নিজস্ব প্রতিবেদক : দেশের ব্যাংক খাতের পুনর্গঠনের জন্য ৩৫ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, ‘আগে আইএমএফ (আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল) ধারণা দিয়েছিল ১৮ বিলিয়ন ডলার লাগবে, এখন তার পরিমাণ দু’গুণের বেশি বলে উল্লেখ করছে।’
রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে গতকাল শনিবার আয়োজিত ‘অর্থনীতি, শাসন ও ক্ষমতা: যাপিত জীবনের আলেখ্য’ বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন। বইটির লেখক ও অনুষ্ঠানের সভাপতি ছিলেন ড. হোসেন জিল্লুর রহমান।
অনুষ্ঠানে ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘গত বছরের আগস্টে যখন নতুন সরকার দায়িত্ব নেয়, তখন দেখা গেছে এ রকম অর্থনৈতিক বিপর্যয় বিশ্বের কোথাও নেই। ব্যাংক খাতের ৮০ শতাংশ অর্থ লোপাট হয়েছে। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, কোনো ব্যাংকের আউটস্ট্যান্ডিং (বকেয়া) যদি ২০ হাজার কোটি টাকা হয়, তবে এর মধ্যে ১৬ হাজার কোটি টাকাই বেরিয়ে গেছে।’
প্রসঙ্গত; বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাংক খাত থেকে দুই লাখ কোটি টাকার বেশি অর্থ ঋণের নামে লোপাট করে কয়েকটি প্রভাবশালী ব্যবসায়ী গোষ্ঠী। তবে সেসময় সেই তথ্যগুলো লুকিয়ে রাখা হতো। গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সরকার পতনের পর ব্যাংক খাতের লুটপাটের প্রকৃত তথ্য বের হতে থাকে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে প্রায় ১১টি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে পুনর্গঠন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। কয়েকটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনায়ও পরিবর্তন আনা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন করে, তখন ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। গত বছরের আগস্টে সরকার পতনের আগে জুন শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। সর্বশেষ গত মার্চ শেষে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ নতুন সরকার গঠনের পর লুটপাট করা ঋণগুলো খেলাপি করায় মোট খেলাপি ঋণ দ্বিগুণ হয়ে যায়। তিনি বলেন, ‘ভালো প্রতিষ্ঠান এখন আর নেই বললেই চলে। শুধু আইনের ব্যত্যয় হয়নি, পুরো প্রক্রিয়াটাই ধ্বংস করা হয়েছে। আর যারা এসব ঘটিয়েছেন, তারা এখনও বহাল তবিয়তে আছেন। পরিবর্তন হয়নি। অনেকে বলেন, সবকিছু বাদ দিয়ে দাও। কিন্তু সেটি সম্ভব নয়। এখন মাথায় হাত বুলিয়ে আর ধমক দিয়ে কাজ করাতে হচ্ছে।’
ড. সালেহউদ্দিন বলেন, ‘সুশাসন প্রতিষ্ঠা খুব কঠিন। আমাদের সাবেক প্রধানমন্ত্রীরও কোনো কার্যকর চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স ছিল না। সংসদ সদস্যদেরও তেমন জবাবদিহি নেই। এসব না বদলালে যত সংস্কারই করা হোক, তেমন ফল পাওয়া যাবে না। শুধু সরকারি প্রতিষ্ঠান নয়, রাজনৈতিক দলগুলোয়ও সংস্কার দরকার।’
অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ‘ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে থাকা দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করা সহজ নয়, ভবিষ্যতের জন্যও এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ।’
এ সময় তিনি কর-জিডিপি অনুপাত বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, ‘বাংলাদেশে এটি এখনও ৭ দশমিক ৫ শতাংশ, যেখানে নরওয়ে ও সুইডেনে এই হার অনেক বেশি।’
এলডিসি থেকে উত্তরণ প্রসঙ্গে সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা দীর্ঘদিন ধরে এর বিরোধিতা করে আসছেন, কিন্তু আমাদের প্রস্তুত হওয়া দরকার।’
অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘কোথাও কোনো সুশাসন নেই, নিয়ন্ত্রণ নেই। পুলিশে কোনো পরিবর্তন হয়নি।
তিনি আরও বলেন, ‘স্বৈরাচার পতনের পরে দেশে দুর্নীতির পরিমাণ বেড়েছে। গতকাল একজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বললাম। তিনি বলছিলেন, আগে ঘুষ দিতে হতো এক লাখ টাকা, এখন দিতে হয় পাঁচ লাখ টাকা।’
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান ছাড়াও অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন, অধ্যাপক আবু আহমেদ, গবেষক খন্দকার সাখাওয়াত আলী, ভূঁইয়া আসাদুজ্জামান এবং এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মো. আবদুল মজিদ, গবেষক আলতাফ পারভেজ প্রমুখ।
বইয়ের লেখক ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ‘অর্থনীতি, শাসন এবং ক্ষমতা এই তিনটি বিষয়ের মধ্যে সমন্বয় না ঘটলে কাক্সিক্ষত উন্নয়ন সম্ভব নয়।’
অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ বলেন, রাজনীতিবিদ এবং সংশ্লিষ্টরা যদি বছরের পর বছর ধরে সৃষ্ট বৈষম্য দূর করার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ না নেন, তাহলে দেশ আরও বড় বিপর্যয়ের মুখোমুখি হবে।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘বিগত সরকারের সময় প্রতিযোগিতামূলক রাজনীতির অভাবে দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয়ে গেছে।
বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের সভাপতি এম হুমায়ুন কবির বলেন, ‘গণতান্ত্রিক চর্চা অব্যাহত রাখতে হবে, সেটাই দেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।’

Print Date & Time : 27 July 2025 Sunday 5:49 pm
ব্যাংক খাত পুনর্গঠনে দরকার ৩৫ বিলিয়ন ডলার
অর্থ ও বাণিজ্য,পত্রিকা,প্রথম পাতা,শীর্ষ খবর ♦ প্রকাশ: