নিজস্ব প্রতিবেদক : বাংলাদেশের ব্যাংক খাত দিন দিন জটিল ও প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠছে। নতুন প্রযুক্তি এবং গ্রাহকের ক্রমবর্ধমান প্রত্যাশা—সব মিলিয়ে এখন ব্যাংকগুলোর জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলা। কেবল আর্থিক খাত নয়, সমগ্র অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ও টেকসই প্রবৃদ্ধি এই দক্ষ মানবসম্পদের ওপর নির্ভরশীল।
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্মরত আছেন। কিন্তু তারা কি সবাই যুগোপযোগী দক্ষতায় সমৃদ্ধ? বাস্তবতা হলো এখনো বড় একটি ঘাটতি রয়ে গেছে। বিশেষ করে ডিজিটাল ব্যাংকিং, মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস, সাইবার নিরাপত্তা, এমনকি ব্লকচেইন ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-ভিত্তিক সেবার ক্ষেত্রে অনেক কর্মকর্তা এখনো পর্যাপ্ত দক্ষ নন। অথচ এই খাতগুলোই ভবিষ্যৎ ব্যাংকিংয়ের মূল চালিকাশক্তি।
দেশের একজন জ্যেষ্ঠ ব্যাংক কর্মকর্তার মতে, ব্যাংকিং খাতে যত প্রযুক্তিই আনা হোক না কেন, শেষ পর্যন্ত মানুষের মাধ্যমেই গ্রাহকের কাছে সেবা পৌঁছাবে। সেই মানুষ যদি যথাযথভাবে প্রশিক্ষিত ও আস্থাবান না হন, তাহলে কেবল অত্যাধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে প্রত্যাশিত ফল আসবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো নিয়মিত প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নিলেও চাহিদার তুলনায় তা এখনো সীমিত। ফলে অনেক সময় দক্ষ জনবল অন্য প্রতিষ্ঠান থেকে টেনে আনতে হয়, যা দীর্ঘ মেয়াদে টেকসই সমাধান নয়। অর্থনীতি বিশ্লেষকদের মতে, দক্ষ মানবসম্পদ কেবল নিয়োগের মাধ্যমে পাওয়া যায় না, এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া এবং নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও প্রণোদনার মাধ্যমেই কর্মীরা সর্বোচ্চ দক্ষতা অর্জন করতে পারেন।
গ্রাহকসেবার দিক থেকে দক্ষ মানবসম্পদের গুরুত্ব আরও বেশি। আজকের প্রতিযোগিতামূলক ব্যাংকিং খাতে একজন গ্রাহককে যথাযথ সেবা দিতে শুধু লেনদেন সম্পন্ন করাই যথেষ্ট নয়, তাকে আস্থা, স্বচ্ছতা ও দ্রুততার সঙ্গে সেবা দিতে হবে। এ জন্য ব্যাংক কর্মকর্তাদের প্রয়োজন যোগাযোগ দক্ষতা, ইতিবাচক মানসিকতা এবং প্রযুক্তিগত জ্ঞান। পরিসংখ্যান বলছে, প্রশিক্ষিত ব্যাংক কর্মকর্তারা জটিল পরিস্থিতিতেও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে গ্রাহককে সন্তোষজনক সেবা দিতে সক্ষম হন।
বিশ্ববিদ্যালয় ও ব্যাংকিং খাতের মধ্যে এখনো পর্যাপ্ত সমন্বয় নেই। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাওয়া তাত্ত্বিক জ্ঞান বাস্তব ব্যাংকিং কার্যক্রমে পুরোপুরি কার্যকর হয় না। যৌথ প্রশিক্ষণ, ইন্টার্নশিপ ও গবেষণামূলক কার্যক্রম বাড়ালে এই দূরত্ব পূরণ সম্ভব। একইভাবে নারীদের অংশগ্রহণ ও নেতৃত্ব বিকাশেও গুরুত্ব দিতে হবে। দক্ষ নারী কর্মকর্তারা শুধু বৈচিত্র্যই আনবেন না, বরং ব্যাংকিং খাতকে আরও গ্রাহকবান্ধব ও আধুনিক করে তুলবেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ব্যাংকিং খাতে কর্মীর সংখ্যা প্রায় ৩ দশমিক ৯ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৩ হাজার ৬৯৬ জনে। এর মধ্যে নারীর অংশগ্রহণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৭ দশমিক ৬ শতাংশ, যা আগের বছরের তুলনায় উল্লেখযোগ্য উন্নতি। বিশেষ করে গত এক বছরে নারী কর্মীর সংখ্যা প্রায় ১২ দশমিক ৯ শতাংশ বেড়েছে। কর্মসংস্থান বৃদ্ধি ইতিবাচক হলেও বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সংখ্যার পাশাপাশি মান নিশ্চিত করাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ।
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত গত দুই দশকে দ্রুত সমপ্রসারিত হয়েছে। বর্তমানে দেশে ৬১টি বাণিজ্যিক ব্যাংক পরিচালিত হচ্ছে এবং শাখার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ১১ হাজারেরও বেশি। একই সঙ্গে মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসে সক্রিয় অ্যাকাউন্ট এখন প্রায় ২০ কোটির কাছাকাছি। এত বড় নেটওয়ার্ক পরিচালনায় দক্ষ মানবসম্পদের প্রয়োজনীয়তা বোঝাই যাচ্ছে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার এবং গ্রাহকসেবা উন্নত করার জন্য কর্মীদের যথাযথ প্রশিক্ষণ দেয়া হয় না। ফলে শাখা বাড়লেও সেবার মান প্রত্যাশিত পর্যায়ে পৌঁছাতে সময় নিচ্ছে।
এই বাস্তবতায় কিছু ইতিবাচক উদাহরণও রয়েছে। দেশের বেসরকারি খাতের প্রথম আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইপিডিসি ফাইন্যান্স পিএলসি দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নে বিশেষভাবে কাজ করছে। বর্তমানে তাদের প্রায় ৮৫০ কর্মী নিয়োজিত রয়েছেন। প্রতিষ্ঠানটি মনে করে, দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিই ভবিষ্যৎ ব্যাংকিং খাতের মূল শক্তি। এ কারণে শুধু কর্মী নিয়োগেই সীমাবদ্ধ না থেকে আইপিডিসি তাদের প্রশিক্ষণ, দক্ষতা উন্নয়ন এবং কর্মপরিবেশ আধুনিকায়নে ধারাবাহিক বিনিয়োগ করছে।
আইপিডিসি’র প্রধান মানবসম্পদ কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা সব কর্মীকে সম্পদ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য চাহিদাভিত্তিক প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি। আমরা একজন কর্মীকে যুগোপযোগী করে গড়ে তোলার জন্য কর্মস্থলে অবিচ্ছিন্ন শেখার পরিবেশ তৈরির চেষ্টা করি। আমাদের উদ্দেশ্য, প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং সব নিয়ম-নীতি অনুসরণ করে গ্রাহকসেবার মান উন্নত রাখা। পাশাপাশি আমরা নারীর নিয়োগ ও ক্ষমতায়নে প্রাধান্য দিয়ে থাকি। আমাদের মানবসম্পদের ২৩ শতাংশ নারী কর্মী, যা ব্যাংকিং খাতে অন্যতম সর্বোচ্চ। আমরা বিশ্বাস করি, একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক কর্মপরিবেশ ও দক্ষ মানবসম্পদ ব্যাংকিং খাতকে শুধু শক্তিশালীই করবে না, বরং দেশের অর্থনীতিকেও এগিয়ে নিয়ে যাবে।’
অন্যদিকে, ব্যাংকিং খাতে অটোমেশন ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার দ্রুত বাড়ছে। ভবিষ্যতে অনেক রুটিন কাজ যন্ত্রের মাধ্যমে সম্পন্ন হবে। তবে গ্রাহকসেবা, ঝুঁকি মূল্যায়ন ও নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে মানবসম্পদের ভূমিকা অপরিবর্তনীয় থাকবে। তাই এখনই কর্মীদের নতুন প্রযুক্তি ও তথ্য বিশ্লেষণের প্রশিক্ষণ দেওয়া জরুরি। একই সঙ্গে নিয়ন্ত্রক সংস্থার উচিত হবে দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নে একটি দীর্ঘমেয়াদি নীতি গ্রহণ করা।
দক্ষ মানবসম্পদ ছাড়া ব্যাংকিং খাতের টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। এই দক্ষতা অর্জন শুধু একটি ব্যাংকের নয়, বরং দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য অপরিহার্য। এখনই সময়
মানবসম্পদ উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিয়ে দেশের ব্যাংকিং খাতের ভবিষ্যৎ রূপরেখা তৈরি করার।
প্রিন্ট করুন








Discussion about this post