নিজস্ব প্রতিবেদক : রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর পাশাপাশি বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। খেলাপি ঋণের হার বেড়েছে এই ব্যাংকগুলোয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের গত মার্চ শেষে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন তিনটি বিশেষায়িত ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা। তবে ব্যাংকগুলোয় কোনো প্রভিশন ঘাটতি নেই।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, গত মার্চ শেষে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক (বিকেবি), রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব) ও প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকে মোট
খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৬ হাজার ৪৯৪ কোটি ২ লাখ টাকা।
এর মধ্যে টাকার অঙ্কে সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ রয়েছে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকে। ব্যাংকটিতে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ হচ্ছে ৪ হাজার ৯০২ কোটি ৬ লাখ টাকা। খেলাপি ঋণের হার ১৪ দশমিক ১১ শতাংশ।
ব্যাংকটির নিজস্ব হিসাবে গত ২০২২-২৩ ও ২০২৩-২৪ অর্থবছরে খেলাপি ঋণের হার ছিল যথাক্রমে ১০ দশমিক ৫৫ শতাংশ এবং ১১ দশমিক ৯৭ শতাংশ।
কৃষি ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, আমানতের মধ্যে প্রায় ৭১ শতাংশ উচ্চ সুদবাহী আমানত, তহবিল ব্যয়ের তুলনায় কম সুদে শতভাগ ঋণ বিতরণ ও বিপুল পরিমাণ মূলধন ঘাটতি ব্যাংকটির অন্যতম প্রধান সমস্যা।
গত মার্চ শেষে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের (রাকাব) খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ হাজার ২৭৮ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের হার হচ্ছে ১৭ দশমিক ২৬ শতাংশ।
রাকাবের নিজস্ব ভাষ্য মতে, অধিক শ্রেণিকৃত ও অবলোপনকৃত ঋণ ব্যাংকটির অন্যতম প্রধান সমস্যা।
গত মার্চ শেষে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩১৪ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের হার হচ্ছে ১১ দশমিক ৪৫ শতাংশ।
ব্যাংকটির নিজস্ব হিসাবে গত ২০২২-২৩ ও ২০২৩-২৪ অর্থবছর শেষে ব্যাংকটিতে খেলাপি ঋণের হার ছিল যথাক্রমে ৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ এবং ৭ দশমিক ৮০ শতাংশ। প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের নিজস্ব ভাষ্য মতে, শ্রেণিকৃত ঋণ (নন-পারফর্মিং ঋণ) ব্যাংকটির অন্যতম প্রধান সমস্যা।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে খেলাপি ঋণের ভয়াবহ চিত্র বের হতে শুরু করে। খেলাপি ঋণ বাড়তে বাড়তে বর্তমানে সাড়ে ৩ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ করা প্রতিবেদনে দেখা যায়, ব্যাংক খাতে তিন মাসে (জানু-মার্চ) খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৫২ হাজার ৫৮১ কোটি টাকা। এর ফলে মার্চ শেষে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৫৭ হাজার ৬৫৫ কোটি টাকায়। সম্প্রতি এ তথ্য প্রকাশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
প্রাপ্ত তথ্যে আরও দেখা যায়, ব্যাংক খাতের বিতরণ করা ঋণের তুলনায় খেলাপি ঋণের হার বেড়ে হয়েছে ২০ দশমিক ৫৩ শতাংশ। মার্চ শেষে ব্যাংক খাতে বিতরণ করা মোট ঋণের স্থিতি ছিল ১৭ লাখ ৪১ হাজার ৯৯২ কোটি টাকা।
২০২৪ সালের ডিসেম্বরে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ৩ লাখ ৫ হাজার ৭৩ কোটি টাকা। তখন খেলাপি ঋণের হার ছিল ১৭ দশমিক ৮৩ শতাংশ।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে পরিচালিত কোটা সংস্কার আন্দোলনের জের ধরে সংগঠিত জুলাই অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগে অর্থাৎ ২০২৪ সালের মার্চে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৬৬ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা। সেই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১ লাখ ৯১ হাজার ৩৬১ কোটি টাকা।
খেলাপি ঋণ বাড়ার ৫টি কারণ ছিল বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে একটি বড় কারণ, সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক মেয়াদি ঋণের মেয়াদোত্তীর্ণের সময় পুনর্নির্ধারণ করেছে। যার ফলে অনাদায়ী ঋণ আগের থেকে কম সময়ে খেলাপি হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে।
ব্যাংক ক্যাটেগরি ওয়ারী শ্রেণিকৃত ঋণ পরিস্থিতি: গত মার্চ শেষে সরকারি ৬ ব্যাংকে (সোনালী, রূপালী, অগ্রণী, জনতা, বেসিক, বিডিবিএল) খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২৪ হাজার ৩৩৭ কোটি টাকা। বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ২৩ হাজার ৮৩৭ কোটি টাকা। বিদেশি খাতের ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৬৬৫ কোটি টাকা।
প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, মার্চ শেষে রাষ্ট্র মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকে শ্রেণিকৃত ঋণের গ্রস হার ছিল ৪৫.৭৯ শতাংশ। এই হার বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকে ২০.১৬ শতাংশ, বিদেশি ব্যাংকে ৪.৮৩ শতাংশ ও বিশেষায়িত ব্যাংকসমূহে ১৪.৪৭ শতাংশ। পক্ষান্তরে ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪ তারিখে রাষ্ট্র মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকে শ্রেণিকৃত ঋণের গ্রস হার ছিল ৪২.৮৩ শতাংশ। এই হার বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকে ছিল ১৫.৬০ শতাংশ, বিদেশি ব্যাংকে ৪.১৩ শতাংশ ও বিশেষায়িত ব্যাংকসমূহে ১৪.৩৭ শতাংশ। অর্থাৎ বিগত ত্রৈমাসিকের তুলনায় বর্তমান ত্রৈমাসিকে রাষ্ট্র-মালিকানাধীন বাণিজ্যিক, বেসরকারি ব্যাংক, বিদেশি ব্যাংক এবং বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর শ্রেণিকৃত ঋণের গ্রস হার যথাক্রমে ২.৯৬ শতাংশ পয়েন্ট, ৪.৫৬ শতাংশ পয়েন্ট, ০.৭০ শতাংশ এবং ০.১০ শতাংশ পয়েন্ট বৃদ্ধি পেয়েছে।
ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, বিগত সরকারের আমলে ব্যাংক থেকে প্রভাবশালীদের বড় অঙ্কের ঋণ দিতে নানা সুবিধা দেয়া হয়েছিল। পাশাপাশি খেলাপি ঋণ কাগজে-কলমে কম দেখাতে নেয়া হয়েছিল একের পর এক নীতি। সরকার পরিবর্তনের পর সেই নীতি থেকে সরে এসেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পাশাপাশি খেলাপি ঋণে জর্জরিত পাঁচ ইসলামি ধারার ব্যাংককে একীভূত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর মধ্যে অন্তত তিনটি ব্যাংক একীভূত হবে বলে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।

Discussion about this post