স্বরূপ ভট্টাচার্য, চট্টগ্রাম : জেলে এবং মাছধরার বোট মালিকরা প্রচুর ইলিশ মাছ ধরা পড়ছে বলে জানাচ্ছেন। আড়তে গিয়ে দেখা যায়, বিশাল স্তূপ করে রাখা হচ্ছে ইলিশ মাছ। পত্র-পত্রিকা, টেলিভিশনের খবরেও প্রতিদিন সাগরে ও নদীতে প্রচুর ইলিশ মাছ ধরা পড়ছে বলে জানানো হচ্ছে। অথচ ইলিশ মাছ কিনতে সাধারণ মানুষ বাজারে গিয়ে দেখেন দাম আকাশ ছোঁয়া। শেষে তেলাপিয়া আর পাঙ্গাশ মাছ কিনে ফিরতে হয় অনেককে।
আক্ষেপের সুরে কথাগুলো বলছিলেন চট্টগ্রাম মহানগরীর বাসিন্দা মুসলেহ উদ্দিন। তিনি বিদ্যালয়ের শিক্ষকতা করেন। উচ্চমূল্যের কারণে তার মতো অনেক ক্রেতার পক্ষেই এখন আর ইলিশ মাছ কেনা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানান তিনি।
এদিকে দেশের প্রধান পাইকারি মাছের বাজার চট্টগ্রামের ‘ফিশারি ঘাট জাতীয় মৎস্যজীবী সমিতির নতুনবাজার’-এর পাইকারি মাছ ব্যবসায়ী ও আড়তের (গদি) মালিকরা বলছেন, চাহিদার তুলনায় এবার ইলিশ ধরা পড়ছে কম, তাই খুচরা বাজারে উচ্চমূল্যে ইলিশ বিক্রি হচ্ছে। যদিও আড়তদার ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের এই যুক্তি মানতে পারছেন না সাধারণ বোট মালিক, জেলে, সাধারণ ব্যবসায়ী এমনকি ফিশারি ঘাট নতুন মাছ বাজারের অনেক আড়তদার।
তাদের অভিযোগ, ফিশারিঘাটের একটা সিন্ডিকেট ইলিশের দাম বাড়িয়ে কোটি কোটি টাকা মুনাফা করছে। তাই খুচরা বাজারে ইলিশ মাছ বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।
সাধারণ পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ী এবং ইলিশ মাছ আহরণকারী জেলেদের অভিযোগ, ফিশারি ঘাটের নতুন মাছের বাজারের আড়তদার সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ আলী ও সাধারণ সম্পাদক নুর হোসেনের নেতৃত্বে একটি সিন্ডিকেট ইলিশ মাছের বাজার এবং দর নিয়ন্ত্রণ করে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন।
ব্যবসায়ীরা আরও অভিযোগ করেন, মোহাম্মদ আলী-নুর হোসেন চক্র প্রতিদিন সরাসরি সমুদ্র থেকে আসা বোট এবং কক্সবাজার, বাঁশখালী, সীতাকুণ্ড, পতেঙ্গা থেকে ট্রাকে করে আসা ইলিশ মাছের দর নির্ধারণ করে তাদের মনের মতো। এমনকি বেশি বেলা করে এই সিন্ডিকেটটি দর প্রকাশ করে। এছাড়া বড় চালানের সঙ্গে অন্য ব্যবসায়ীর ছোট চালান এলেও তার দর আলাদাভাবে নির্ধারণ করে। ফলে একদিকে যেমন জেলে এবং বাইরের মাছ ব্যবসায়ীরা ঠকছেন, তেমনি ভোক্তা পর্যায়ে ইলিশ মাছের দাম নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। এই আড়ত থেকে বাড়তি দামে পাইকারি মাছ নিয়ে গিয়ে খুচরা বাজারে বিক্রি করতে হচ্ছে উচ্চ দামে।
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন আড়তদার সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ আলী। সরেজমিন পরিদর্শনে ফিশারি ঘাট মাছের আড়তে গেলে সিন্ডিকেটের বিষয়ে তিনি শেয়ার বিজকে বলেন, মাছ, সবজি, বা অন্য কোনো কাঁচা পণ্যের জন্য কোনো সিন্ডিকেট হয় না। সিন্ডিকেট হয় তেল-চিনি ইত্যাদির ক্ষেত্রে দাম বাড়ানোর জন্য। কিন্তু আমরা কাঁচা মাছের ব্যবসা করি। মাছের দাম বাড়াতে কোনো সিন্ডিকেট কাজ করে না।
তাহলে বাজারে ইলিশের দাম এত বেশি কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে মোহাম্মদ আলী বলেন, সাগরে ইলিশ মাছ কম ধরা পড়ায় মাছের দাম বাড়তি। পাইকারি থেকে খুচরা সব খানে বেশি দামে ইলিশ মাছ বিক্রি করতে হচ্ছে।
আড়তে কী পরিমাণ ইলিশ এসেছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আগে যেখানে শ’খানেক বোটে করে ইলিশ মাছ আসত সেখানে এখন আসছে ১০ থেকে ১২টি বোট।
যদিও শেয়ার বিজের প্রতিবেদক দেখেন ভোর ৫টা থেকে দুপুর ১২টার পর পর্যন্ত মোহাম্মদ আলীর আড়তের সামনে ইলিশের স্তূপ। দুপুর ১২টার পরও ইলিশ মাছ বিক্রি করতে দেখা যায়। মোহাম্মদ আলী ইলিশ নিলামে বিক্রি হয় জানালেও শেয়ার বিজের প্রতিবেদক নিলামে ইলিশ মাছ বিক্রি হতে দেখেনি। এছাড়াও ভোর থেকে বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত প্রায় প্রত্যেকটা আড়তের সামনে ইলিশের স্তূপ এবং দেশ ও জেলার বিভিন্ন স্থানে পাঠানোর জন্য ইলিশ মাছ প্যাকেট করতে দেখা যায়।
সাধারণ আড়তদারদের কাছ থেকে জানা গেছে, মোহাম্মদ আলীর সিন্ডিকেট দেশের বাজারে ইলিশের দাম নিয়ন্ত্রণ করে। দেশের বিভিন্ন জেলায় এমনকি রাজধানীর অভিজাত এলাকা উত্তরায় তার মাছের মোকাম রয়েছে। এসব মোকামগুলো থেকে দেশের সব বড় বাজারগুলোতে ইলিশসহ সব মাছ সরবরাহ করা হয়।
আড়তদার সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ আলী আরও জানান, বুধবার সাইজ ও প্রকারভেদে প্রতি মণ ইলিশ সর্বনিম্ন ১৬ হাজার টাকা থেকে ৭০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে।
এদিকে আড়তদার সমিতির বর্তমান সাধারণ সম্পাদক নুর হোসেনের কাছে ইলিশ মাছের উচ্চ দামের বিষয়ে জানতে গেলে তিনি শেয়ার বিজের সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে উত্তেজিত হয়ে উঠেন। এ সময় জানিয়ে দেন। অবশ্য পরে সংগঠনের সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ আলীর আড়তে তার সামনে মোহাম্মদ আলী শেয়ার বিজের প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলেন।
জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এই নুর হোসেন স্থানীয় বিএনপি নেতা পরিচয়ে রাতারাতি সাধারণ সম্পাদক বনে যান। মোহাম্মদ আলীকে সামনে রেখে এই নুর হোসেন ফিশারি ঘাটে মাছের বাজার নিয়ন্ত্রণ নেন। তাদের সঙ্গে আরও কয়েকজন আড়তদার সিন্ডিকেট করে এবার ইলিশের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন বলে অভিযোগ করেন সাধারণ আড়তদার ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা।
সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা গেছে, ফিশারি ঘাট মাছের আড়তে ২৪৭টি আড়ত ও ব্রোকিং সেন্টার রয়েছে। নিলামের মাধ্যমে বিক্রির কথা বলা হলেও কোথাও নিলামের দৃশ্য দেখা যায়নি। এই ফিশারি ঘাটের আড়তের আওতাধীন ৬৩ হাজার নিবন্ধনকৃত এবং ৪০ হাজার নিবন্ধন ছাড়া বোট রয়েছে। এছাড়া এ বাজারের আড়তদাররা জেলে এবং বোট মালিকদের দাদন দিয়ে থাকে। মাছ নিয়ে এলে সেই মাছ থেকে লাখে ৪ হাজার টাকা আদায় করা হয়। এই দাদনের কথা মোহাম্মদ আলী বললেও বোট মালিকরা অভিযোগ করেন দাদনের বিপরীতে আরও উচ্চ হারে টাকা কাটা হয়। অনেক সময় মাছ নিয়ে এসেও লাভের হিসাবে ক্ষতিটাই জোটে।
উল্লেখ্য, ফিশারি ঘাটের নতুন বাজারটি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ থেকে লিজ নিয়েছে জাতীয় মৎস্যজীবী সমিতি। আর মৎস্যজীবী সমিতি থেকে আড়তদাররা আড়তগুলো লিজ নিয়েছেন।
এদিকে গত বুধবার চট্টগ্রাম মহানগরের রেয়াজউদ্দিন বাজার, কাজীর দেউড়ী কাঁচাবাজার, বহদ্দারহাট মাছের বাজার, কর্ণফুলী মার্কেট, চকবাজারসহ নগরীর বিভিন্ন বাজারে দেড় কেজি ওজনের ইলিশ মাছ ৩ হাজার ২০০ থেকে ৩ হাজার ৫০০ টাকায়, এককেজি ওজনের মাছ ২ হাজার ৪০০ থেকে ২ হাজার ৮০০ টাকায়, ৯০০ থেকে ৮০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ১ হাজার ৮০০ টাকা থেকে ২ হাজার ২০০ টাকায়, ৫০০ থেকে ৬০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৭০০ টাকায় এবং সবচেয়ে ছোট সাইজের মাছ ৬০০ থেকে ৭০০ টাকায় বিক্রি হয়।