শেখ শাফায়াত হোসেন : দুর্বল পাঁচটি শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক একীভূতকরণ প্রক্রিয়া শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত মঙ্গলবার এক বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংক এ কথা সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোকে জানিয়ে দিয়েছে। বৈঠকে বলা হয়, এ ব্যাংকগুলোকে নিয়ে একটি নতুন নামের শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হবে; যা প্রথমে সরকারি ব্যাংক হিসেবে চলবে। পরে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়া হবে।
সূত্র মতে, ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে সব ধরনের তথ্য নিয়ে তা সংক্ষিপ্ত আকারে চলতি সপ্তাহে সরকারের কাছে তুলে ধরবে বাংলাদেশ ব্যাংক। দীর্ঘদিন ধরে আলোচিত ব্যাংক একীভূতকরণ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের এটাই হবে আনুষ্ঠানিক সূচনা।
জানা গেছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়কে সার্বিক প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় অর্থের পরিমাণ এবং ব্যাংকগুলোর শেয়ার নির্ধারণের বিষয়সহ সামগ্রিক পরিকল্পনা তুলে ধরা হবে।
তাতে একীভূত ব্যাংকের নতুন নামও উল্লেখ করা হবে। তবে নামটি চূড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত প্রকাশ করা হবে না। কেননা, নামটি পরিবর্তনও হতে পারে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সাড়া পেলে আগামী অক্টোবর থেকে একীভূতকরণ প্রক্রিয়া শুরু হবে বলেও জানা গেছে।
সদ্য প্রণীত ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশ ২০২৫-এর অধীনে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংককে একীভূত করার সিদ্ধান্তের কথা গত মঙ্গলবার সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোকে জানিয়ে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ওই দিন এক্সিম ব্যাংক ছাড়া অন্য চারটি ব্যাংক সেই বৈঠকে উপস্থিত ছিল।
গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে চারটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান, ডেপুটি গভর্নর মো. কবির আহমেদ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্যান্য জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
ব্যাংকের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের মোহাম্মদ আব্দুল মান্নান, ইউনিয়ন ব্যাংকের মো. ফরিদউদ্দিন আহমেদ, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের মোহাম্মদ নূরুল আমিন এবং সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের এম সাদিকুল ইসলাম।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, একীভূতকরণের পুরো প্রক্রিয়াটি তদারকির জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক মতিঝিলের সেনা কল্যাণ ভবনে একটি কার্যালয় স্থাপন করবে।
বৈশ্বিক অডিট প্রতিষ্ঠান কেপিএমজি ও আর্নস্ট অ্যান্ড ইয়ং পরিচালিত ফরেনসিক অডিটে দুর্বল আর্থিক অবস্থা প্রকাশ পাওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক গত জুনে এই পাঁচটি সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংককে একীভূত করার সিদ্ধান্ত নেয়। সম্পদ গুণগত মান পর্যালোচনায় দেখা গেছে, তাদের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ঘোষিত সংখ্যার চার গুণ বেশি।
তবে এই পাঁচটি ব্যাংক আবারও বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে তারল্য সহায়তা চেয়েছিল। তবে নিয়ন্ত্রক সংস্থা তা দেয়নি।
ব্যাংকগুলো বলছে, ব্যাংকগুলোয় আগে যেভাবে লুটপাট হয়েছে, এখন তা শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে। ফলে এই ব্যাংকগুলোর আমানত তুলে নেয়ার চাপ সামলাতে কিছু টাকা ধার দিলে ব্যাংকগুলো আগামী দুই-তিন বছরের মধ্যে ঘুরে দাঁড়াতে পারত।
এ বিষয়ে আলোচিত ব্যাংকগুলোর একটির স্বতন্ত্র পরিচালক শেয়ার বিজকে বলেন, আমাদের এই ব্যাংকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকই বসিয়েছে। আমরা চেষ্টা করেছি সব সূচকে ভালো করতে। ইতোমধ্যে তা হয়েছেও। এ ক্ষেত্রে আর পাঁচ থেকে ছয় হাজার কোটি টাকা ধার পেলে ব্যাংকটি ঘুরে দাঁড়াত।
তাহলে এত দিন ধরে ব্যাংকগুলো যে ‘ব্র্যান্ড ভ্যালু’ বা সুনাম অর্জন করেছিল তার একটি অর্থনৈতিক মূল্য থাকত। কিন্তু এখন যে প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক এ ব্যাংকগুলো বিলুপ্ত ঘোষণা করবে তাতে এই ব্র্যান্ড ভ্যালুর কোনো ব্যবহার থাকবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, পাঁচ ব্যাংকের সম্মিলিত গ্রাহক সংখ্যা ৯২ লাখ। আমানত ১ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা। ঋণ ২ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা। শাখা ৭৭৯টি। জনবল ১৫ হাজারের বেশি।
আলোচিত আরেক ব্যাংকের পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে শেয়ার বিজকে বলেন, ব্যাংকগুলো বন্ধ হয়ে গেলে ৫ থেকে ১০ হাজার কোটি টাকার সম্পদ নষ্টও হবে। প্রতিটি ব্যাংকের শাখায় ভল্ট থাকে, শাখাগুলো ৯ বছরের জন্য ভাড়ার এগ্রিমেন্ট করতে হয়। এই শাখাগুলো ছেড়ে দিলে এর পেছনে যে ব্যয় আছে তা লোকসান হবে। অনেক ইকুয়েপমেন্ট যেমন কম্পিউটার, সার্ভারসহ অনেক ধরনের নেটওয়ার্ক কানেকশন, সার্ভিস এগ্রিমেন্ট, বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে রেমিট্যান্স আনাসহ বৈদেশিক বাণিজ্য চুক্তি রয়েছে, সেগুলো বাতিল করতে হবে। এমন অনেক দাপ্তরিক কাগজপত্র যেমন চেকবই, কার্ড বাতিল হয়ে যাবে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক যে টাকা ব্যয় করবে এই একীভূতকরণ প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করতে, তা ৫টি ব্যাংককে ভাগ করে ধার দিলে ব্যাংকগুলো নিশ্চিতভাবে দাঁড়িয়ে যেত। কারণ ব্যাংকগুলোয় এখন অনিয়মের সব পথ এখন বন্ধ হয়েছে।
একীভূত করা ব্যাংকগুলোর কর্মীদের চাকরি নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তা থাকবে না বলে আগে থেকেই জানিয়ে আসছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘কর্মীদের কারও চাকরি যাবে না। আমানতকারীদেরও আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই, সব টাকা ফেরত দেয়া হবে।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এ প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হতে পারে; যা দিয়ে প্রাথমিকভাবে ব্যাংকটির আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দেয়া হবে।
একই সময়ে একটি অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিও গঠন করার কথা বলা হয় ব্যাংক রেজুলেশন অর্ডিনেন্সে। ওই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে একীভূত হওয়া ব্যাংকগুলোর ঋণ আদায় করা হবে। তবে এখনও ওই অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি গঠনের কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের লক্ষ্য, আগামী অক্টোবরের মধ্যে এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা। নির্বাচনের আগেই এই একীভূতকরণ সম্পন্ন হবে বলে আগেই জানিয়েছিলেন গভর্নর।
তুলনামূলক ভালো অবস্থানে থাকা এক্সিম ব্যাংক চাইলে একীভূতকরণ থেকে সরে দাঁড়াতে পারবে, সেক্ষেত্রে তাদের সিআরআর, এসএলআর এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নেয়া ধারের আট হাজার কোটি টাকা পরিশোধ করতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সম্পদ মূল্যায়নে ইউনিয়ন ব্যাংকের মোট ঋণের ৯৭ দশমিক ৮০ শতাংশ খেলাপি, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ৯৬ দশমিক ৩৭ শতাংশ, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের ৯৫ শতাংশ, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ৬২ দশমিক ৩০ শতাংশ এবং এক্সিম ব্যাংকের ৪৮ দশমিক ২০ শতাংশ খেলাপিতে পরিণত হয়েছে।
যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, ‘ওই বৈঠক একীভূতকরণ উদ্যোগের অংশ। প্রক্রিয়াটি দ্রুততর করার জন্যই এই বৈঠক হয়েছে।’
ইউনিয়ন ব্যাংকের চেয়ারম্যান ফরিদউদ্দিন জানান, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর তাদের মতামত নিয়েছেন এবং আশ্বস্ত করেছেন, উদ্যোগটি আইনগতভাবে সম্পন্ন হবে। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আব্দুল মান্নান বলেন, আশা করি ভালো কিছু ঘটবে। একটু অপেক্ষা করতে হবে এজন্য।

Discussion about this post