রামিসা রহমান : বাংলাদেশে নারীরা এখন অনেক ক্ষেত্রে এগিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে, কলেজের করিডোরে কিংবা স্কুলের পরীক্ষার ফলাফলে মেয়েদের সাফল্য চোখে পড়ার মতো। তারা মেধায়, সততায়, শৃঙ্খলায় এবং মননশীলতায় সমাজের গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করছে। সংসার পরিচালনার ক্ষেত্রেও তাদের দক্ষতার তুলনা মেলে না। কিন্তু কর্মক্ষেত্রের বাস্তবতায় বিশেষ করে ব্যাংকিং সেক্টরে এসে দেখা যায়, ছবিটা ভিন্ন। সেখানে শীর্ষ পর্যায়ের চেয়ারে নারীকে দেখা যায় না বললেই চলে।
এন্ট্রি লেভেলে নারীদের উপস্থিতি অস্বীকার করার উপায় নেই। নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের মধ্যে অর্ধেক কিংবা তারও বেশি নারী। ব্যাংকের শাখাগুলোতে গেলে দেখা যায়, অনেক নারী ক্যাশ কাউন্টারে, কাস্টমার সার্ভিস ডেস্কে কিংবা অফিসার লেভেলে কাজ করছেন। মাঝারি পর্যায়ের কর্মকর্তা হিসেবেও তাদের উপস্থিতি দৃশ্যমান। কিন্তু যখন দৃষ্টি তোলা হয় শীর্ষ পর্যায়ে- ম্যানেজিং ডিরেক্টর, সিইও বা পরিচালক পর্যায়ে সেখানে নারী যেন হঠাৎ করেই অদৃশ্য হয়ে যান।
আমার এক আত্মীয়া একবার আক্ষেপ করে বলেছিলেন, নারীরা সংসারের হেড হতে পারে, পরিবার চালাতে পারে, জটিল সব হিসাব সামলাতে পারে, সেখানে অফিস চালাতে পারবে না কেন? তার কথার ভেতরে লুকিয়ে আছে আসল প্রশ্ন। আমরা সমাজ হিসেবে নারীর নেতৃত্বকে স্বাভাবিকভাবে নিতে শিখিনি। নারীর স্থান আমরা দেখি সংসারের ভেতরে, কিন্তু অফিসের শীর্ষ চেয়ারে তাকে কল্পনা করার অভ্যাস এখনও তৈরি হয়নি।
বাংলাদেশে টপ ম্যানেজমেন্টে নারী নেই কেন—এ নিয়ে নানা ব্যাখ্যা আছে। কেউ বলেন, নারীরা সন্তান, স্বামী আর সংসার নিয়ে এতটাই ব্যস্ত যে বড় দায়িত্ব নিতে পারে না। কেউ বলেন, তারা ঝামেলা পছন্দ করেন না, নির্ঝঞ্ঝাট জীবন তাদের কাছে বেশি মূল্যবান। আবার অনেকে মনে করেন, নারীরা এতটাই স্বামী নির্ভর যে ক্যারিয়ারের বড় সিদ্ধান্ত নেয়ার মতো মানসিকতা তাদের মধ্যে তৈরি হয় না।
কিন্তু সত্যিই কি এটাই আসল কারণ? বাস্তবে তো দেখা যায়, নারীরা সংসার চালাতে গিয়ে প্রতিদিনই জটিলতা সামলান। বাজেট মিলিয়ে চলা, সন্তান লালন-পালন, আত্মীয়স্বজনের চাহিদা— সবকিছু তারা সামলান নিপুণভাবে। যিনি প্রতিদিন সংসারের হাজারো সংকটের সমাধান করতে পারেন, তিনি অফিসের চ্যালেঞ্জ সামলাতে পারবেন না— এই ধারণা আসলে এক ধরনের সামাজিক মানসিকতা।
সমস্যা কেবল নারীর ভেতরে নয়, সমস্যা আরও বেশি আমাদের পুরুষদের ভেতরে। আমরা নারীদের নেতৃত্বে দেখতে অভ্যস্ত নই। নারীর নাম এলেই আমাদের মনে হয়, তিনি কোনো শোভাময় পজিশনে থাকবেন। হয়তো হেড অব পিআর, কোম্পানি সচিব অথবা সর্বোচ্চ ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর। কিন্তু সিইও? সেখানে যেন নারীর উপস্থিতি এক ধরনের ব্যতিক্রম।
এই মানসিকতা শুধু অফিসে নয়, সমাজের সব জায়গায় কাজ করে। ফলে নারীরা নিজেরাও অনেক সময় মাঝপথে থেমে যান। অনেকে ভেবে নেন, বিয়ে, সংসার, সন্তানই তাদের জীবনের মূল অধ্যায়। ক্যারিয়ার নিয়ে বড় স্বপ্ন দেখাও যেন বাড়াবাড়ি। এর সঙ্গে যুক্ত হয় কর্মক্ষেত্রের প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতা।
বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোতে নারীদের শীর্ষ পর্যায়ে যেতে বাধা দেয় এমন অনেক কাঠামোগত সমস্যা আছে। অনেক প্রতিষ্ঠানে এখনও ডে কেয়ার সুবিধা নেই। অফিসে দীর্ঘ সময় কাটানো মানেই সন্তান লালন-পালনে সমস্যা। মাতৃত্বকালীন ছুটি থাকলেও তা যথেষ্ট নয়। পিতৃত্বকালীন ছুটি কার্যত নেই বললেই চলে। ফলে সন্তান জন্মের পর পুরো দায়ভার পড়ে মায়ের ওপর, ফলে ক্যারিয়ারের গতি কমে যায়।
এছাড়া ফ্লেক্সিবল ওয়ার্ক আওয়ারের অভাবও বড় প্রতিবন্ধকতা। অনেক নারী মাঝপথে চাকরি ছেড়ে দেন শুধু সময়ের সীমাবদ্ধতার কারণে। প্রতিষ্ঠানগুলো যদি সত্যিই নারী নেতৃত্ব গড়তে চাইত, তবে তারা নীতিগত পরিবর্তন আনত কিন্তু বাস্তবে সে উদ্যোগ খুব সীমিত।
নারী নির্বাহীরা নেতৃত্বে উঠতে গেলে যেসব মেন্টরশিপ বা গাইডলাইন প্রয়োজন, তা-ও নেই। সিনিয়র নির্বাহীরা সাধারণত পুরুষ এবং তারা অবচেতনে পুরুষ সহকর্মীদেরই এগিয়ে দেন। ফলে নারী নির্বাহীরা নেতৃত্বের পথে এক ধরনের একাকিত্বে ভোগেন।
বাংলাদেশের বাস্তবতার সঙ্গে যদি বৈশ্বিক পরিস্থিতি মিলিয়ে দেখা যায়, পার্থক্য চোখে পড়ে। আমেরিকার সিটি গ্রুপ কয়েক বছর আগে তাদের সিইও করেছিল জেন ফ্রেজারকে ইতিহাসে প্রথম কোনো নারী একজন বড় আমেরিকান ব্যাংকের প্রধান হলেন। তিনি সংকটকালীন দায়িত্ব নিয়েছিলেন এবং ব্যাংককে স্থিতিশীল করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
লন্ডনের এইচএসবিসি বহু বছর ধরেই নারী নির্বাহীদের নেতৃত্বে আনার চেষ্টা করছে। তাদের নীতিগত উদ্যোগের কারণে অনেক নারী এখন টপ ম্যানেজমেন্টে জায়গা পাচ্ছেন। সিঙ্গাপুরের ডিবিএস ব্যাংক তো নারীদের নেতৃত্ব উন্নয়নে আদর্শ উদাহরণ। সেখানে নারী নির্বাহীরা শুধু শীর্ষ পদে আসছেন না, বরং নীতিনির্ধারণী বোর্ডেও কার্যকর ভূমিকা রাখছেন। এই উদাহরণগুলো প্রমাণ করে যে নারী যদি সুযোগ পান, তবে তারা নেতৃত্বে পিছিয়ে থাকেন না। বরং তাদের সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ, সততা এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার কারণে তারা অনেক সময় পুরুষদের চেয়ে কার্যকর নেতৃত্ব দিতে পারেন।
বাংলাদেশে এমন উদাহরণ খুব সীমিত। কয়েকজন নারী নির্বাহী আছেন যারা এমডি বা ডিএমডি পর্যন্ত উঠেছেন, কিন্তু তাদের সংখ্যা এত কম যে তাকে ব্যতিক্রম বলেই ধরা হয়। নিয়মে পরিণত হয়নি এখনও।
ভবিষ্যতের জন্য আমাদের কী প্রয়োজন? সবচেয়ে আগে দরকার সমাজের মানসিকতার পরিবর্তন। নারী মানেই কেবল শোভা নয়— এটা আমাদের মেনে নিতে হবে। তিনি নেতৃত্ব দিতে পারেন, তিনি বড় দায়িত্ব সামলাতে পারেন। এই দৃষ্টিভঙ্গি পরিবার থেকে শুরু করে প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত সব জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হওয়া জরুরি।
প্রতিষ্ঠানগুলোকেও নীতিগত পরিবর্তন আনতে হবে। ডে কেয়ার, ফ্লেক্সিবল আওয়ার, মাতৃত্বকালীন ও পিতৃত্বকালীন ছুটি— এসব সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। নারী কর্মকর্তাদের নেতৃত্বে আনতে বিশেষ মেন্টরশিপ প্রোগ্রাম চালু করতে হবে।
সবচেয়ে বড় পরিবর্তন আসতে হবে টপ ম্যানেজমেন্টের ভেতরে। বোর্ড অব ডিরেক্টররা যদি সচেতনভাবে নারী নেতৃত্ব গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয়, তবে আগামী ১০ বছরে বাংলাদেশে অনেক নারী সিইও তৈরি হতে পারেন।
আমার সেই আত্মীয়ার আক্ষেপ হয়তো তখন বাস্তবে রূপ নেবে। তিনি গর্ব করে বলতে পারবেন— নারীরা শুধু সংসারের হেড নয়, অফিসের হেডও হতে পারে। আসলে তারা সেই সক্ষমতাই দীর্ঘদিন ধরে প্রমাণ করে আসছে, শুধু সমাজ ও প্রতিষ্ঠান এখনও সেই সত্যিটা স্বীকার করতে প্রস্তুত হয়নি।
একদিন হয়তো আমরা দেখব, ঢাকার বড় কোনো ব্যাংকের বোর্ড মিটিংয়ে সিইও হিসেবে বসে আছেন একজন নারী। তার চারপাশে পুরুষ সহকর্মীরা মনোযোগ দিয়ে তার বক্তব্য শুনছেন। তখন আর কেউ বলবে না, ‘নারী নেতৃত্ব মানে ব্যতিক্রম। বরং তখন সেটিই হবে নিয়ম।

Discussion about this post