নিজস্ব প্রতিবেদক : ব্যাংকের প্রকৃত খেলাপি ঋণ ৯৬ শতাংশ বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। একই সঙ্গে তিনি বলেন, বাংলাদেশের বেশিরভাগ ব্যাংকের অডিট প্রতিবেদনে বাস্তবতার সঙ্গে সংগতিহীন ও ভুয়া তথ্য রয়েছে। রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁওয়ে অনুষ্ঠিত ‘অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টিং সামিট, ২০২৫’-এ প্রধান অতিথির বক্তব্যে গতকাল বুধবার এসব কথা বলেন গভর্নর।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, “বেশিরভাগ ব্যাংকের অডিট রিপোর্টে ‘ফিকশন’ পাওয়া গেছে। একটি ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়- তাদের খেলাপি ঋণ চার শতাংশ। কিন্তু আমরা নিজেরা অডিট করে দেখেছি আসলে তা ৯৬ শতাংশ।”
গভর্নর বলেন, ‘দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জন করতে হলে অডিট রিপোর্টে শতভাগ স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। আর্থিক প্রতিবেদন যেন বাস্তব পরিস্থিতির যথাযথ প্রতিফলন করে, সেটিই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।’
তিনি আরও জানান, এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশ ব্যাংক এবং ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিল (এফআরসি) যৌথভাবে কাজ করবে।
সামিটে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন এফআরসির চেয়ারম্যান ড. সাজ্জাদ হোসেন ভূঁইয়া। অনুষ্ঠানে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান মো. আব্দুল মোমেন বলেন, ‘বর্তমানে যদি অডিট রিপোর্টের ভিত্তিতে বিচার করি, তাহলে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ অডিটর খুঁজে পাওয়া কঠিন। অডিট ফার্মগুলো আর্থিক কেলেঙ্কারি আড়াল করতে সহায়তা করেছে।’
তিনি উদাহরণ টেনে বলেন, ‘সালমান এফ রহমান এক অডিটরের সহায়তায় একটি পেপার কোম্পানির আর্থিক অবস্থাকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে উপস্থাপন করে ব্যাংক থেকে অর্থ নিয়েছেন। আইএফআইসি ব্যাংকেও প্রচুর কেলেঙ্কারি হয়েছে।’
দুদক চেয়ারম্যান আরও জানান, বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে কয়েকটি শীর্ষ অডিট ফার্মকে চিহ্নিত করেছে, যারা আর্থিক অনিয়মে জড়িত ছিল। তবে তাদের বিরুদ্ধে এখনও দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি, যা উদ্বেগজনক।
এর আগে গত সোমবার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছিলেন, ব্যাংক খাতের তদারকিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ২০২৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে চালু হচ্ছে ঝুঁকিভিত্তিক তদারকি ব্যবস্থা (রিস্ক-বেইজড সুপারভিশনÑআরবিএস)। এতে তদারকি হবে আরও আধুনিক, কার্যকর ও তথ্যভিত্তিক। তবে রাজনৈতিক গুণগত পরিবর্তন, হস্তক্ষেপ বন্ধ না হলে কোনো নীতিমালাই কাজে আসবে না।
গভর্নর বলেন, এরই মধ্যে ২০টি ব্যাংকের সঙ্গে পাইলট কার্যক্রম শেষ হয়েছে। আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ৬১টি ব্যাংকের রিস্ক-বেইজড সুপারভিশন চালু হবে। ১২ ভাগে বিভক্ত ১২টি কমিটি গঠন করা হবে, যারা ব্যাংকের সব দিক থেকে অর্থাৎ ৩৬০ ডিগ্রি সুপারভিশন করবে। আমরা একটি শক্তিশালী ব্যাংক খাত গঠনের চেষ্টা করছি, তবে সেজন্য রাজনৈতিক গুণগত পরিবর্তন খুবই প্রয়োজন। আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, যাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাজে হস্তক্ষেপ না করা হয়। সংস্থাটিকে নিজের মতো চলতে দেওয়া হয়।
ইসলামি ধারার দুর্বল কয়েকটি ব্যাংক একীভূত করার বিষয়ে গভর্নর বলেন, আমরা ছয়টি ব্যাংকের সঙ্গেই আলাদা আলাদাভাবে আবারও বৈঠক করব। যদি তারা সংগত কারণ দেখাতে পারে, তাহলে মার্জ বা একীভূত হবে না। আমাদের জানামতে, ছয়টি ব্যাংকই ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। সেজন্য তাদের মার্জের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
দুর্দশাগ্রস্ত ব্যাংকের বোর্ড পুনর্গঠন সম্পর্কে তিনি তখন জানান, বোর্ড পুনর্গঠনের পর কিছু ব্যাংক খুবই ভালো করছে। তবে যারা পারফরম্যান্স দেখাতে পারছে না, প্রয়োজনে এসব ব্যাংকের বোর্ড আবার পুনর্গঠন করা হবে। এরই মধ্যে আমরা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে চিঠি দিয়েছিÑকেন তাদের বন্ধ করা হবে না তার উত্তর দেয়ার জন্য। তারা যদি যৌক্তিক কারণ দেখাতে পারে এবং সরকার সম্মত হয়, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কোনো কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে না বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে আমার ধারণা, কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে, ঝুঁকিনির্ভর তদারকি কাঠামোর আওতায় প্রতিটি ব্যাংকের আর্থিক, বাজার, পরিচালনাগত, আইনগত ও কৌশলগত ঝুঁকি চিহ্নিত করা হবে আরও নিখুঁতভাবে। সেই অনুযায়ী ব্যবস্থাও নেয়া হবে। এতে করে প্রতিটি ব্যাংকের কার্যক্রম আলাদাভাবে মূল্যায়ন করা এবং ঝুঁকিপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোতে দ্রুত হস্তক্ষেপ করা সম্ভব হবে।
তথ্যভিত্তিক তদারকি নিশ্চিত করতে তৈরি করা হচ্ছে নতুন তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ পদ্ধতি। একটি কেন্দ্রীয় তদারকি তথ্য প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলা হচ্ছে, যাতে সহজেই যেকোনো ব্যাংকের ঝুঁকিচিত্র বিশ্লেষণ করে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেয়া যায়। একইসঙ্গে আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা আরও সুসংহত হবে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ভিত্তি আরও মজবুত হবে।
বিশ্লেষকদের মতে, ব্যাংকিং খাতে দীর্ঘদিন ধরে চলমান অব্যবস্থাপনা, অডিট ফার্মগুলোর অসততা এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকির ঘাটতি মিলিয়ে একটি গভীর সংকট তৈরি হয়েছে। খেলাপি ঋণ, স্বার্থসংশ্লিষ্ট লেনদেন, ‘লোন রিসাইক্লিং’, এবং আর্থিক প্রতিবেদন বিকৃতির মাধ্যমে গোটা অর্থনীতি ঝুঁকিতে পড়ছে।
দেশের ব্যাংক খাতকে ঘিরে শৃঙ্খলা ফেরাতে শুধু নিয়মনীতি করলেই হবে না, কার্যকর মনিটরিং এবং দায়ীদের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ জরুরি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বোচ্চ কর্মকর্তার এমন প্রকাশ্য মন্তব্য ব্যাংকিং ব্যবস্থার ভেতরকার দুর্বলতা উšে§াচন করেছে। এখন দেখার বিষয়, এই স্বীকারোক্তির পর ব্যবস্থা কতটা দৃশ্যমান হয়।

Discussion about this post