়ে বড় উদ্বেগে পরিণত হয়েছে। অনেক বহুজাতিক কোম্পানি অভিযোগ করেছে, তারা মুনাফা বিদেশে পাঠাতে বিলম্ব বা সীমাবদ্ধতার মুখে পড়ছে। অর্থাৎ, বিনিয়োগের পর মুনাফা ফেরত নেয়ার নিশ্চয়তা নেই, এটি যে কোনো বিদেশি বিনিয়োগকারীর কাছে গুরুতর সংকেত। অথচ ভিয়েতনাম বা মালয়েশিয়া এখানে সম্পূর্ণ ভিন্ন নীতি অনুসরণ করেছে। তারা নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে মুনাফা ফেরত নেয়ার গ্যারান্টি প্রদান করে, এমনকি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে ডলার ট্রান্সফার সুবিধা নিশ্চিত করেছে। বাংলাদেশের জন্যও এ ধরনের নিশ্চয়তা এখন সময়ের দাবি।

জ্বালানি, অবকাঠামো ও শিল্পায়নের সীমাবদ্ধতা: বাংলাদেশে নানা মেগা প্রকল্প মহাসড়ক, নতুন রেললাইন, মেট্রোরেল, অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রভৃতি গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে অবকাঠামোগত উন্নতি ঘটেছে, কিন্তু বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহের অনিশ্চয়তা এখনো সমাধান হয়নি। শিল্প স্থাপনের ক্ষেত্রে নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহের অভাব, বন্দর জট, ও লজিস্টিক ব্যয় বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

২০২৩ সালে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেশন এজেন্সি-জাইকা প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, ‘বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহ থাকলেও অবকাঠামো দুর্বলতা এবং বিদ্যুৎ সরবরাহের অনিশ্চয়তা জাপানি বিনিয়োগকারীদের মনোভাবকে নরম করে দিয়েছে।’ এই মন্তব্য কেবল জাপানের নয়, এটি বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীদের এক অভিন্ন উদ্বেগ।

পুঁজিবাজারে আস্থাহীনতা ও তথ্য স্বচ্ছতার ঘাটতি: বিদেশি পোর্টফোলিও বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে তুলনামূলকভাবে কম সক্রিয়। এর মূল কারণ হলো তথ্যের স্বচ্ছতা ও নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থার কার্যকারিতায় আস্থার অভাব। আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীরা এমন বাজার খোঁজেন, যেখানে আর্থিক প্রতিবেদন সময়মতো প্রকাশিত হয়, ইনসাইডার ট্রেডিং কঠোরভাবে দমন করা হয় এবং রিয়েল টাইম মনিটরিং ব্যবস্থা বিদ্যমান থাকে।

দুঃখজনকভাবে বাংলাদেশের বাজারে এখনও দেখা যায় আর্থিক প্রতিবেদনে অস্বচ্ছতা, বার্ষিক রিপোর্ট বিলম্বে প্রকাশ এবং শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে দেরি। ফলে আন্তর্জাতিক ফান্ড ম্যানেজাররা বাংলাদেশকে উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে বিনিয়োগ থেকে বিরত থাকেন।

ভূ-রাজনৈতিক ভারসাম্য ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা: বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান বিনিয়োগে একদিকে সুযোগ, অন্যদিকে চ্যালেঞ্জ। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের অংশ হিসেবে চীনা বিনিয়োগ বাড়লেও পশ্চিমা বিনিয়োগকারীরা এতে রাজনৈতিক ঝুঁকি দেখেন। একইভাবে যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্র্যাটেজিক ইন্ডো-প্যাসিফিক নীতির চাপও দেশের কূটনৈতিক অবস্থানকে জটিল করে তুলেছে। এই সময় ভিয়েতনাম ও ভারত নিজেদের ‘নিরপেক্ষ বিনিয়োগ কেন্দ্র’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে, যেখানে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও নীতির ধারাবাহিকতা বিনিয়োগকারীর চোখে নিরাপত্তা নিশ্চিত করে।

বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে হলে প্রথমেই প্রয়োজন বিশ্বাস পুনর্গঠন। সরকারকে নীতিগত ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হবে, বিনিয়োগ অনুমোদন প্রক্রিয়া ডিজিটালভাবে সহজ করতে হবে এবং মুনাফা পুনঃপ্রেরণে নির্দিষ্ট সময়সীমার নিশ্চয়তা দিতে হবে। একই সঙ্গে পুঁজিবাজারে রিয়েল-টাইম মনিটরিং ব্যবস্থা, এআই-চালিত ইনভেস্টর অ্যানালিটিক্স এবং আন্তর্জাতিক মানের করপোরেট গভর্ন্যান্স কোড প্রণয়ন জরুরি। ভিয়েতনাম যেভাবে ‘জাতীয় বিনিয়োগ প্রচার সংস্থা’-এর মাধ্যমে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের একক যোগাযোগ বিন্দু দিয়েছে, বাংলাদেশকেও সেই ধরনের কার্যকর কাঠামো বাস্তবায়ন করতে হবে।

বাংলাদেশের অর্থনীতি সম্ভাবনায় পরিপূর্ণ, তবে সেই সম্ভাবনা বাস্তব রূপ পেতে হলে নীতির স্থিতিশীলতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা কেবল মুনাফার জন্য আসে না; তারা আসে বিশ্বাসযোগ্যতা, আইনি সুরক্ষা ও ন্যায্য পরিবেশের নিশ্চয়তা খুঁজতে। এই তিনটি উপাদান অর্জন করতে পারলে বাংলাদেশ আবারও হতে পারে দক্ষিণ এশিয়ার পরবর্তী বিনিয়োগ কেন্দ্র, এখন যেখানে আস্থাও হবে মূলধন।

 

মুক্ত লেখক