ড. মতিউর রহমান : বিশ্বায়নের যুগে নির্ভরতা তত্ত্বের প্রাসঙ্গিকতা নতুন রূপ ধারণ করেছে। যেখানে একসময় প্রান্তিক দেশগুলো কেবল কাঁচামাল রপ্তানি করে উন্নত দেশের ওপর নির্ভরশীল ছিল, এখনকার বিশ্বায়িত বিশ্বে সেই নির্ভরশীলতার ধরন আরও জটিল। বহুজাতিক করপোরেশনগুলো এখন কেবল শিল্প পণ্য উৎপাদন করে না, বরং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম, আর্থিক পরিষেবা এবং প্রযুক্তিগত কাঠামোও নিয়ন্ত্রণ করে, যা উন্নয়নশীল দেশগুলোকে নতুন ধরনের অর্থনৈতিক শৃঙ্খলে আবদ্ধ করছে।
বাংলাদেশের মতো দেশগুলো পোশাকশিল্প এবং ডিজিটাল গিগ অর্থনীতির মাধ্যমে বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলে যুক্ত হলেও, এই সম্পর্ক প্রায় অসমই থেকে যায়। উন্নত দেশগুলো প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও ব্র্যান্ডিংয়ের মাধ্যমে মুনাফার সিংহভাগ নিজেদের কাছে ধরে রাখে, আর উন্নয়নশীল দেশগুলো কেবল সস্তা শ্রম সরবরাহকারী হিসেবে কাজ করে। এভাবে বিশ্বায়ন একদিকে যেমন নতুন সুযোগ সৃষ্টি করছে, তেমনি নির্ভরতা তত্ত্বের মূল যুক্তিকে নতুন বাস্তবতায় আরও প্রাসঙ্গিক করে তুলছে, যেখানে পুরোনো কাঠামোগত বৈষম্য নতুন রূপে ফিরে আসছে।
বিশ্বায়ন তত্ত্ব কোনো একটি নির্দিষ্ট সময়ে বা একক কোনো প্রবক্তার দ্বারা শুরু হয়নি, বরং এটি একটি বিবর্তিত ধারণা যা মূলত ১৯৮০ ও ১৯৯০-এর দশকে গতি পায়। এর উত্থানের পেছনে প্রধান কারণ ছিল প্রযুক্তির অভাবনীয় অগ্রগতি, বিশেষত ইন্টারনেট ও যোগাযোগব্যবস্থার বিকাশ, যা পণ্য, তথ্য, পুঁজি এবং মানুষের আন্তঃসীমান্ত চলাচলকে অভূতপূর্বভাবে সহজ করে তোলে।
এই তত্ত্বের আগে দুটি বিপরীতমুখী ধারণা প্রচলিত ছিল: ১৯৫০-এর দশকে জনপ্রিয় আধুনিকীকরণ তত্ত্ব, যা বিশ্বাস করত যে উন্নয়নশীল দেশগুলো উন্নত দেশগুলোর পথ অনুসরণ করলেই উন্নতি করবে; এবং এর বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হিসেবে ১৯৬০-এর দশকে উদ্ভূত নির্ভরতা তত্ত্ব, যা যুক্তি দিত যে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক কাঠামোই অসম এবং উন্নত দেশগুলো তাদের নিজেদের স্বার্থে দরিদ্র দেশগুলোকে শোষণ করে। বিশ্বায়ন তত্ত্ব এই দুটি ধারণাকেই ছাড়িয়ে যায় এবং যুক্তি দেয় যে, প্রযুক্তিগত ও অর্থনৈতিক আন্তঃসংযোগের ফলে বিশ্ব এখন একটি জটিল ও বহুমুখী একক ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে, যেখানে কেবল কেন্দ্র-প্রান্তিকের সম্পর্কই নয়, বরং আরও অনেক সূক্ষ্ম ও জটিল প্রক্রিয়া কাজ করছে।
বিশ্বায়ন তত্ত্বের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক দ্বিমুখী ও জটিল। একদিকে, বিশ্বায়ন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নতুন সুযোগ এনে দিয়েছে, অন্যদিকে এটি দেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কাঠামোতে নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। পোশাকশিল্প, প্রবাসী শ্রমিকদের রেমিট্যান্স এবং ডিজিটাল অর্থনীতির বিকাশ বিশ্বায়নের কারণে সম্ভব হয়েছে। তবে এর ফলে শ্রম শোষণ, পরিবেশ দূষণ এবং সাংস্কৃতিক মিশ্রণের মতো নতুন সমস্যাও দেখা দিয়েছে; যা দেশের নিজস্বতাকে প্রভাবিত করছে। বিশ্বায়ন তত্ত্বের আলোকে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতাকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এটি শুধু অর্থনৈতিক সুযোগ নয়, বরং নতুন ধরনের নির্ভরশীলতা এবং বৈষম্যেরও জš§ দিয়েছে।
নির্ভরতা তত্ত্ব অনুসারে বিশ্ব অর্থনীতিতে কিছু উন্নত দেশ কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে এবং বাকি উন্নয়নশীল দেশগুলো প্রান্তিক হিসেবে থাকে। এই অর্থনৈতিক কাঠামো একটি গভীর ও জটিল সম্পর্ক তৈরি করে, যা প্রান্তিক দেশগুলোর অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে স্থায়ী বাধা সৃষ্টি করে। নির্ভরতা তত্ত্বের মূল যুক্তি হলো, এই দেশগুলোর অর্থনৈতিক সম্পর্ক অসম এবং শোষণমূলক, যা তাদের নিজস্ব টেকসই উন্নয়নে বাধা দেয়। বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের মতো দেশগুলো, যা ঐতিহাসিকভাবে ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে ছিল, বিশ্ব অর্থনীতির এই কাঠামোর মধ্যে পড়ে।
নির্ভরতা তত্ত্ব একটি সমাজতাত্ত্বিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো, যা ব্যাখ্যা করে কেন কিছু দেশ ধনী এবং কিছু দেশ গরিব। এর মূল যুক্তি হলো, বিশ্ব অর্থনীতি একটি সমতল ক্ষেত্র নয়, বরং একটি শ্রেণিবিন্যাসিত কাঠামো। এই কাঠামোতে উন্নত, শিল্পোন্নত দেশগুলো কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে, যারা উচ্চ প্রযুক্তির পণ্য উৎপাদন করে এবং বিশ্ব বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করে। অন্যদিকে, উন্নয়নশীল বা দরিদ্র দেশগুলো হলো প্রান্তিক, যারা সাধারণত কম মূল্যের কাঁচামাল এবং কৃষি পণ্য রপ্তানি করে। এই দেশগুলো তাদের অর্থনৈতিক কার্যকলাপের জন্য কেন্দ্রের ওপর নির্ভরশীল।
নির্ভরতা তত্ত্বের প্রধান প্রবক্তাদের মধ্যে রয়েছেন অর্থনীতিবিদ রাউল প্রেবিশ্চ এবং সমাজবিজ্ঞানী আন্দ্রে গুন্ডার ফ্রাঙ্ক। ১৯৫০ থেকে ১৯৬০-এর দশকে লাতিন আমেরিকায় এই তত্ত্বের উদ্ভব হয়, যখন সেখানকার অর্থনীতিবিদরা প্রশ্ন তোলেন, কেন উন্নত দেশগুলোর মতো তাদের দেশগুলো অর্থনৈতিকভাবে উন্নতি করতে পারছে না, যদিও তারা প্রচলিত পুঁজিবাদী উন্নয়ন মডেল অনুসরণ করছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, অনেক উন্নয়নশীল দেশ উপনিবেশ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য শিল্পায়ন এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ওপর জোর দেয়। তখন প্রচলিত ছিল আধুনিকীকরণ তত্ত্ব, যা বলেছিল যে উন্নয়নশীল দেশগুলো উন্নত দেশগুলোর মতো একই পথে চললে তারাও অর্থনৈতিকভাবে উন্নত হবে। এই তত্ত্ব ধরে নিয়েছিল যে, দেশীয় সংস্কৃতি, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং প্রযুক্তিগত অগ্রগতিই উন্নয়নের প্রধান শর্ত।
তবে লাতিন আমেরিকার দেশগুলোয় দেখা গেল যে, আধুনিকীকরণ তত্ত্বের মডেল অনুসরণ করেও তারা কাক্সিক্ষত সাফল্য পাচ্ছে না। বরং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে তারা ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ছিল এবং ধনী দেশগুলোর ওপর তাদের নির্ভরশীলতা বাড়ছিল। এই প্রেক্ষাপটে, জাতিসংঘের অর্থনৈতিক কমিশন ফর লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ানের পরিচালক রাউল প্রেবিশ্চ এবং আন্দ্রে গুন্ডার ফ্রাঙ্কসহ অন্যান্য চিন্তাবিদরা যুক্তি দেন, এই ব্যর্থতার কারণ দেশের অভ্যন্তরীণ নয়, বরং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক কাঠামোর মধ্যে নিহিত। তাদের মতে, বিশ্ব অর্থনীতির এই কাঠামোটি নিজেই বৈষম্যমূলক, যেখানে ধনী দেশগুলো তাদের স্বার্থের জন্য দরিদ্র দেশগুলোকে শোষণ করে। এভাবেই নির্ভরতা তত্ত্বের উদ্ভব হয়। এই তত্ত্বটি আধুনিকীকরণ তত্ত্বের সরাসরি বিরোধিতা করে এবং একটি নতুন, সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে। নির্ভরতা তত্ত্বের উদ্ভব ও প্রসারে যেসব লাতিন আমেরিকান দেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, চিলি, মেক্সিকো এবং পেরু।
১৯৫০-এর দশকে জাতিসংঘের অর্থনৈতিক কমিশন ফর লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ানের উদ্যোগে এই দেশগুলোয় অর্থনৈতিক গবেষণা শুরু হয়। এ গবেষণার মূল লক্ষ্য ছিল কেন লাতিন আমেরিকার দেশগুলো অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে আছে, তার কারণ অনুসন্ধান করা। ECLAC-এর পরিচালক রাউল প্রেবিশ্চ ছিলেন এই তত্ত্বের অন্যতম প্রধান প্রবক্তা। তার নেতৃত্বেই আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল ও চিলির মতো দেশগুলোর অর্থনৈতিক অবস্থা বিশ্লেষণ করে এই সিদ্ধান্তে আসা হয় যে, তাদের দুর্বল অর্থনৈতিক কাঠামোর কারণ অভ্যন্তরীণ নয়, বরং উন্নত দেশগুলোর (কেন্দ্র) সঙ্গে তাদের অসম বাণিজ্য সম্পর্ক।
আন্দ্রে গুন্ডার ফ্রাঙ্ক তার গবেষণায় দেখান, মেক্সিকো ও পেরুর মতো দেশগুলোয় পুঁজিবাদের প্রসার কীভাবে তাদের অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এই দেশগুলো থেকে কাঁচামাল এবং প্রাকৃতিক সম্পদ কেন্দ্রে প্রবাহিত হতো, কিন্তু এর মাধ্যমে অর্জিত মুনাফা স্থানীয় উন্নয়নে ব্যবহƒত না হয়ে প্রধানত বহুজাতিক করপোরেশনগুলোর হাতে চলে যেত। এ বাস্তবতার ওপর ভিত্তি করে নির্ভরতা তত্ত্ব একটি শক্তিশালী সমালোচনা হিসেবে গড়ে ওঠে।
এই নির্ভরশীলতা কয়েকটি মূল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ঘটে। প্রথমত, কাঁচামালের রপ্তানি ও চূড়ান্ত পণ্যের আমদানি (Export of Raw Materials and Import of Finished ‡oods)। প্রান্তিক দেশগুলো তাদের প্রাকৃতিক সম্পদ এবং শ্রম ব্যবহার করে কম মূল্যের কাঁচামাল উৎপাদন করে, যা তারা কেন্দ্রের দেশগুলোয় রপ্তানি করে। কেন্দ্র সেই কাঁচামালকে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে উচ্চ মূল্যের চূড়ান্ত পণ্যে রূপান্তরিত করে আবার প্রান্তিক দেশে বিক্রি করে। এই অসম বাণিজ্য সম্পর্ক প্রান্তিক দেশগুলোর বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ায় এবং তাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সীমিত করে। এই প্রক্রিয়ায় প্রান্তিক দেশগুলো থেকে সম্পদ কেন্দ্রের দিকে প্রবাহিত হয়, যা একটি স্থায়ী অর্থনৈতিক বৈষম্য তৈরি করে।
দ্বিতীয়ত, বহুজাতিক করপোরেশন ও অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ (Multinational Corporations and Economic Control)। কেন্দ্রের বহুজাতিক করপোরেশনগুলো প্রান্তিক দেশে বিনিয়োগ করে, কিন্তু এই বিনিয়োগের প্রধান উদ্দেশ্য হলো কম খরচে উৎপাদন করা এবং বাজার দখল করা। এই করপোরেশনগুলো মুনাফার বেশিরভাগই তাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নেয়; যার ফলে প্রান্তিক দেশগুলোর অর্থনৈতিক সম্পদ তাদের স্থানীয় উন্নয়নে সম্পূর্ণভাবে ব্যবহƒত হয় না। উপরন্তু এ করপোরেশনগুলো প্রায়শই স্থানীয় বাজারকে ধ্বংস করে এবং রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রভাব বিস্তার করে, যা প্রান্তিক দেশের সার্বভৌমত্বকে ক্ষুণ্ন করে।
তৃতীয়ত, ঋণ ও আর্থিক নিয়ন্ত্রণ (Debt and Financial Control)। প্রান্তিক দেশগুলো প্রায়ই কেন্দ্র থেকে উচ্চ সুদের হারে ঋণ নেয়, যা তাদের ঋণের ফাঁদে আটকে রাখে। এই ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে তাদের অনেক সময় শিক্ষা, স্বাস্থ্য বা অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ সীমিত করতে হয়। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এবং বিশ্বব্যাংকের মতো আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও প্রায়ই কেন্দ্রের স্বার্থরক্ষা করে এমন নীতি চাপিয়ে দেয়, যা প্রান্তিক দেশগুলোর অর্থনৈতিক স্বাধীনতাকে সীমিত করে।
নির্ভরতা তত্ত্ব বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কাঠামো বিশ্লেষণ করার জন্য খুবই প্রাসঙ্গিক। ঐতিহাসিকভাবে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে থাকার কারণে বাংলাদেশ (তৎকালীন পূর্ব বাংলা) একটি কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছিল, যা কাঁচামাল (যেমন পাট) উৎপাদন করত এবং ব্রিটেনের শিল্পে তা সরবরাহ করত। স্বাধীনতার পরেও এই কাঠামোর প্রতিফলন দেখা যায়।
পোশাকশিল্প ও অসম বাণিজ্য: বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাত হলো পোশাকশিল্প। এই শিল্পটি মূলত বিদেশি ব্র্যান্ডগুলোর চাহিদা ও নকশার ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশ কম মূল্যে পোশাক তৈরি করে, কিন্তু মুনাফার সিংহভাগ বিদেশি ব্র্যান্ডগুলো নিয়ে যায়। এখানকার শ্রমিকরা নামমাত্র মজুরিতে কাজ করে, যার ফলে শ্রমের মাধ্যমে অর্জিত মূল্য দেশের বাইরে চলে যায়। এটি নির্ভরতা তত্ত্বের কাঁচামালভিত্তিক মডেলের একটি আধুনিক রূপ।
ডিজিটাল অর্থনীতি ও গিগ কর্মী (উরমরঃধষ ঊপড়হড়সু ধহফ রেম ডড়ৎশবৎং): ডিজিটাল গিগ অর্থনীতিতে (যেমন ফ্রিল্যান্সিং) বাংলাদেশের তরুণরা কাজ করছে, কিন্তু তারা মূলত বিদেশি প্ল্যাটফর্মের ওপর নির্ভরশীল। প্ল্যাটফর্মের নীতি, অর্থ প্রদানের শর্ত এবং বাজার নিয়ন্ত্রণ বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর হাতে থাকে। ফ্রিল্যান্সাররা তাদের কঠোর পরিশ্রমের জন্য যে অর্থ পায়, তার একটি বড় অংশ প্ল্যাটফর্মের ফি এবং অন্যান্য চার্জ হিসেবে বিদেশি করপোরেশনগুলোর কাছে চলে যায়। এটি এক ধরনের ডিজিটাল নির্ভরতা, যা নতুন এক ধরনের অর্থনৈতিক শৃঙ্খল তৈরি করছে।
জলবায়ু পরিবর্তন ও ঋণনির্ভরতা (Climate Change and Debt-Dependency): জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী প্রধানত শিল্পোন্নত দেশগুলো, কিন্তু এর বিরূপ প্রভাব সবচেয়ে বেশি ভোগ করছে বাংলাদেশের মতো প্রান্তিক দেশগুলো। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট ক্ষতি মোকাবেলায় বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক সহায়তার ওপর নির্ভর করতে হয়, যা প্রায়ই ঋণের বোঝা বাড়ায়। এই ঋণগুলো আবার প্রায়ই শর্তযুক্ত থাকে, যা দেশের অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্বকে প্রভাবিত করে।
যদিও নির্ভরতা তত্ত্ব অনেক উন্নয়নশীল দেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতাকে ব্যাখ্যা করে, এর কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। কিছু সমালোচক যুক্তি দেন যে, এই তত্ত্বটি দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ও সামাজিক সমস্যাকে উপেক্ষা করে। আবার দক্ষিণ কোরিয়া বা তাইওয়ানের মতো কিছু দেশ, যারা একসময় প্রান্তিক অবস্থানে ছিল, তারা নিজেদের শিল্প উন্নত করে কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। এই উদাহরণগুলো নির্ভরতা তত্ত্বের সর্বজনীন প্রয়োগকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
তবে নির্ভরতা তত্ত্ব আমাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দেয়: বিশ্ব অর্থনীতি একটি সমতল ক্ষেত্র নয়। এটি এমন একটি কাঠামো, যেখানে কিছু দেশ ঐতিহাসিকভাবে সুবিধা পেয়েছে এবং অন্য দেশগুলো অসুবিধার শিকার হয়েছে। এই অসমতাকে মোকাবেলা করতে হলে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে কেবল বিশ্ববাজারের সঙ্গে যুক্ত হলেই হবে না, বরং নিজেদের অর্থনীতিকে বহুমুখী করতে হবে, অভ্যন্তরীণ বাজার শক্তিশালী করতে হবে এবং আন্তর্জাতিক ফোরামে ন্যায্য বাণিজ্য ও পরিবেশ নীতির জন্য দরকষাকষি করতে হবে। এই শৃঙ্খল ভাঙার জন্য প্রয়োজন একটি সুদূরপ্রসারী কৌশল, যেমন: কাঠামোগত পরিবর্তন ও বহুমুখীকরণ (Structural Change and Diversification): শুধু কাঁচামাল বা সস্তা শ্রমনির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। উচ্চ প্রযুক্তির শিল্পে বিনিয়োগ, গবেষণা ও উন্নয়নে গুরুত্ব দেয়া এবং নিজস্ব ব্র্যান্ড তৈরি করা জরুরি। এতে উৎপাদিত পণ্যের মূল্য বাড়বে এবং মুনাফা দেশে থাকবে।
আঞ্চলিক সহযোগিতা (Regional Cooperation): প্রান্তিক দেশগুলো নিজেদের মধ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়িয়ে কেন্দ্রের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে পারে। নিজেদের মধ্যে বাণিজ্য, বিনিয়োগ এবং প্রযুক্তি বিনিময় করে তারা একটি শক্তিশালী আঞ্চলিক অর্থনৈতিক ব্লক তৈরি করতে পারে।
গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ ও জবাবদিহি (Democratic Control and Accountability): বহুজাতিক করপোরেশন এবং আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর জনগণের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। স্থানীয় সরকার এবং নাগরিক সমাজের শক্তিশালী অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে, যাতে অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তগুলো জনগণের স্বার্থে নেয়া হয়।
পরিশেষে, নির্ভরতা তত্ত্ব একটি সতর্কবার্তা। এটি আমাদের শেখায় যে, বিশ্ব অর্থনীতিতে আমাদের অবস্থান কেবল আমাদের শ্রম বা সম্পদের ওপর নির্ভরশীল নয়, বরং বৈশ্বিক ক্ষমতার কাঠামোর ওপরও নির্ভরশীল। এই শৃঙ্খল ভাঙার জন্য প্রয়োজন একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, যা কেবল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পেছনে না ছুটে মর্যাদা, ন্যায়বিচার এবং টেকসই উন্নয়নের দিকে মনোযোগ দেবে। এটি একটি দীর্ঘ এবং কঠিন পথ, কিন্তু এই পথে না
হাঁটলে আমরা চিরকাল বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রান্তিক হিসেবেই থেকে যাব।
গবেষক ও উন্নয়নকর্মী