Print Date & Time : 20 September 2025 Saturday 5:20 am

বিদেশি ঋণে নতুন রেকর্ড ছাড়াল ১১২ বিলিয়ন ডলার

নিজস্ব প্রতিবেদক : দেশের ইতিহাসে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ আবারও নতুন রেকর্ড গড়েছে। আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে শুধু গত জুনে মাসে পাঁচ বিলিয়ন ডলারের বেশি ঋণ পেয়েছে বাংলাদেশ। এতে বিদেশি ঋণ বেড়ে ১১২ দশমিক ১৫ বিলিয়ন বা ১১ হাজার ২১৫ কোটি ডলার হয়েছে। প্রতি ডলার ১২২ টাকা ধরে এই অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১৩ লাখ ৬৮ হাজার ৩৫২ কোটি টাকা।
তবে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর অর্থ পাচারের বিরুদ্ধে কঠোর হয়েছে সরকার। গত অর্থবছর রেকর্ড ৫৭০ কোটি ৪৫ লাখ ডলার পরিশোধ হয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিদেশি ঋণ পরিশোধের পরিমাণ ছিল ৪৭৯ কোটি ৫৪ লাখ ডলার। এর পরও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছর রেকর্ড ৩০ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স এসেছে। আবার রপ্তানি আয়ে ১০ শতাংশের মতো প্রবৃদ্ধি হয়েছে। পাশাপাশি প্রচুর কম সুদের বিদেশি ঋণের কারণে ডলার বাজারে স্বস্তি ফিরেছে। গ্রস রিজার্ভ বেড়ে গত জুন শেষে ৩১ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলারে উঠেছিল। আর বিপিএম-৬ অনুযায়ী রিজার্ভ দাঁড়ায় ২৬ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন ডলার, প্রায় তিন বছরের মধ্যে যা ছিল সর্বোচ্চ। আবার ডলারের দর ১২২ টাকার মধ্যে স্থিতিশীল রয়েছে। মাঝে অবশ্য দর কমে ১১৯ টাকা ৫০ পয়সায় নেমেছিল। তবে ডলারের দর কমলে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি কমতে পারে, এমন শঙ্কায় উদ্বৃত্ত ডলার কিনে নিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চলতি অর্থবছর এরই মধ্যে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ১৭৪ কোটি ৭৫ লাখ ডলার কিনেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, যে কারণে আকুর দায় পরিশোধের পরও রিজার্ভ আবার ৩১ বিলিয়ন ডলার হয়েছে।
গত জুন শেষে বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণ কমে ১৯ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে, তিন মাস আগে যা ছিল ১৯ দশমিক ৮৮ বিলিয়ন ডলার। তবে সরকারি খাতে ঋণ বেড়ে ৯ হাজার ২৩৮ কোটি ডলার হয়েছে, তিন মাস আগে যা ছিল ৮ হাজার ৪৯২ কোটি ডলার।
সংশ্লিষ্টরা জানান, করোনা-পরবর্তী সময়ে নীতি শিথিলতার সুযোগ নিয়ে দেশ থেকে অর্থ পাচার ব্যাপক বেড়েছিল, যে কারণে ২০২১ সালের ৮৪ টাকার ডলার বিগত সরকার বিদায়ের আগে ১২২ টাকায় উঠেছিল। আবার ২০২১ সালের আগস্টে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ উঠেছিল রেকর্ড ৪৮ দশমিক শূন্য ৬ বিলিয়ন ডলার। সেখান থেকে অর্ধেকের বেশি কমে আওয়ামী লীগের পতনের সময় ২০ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলারে নেমেছিল। সেখান থেকে না কমে এখন বেড়ে ২৬ দশমিক শূন্য ৮ বিলিয়ন ডলারে উঠেছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নিয়ে সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠন করে। এই কমিটির হিসাব অনুযায়ী, বিগত সরকারের প্রায় ১৬ বছরে দেশ থেকে ২৩৪ কোটি ডলার পাচার হয়েছে।
অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, একাধিক দাতা সংস্থা থেকে অর্থ ছাড়ই সরকারি খাতে বৈদেশিক ঋণ বৃদ্ধির মূল কারণ।
কর্মকর্তারা বলেন, ‘বিভিন্ন সংস্থা থেকে ঋণ এসেছে, যেমন আইএমএফ থেকেই ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার পাওয়া গেছে। এছাড়া বাজেট সহায়তার জন্য বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও এআইআইবি থেকে প্রায় তিন বিলিয়ন ডলার এসেছে। এ অর্থগুলো সরকারের বৈদেশিক ঋণে যুক্ত হয়েছে।’
কর্মকর্তারা জানান, এ অর্থপ্রবাহ দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিকে শক্তিশালী করেছে। পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা বাজারকেও স্থিতিশীল রাখতে সহায়তা করেছে, ফলে ডলারের বিনিময় হার তুলনামূলকভাবে স্থির রয়েছে। তবে যদি এ অর্থ উৎপাদন প্রবৃদ্ধি বা রাজস্ব আদায়ে ভূমিকা রাখতে না পারে, তবে তা সুফল না দিয়ে বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।
এ বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) বিশিষ্ট ফেলো অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘বেসরকারি খাতে যে বিদেশি ঋণ আসে, তার বেশিরভাগই ট্রেড ফাইন্যান্স হিসেবে আসে। কিন্তু টাকার অবমূল্যায়নের কারণে অনেক ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, কারণ ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় খরচও অনেক বেড়েছে। ব্যবসার খরচ ভালোভাবে হিসাব করতে হয় বলে স্থানীয় উদ্যোক্তারা এখন কম বিদেশি ঋণ নিচ্ছেন। আবার এসব স্বল্পমেয়াদি ঋণের সুদও বেশি হওয়ায় সেটিও তাদের জন্য বাড়তি চাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘এই ঋণগুলো ব্যবহারে সতর্কতা প্রয়োজন। কারণ এর মধ্যে ঝুঁকি আছে, যেমন উচ্চ সুদহার এবং খুব স্বল্প গ্রেস পিরিয়ড। তাই প্রকল্পগুলো সতর্কভাবে মূল্যায়ন করতে হবে। পাশাপাশি এসব ঋণের ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে সুশাসনের মাধ্যমে।’
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘উন্নয়ন প্রকল্পে এসব অর্থ ব্যবহার করে যদি রাজস্ব আদায় বা উৎপাদন নিশ্চিত করা না যায়, তবে পরিশোধের সময় এ ঋণ দেশের অর্থনীতির ওপর চাপ ফেলবে। তাই এগুলোকে সর্বোচ্চভাবে কাজে লাগাতে হবে, যেন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, মেট্রোরেল ও পদ্মা সেতুর মতো লাভজনক প্রকল্প জরুরি, যাতে সেখান থেকে রাজস্ব আদায় সম্ভব হয়। তবে কিছু চলমান প্রকল্প লোকসানের ঝুঁকিতে আছে, তাই সতর্ক থাকতে হবে।