Print Date & Time : 21 July 2025 Monday 2:14 pm

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের কল্যাণে মেরুল-বাড্ডার বাসাভাড়া দ্বিগুণ

রোদেলা রহমান: রাজধানীর মেরুল বাড্ডা একসময় ছিল নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের অন্যতম আবাসস্থল। কিন্তু গত দুই বছরে বেসরকারি ব্র্যাক বিশ্বব্যিালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাস গড়ে ওঠার পর পাল্টে গেছে পুরো এলাকার চিত্র। ধনী পরিবারের শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশে থাকতে শুরু করায় এলাকাটি দ্রুত সময়ে ব্যয়বহুল হয়ে উঠেছে। বাসাভাড়া বেড়েছে দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ পর্যন্ত।

কেবল মেরুল বাড্ডা নয়, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের চালুর পর এর প্রভাব পড়েছে আশপাশের এলাকার ওপরও। যেমন- মধ্যবাড্ডা, উত্তরবাড্ডা, শাহজাদপুর ও সাঁতারকুল এলাকাগুলোর বাসাভাড়া বেড়ে যাওয়ায় সেখানে আগে থেকে বসবাসরত নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারগুলো তুলনামূলক সস্তা এলাকায় চলে যেতে শুরু করেছে।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাসের আশপাশের বাসিন্দারা বলছেন, দেশের অন্যতম শীর্ষ এই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের পছন্দের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। প্রায় দু ’বছর হলো মেরুল বাড্ডায় নতুন ক্যাম্পাস স্থানান্তর হয়েছে। বিশ্বব্যিালয়ের শিক্ষা ও সুযোগ-সুবিধা যেমন উন্নতমানের, তেমনি এতে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীরে বড় অংশই বিলাসী জীবনযাপনে অভ্যস্ত। ফলে বিশ্বব্যিালয়ের আশপাশের বাসস্থানগুলো তাদের চাহিদা অনুযায়ী নতুন রূপ নিতে শুরু করে।

বাড়িওয়ালারা একদিকে বড় অঙ্কের ভাড়ার আশায় শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরে টার্গেট করতে থাকেন, অন্যদিকে স্থানীয় নিম্নআয়ের পরিবারগুলোর জন্য অবস্থান বজায় রাখা ক্রমে অসম্ভব হয়ে যায়। ওই এলাকার অলিগলিতে গজিয়ে উঠতে শুরু করে জাঁকজমক রেস্টুরেন্ট ও বিপণিবিতান। ফলে বাড়িওয়ালাদের আয় বৃদ্ধির সুযোগ হয়।

গত ১২ বছর ধরে মেরুল বাড্ডার একটি ভাড়া বাসায় বেসরকারি চাকরিজীবী আবুল হোসেন। বর্তমানে বাসা ভাড়া বেশি বেড়ে যাওয়ায় পরিবারসহ মিরপুরে চলে গেছেন। কারণ হিসেবে তিনি শেয়ার বিজকে বলেন, আগে ভাড়া দিতাম ১৫ হাজার টাকা। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাস স্থানান্তর হওয়ার পর বাড়িওয়ালা জানালেন, এখন থেকে ৩০ হাজার টাকা দিতে হবে।

তিনি আরও বললেন, ছাত্ররা একসঙ্গে পাঁচ থেকে ছয়জন বা কখনও আরও বেশি শির্ক্ষাী এক সঙ্গে াকে। ফলে তারা ভাড়া শেয়ার করে দেয়। তাদের তেমন কষ্ট হয় না। আমি তো ছাত্র না, একটা পরিবার চালাই। আমার একার পক্ষে এত ভাড়া দেয়া সম্ভব নয়। অবশ্য বাড়িওয়ালা আগের বাড়িটিতে টাইলস লাগিয়ে আগের থেকে আরও বেশি চাকচিক্যময় করে তুলেছেন বলে জানা আবুল হোসেন।

তবে কেবল আবুল হোসেনই নন, এমন অসংখ্য পরিবার ইতোমধ্যে অন্যত্র চলে গেছে। গত এক বছরে অন্তত ৩৫ শতাংশ পরিবার মেরুল বাড্ডা ত্যাগ করেছে বলে জানিয়েছে স্থানীয় এক রিয়েল এস্টেট এজেন্ট।

বাড়িওয়ালারে বক্তব্য অবশ্য একেবারে উল্টো। ওই এলাকার একটি বাড়ির মালিক রোজিনা খাতুন। নিজ বাসার কয়েকটি ইউনিট ভাড়া দিয়েছেন। তিনি শেয়ার বিজকে বলেন, ‘ছাত্রছাত্রীরা এখন আরাম আয়েশ চায়। তারা বলে ফার্নিশড ঘর লাগবে, ওয়াই-ফাই লাগবে, ওয়াশিং মেশিন লাগবে। আমরা যদি এত সুবিধা দিয়ে ভাড়া না বাড়াই, তাহলে আমরা বাড়তি খরচ কেন করব। বাড়ি করার সময় ব্যাংক ঋণ নিয়েছি। কিস্তি দিতে হয়।’

মেরুল বাড্ডা এলাকা ঘুরে খো যায়, চারদিকে নতুন নতুন অ্যাপার্টমেন্ট ভবন গড়ে উঠছে। যেখানে প্রতি ইউনিটে চার-পাঁচজন শিক্ষার্থী মেস করে থাকছেন। গড়ে জনপ্রতি মাসে ৭ থেকে ১০ হাজার টাকা ভাড়া দিচ্ছেন। বাড়িওয়ালারাও তাই পরিবার নয়, ছাত্ররে ভাড়া বাসা ভাড়া দিতে আগ্রহী হয়ে দেখাচ্ছেন।

তবে এ পরিবর্তন শুধুমাত্র মেরুল বাড্ডার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। প্রভাব পড়েছে আশপাশের এলাকাতেও। উত্তর বাড্ডা, মধ্য বাড্ডা, শাহজাদপুর এমনকি সাঁতারকুল পর্যন্ত। এসব এলাকাতেও হঠাৎ করেই বাড়ি ভাড়ায় অস্বাভাবিক বেড়ে যেতে দেখা গেছে।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের মাঝেও মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। কেউ কেউ সুবিধা পাচ্ছেন, কারণ ক্যাম্পাসের পাশে থাকার ফলে সময় বাঁচে, যাতায়াতের ঝামেলা নেই। আবার কেউ কেউ বলছেন, ভাড়া এত বেশি যে অভিভাবকদের ওপর চাপ
বাড়ছে।

ব্র্যাকের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আনিকা রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, ভার্সিটির কাছে বাসা পাওয়ায় শুরুতে ভালো লাগছিল। কিন্তু এখন প্রতি মাসে বাড়িওয়ালা ভাড়া বাড়াচ্ছেন। মা-বাবাকে বলতে লজ্জা লাগে যে দিন দিন খরচের পরিমাণ বেড়েই যাচ্ছে।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাইফ কাহন বলেন, আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে একটি ইউনিট শেয়ার করে থাকি। একরুমে তিনজন থাকি তাই প্রতিজনের ভাড়া ৯ হাজার টাকার কাছাকাছি পড়ে। বাকি ইউটিলিটি, খাবার মিলিয়ে মাসে ১৫ হাজারের মতো খরচ হয়ে যায়।

ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থী তাসনিম জাহান বলেন, প্রথম সেমিস্টারে এক রুমে তিনজন থাকতাম। খরচ পড়ত ৭ হাজার টাকা করে। কিন্তু এখন বাড়িওয়ালা বলছেন দুজনের বেশি রাখা যাবে না। ফলে খরচ আরও বেড়ে ১০ হাজার টাকা হয়ে যাচ্ছে।
শিক্ষার্থীরা বলছেন ওই এলাকায় এখন নতুন করে সিট পাওয়া দূষ্কর। বাড়ির মালিক বলেন, ব্র্যাকের ছাত্র হলে আগে বুকিং দিতে হবে। চাহিদা দিন দিন বেড়েই চলছে।

শুধু ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরে নয় বরং মেরুল বাড্ডার আশপাশে যেসব বিশ্বব্যিালয় রয়েছে, তাদের শিক্ষার্থীদের ওপরও এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে।

কাছেই রয়েছে ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। ওই বিশ্ববিদ্যারয়ের শিক্ষার্থী মাহমুদুল হাসান শেয়ার বিজকে বলেন, আমি আগে মেরুল বাড্ডায় থাকতাম। এখন বাধ্য হয়ে শাহজাদপুরে চলে গেছি।

কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের শিক্ষার্থী আফসানা হক বলেন, আমরা কয়েকজন মেয়ে মিলে উত্তর বাড্ডাতে একটা বাসা শেয়ার করে থাকি ১২ হাজার টাকায়। এখন বলছে ২২ হাজার টাকা দিতে হবে।

ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী শুভ্রদীপ দাস বলেন, আমাদের মতো ইউনিভার্সিটির ছাত্রদের এখন এসব এলাকায় টিকে থাকাই কঠিন। অনেক সময় বাড়িওয়ালারা সরাসরি বলে আমরা ব্র্যাকের ছাত্র চাই।

কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন শেয়ার বিজকে বলেছেন, শিক্ষার্থীদের আনাগোনা বাড়ায় বাসার চাহিদা বেড়েছে এটা ভালো। তবে বাড়িওয়ালারা অযৌক্তিকভাবে ভাড়া বাড়াচ্ছেন এটা ভালো কথা নয়। আমরা বুঝতে পারছি এখানে কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। তবে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের জন্য বাড়তি ভাড়া মেটানো একরকম নয়। বাড়িওয়ালাদের বিষয়টি বোঝা দরকার। নিজেদের মধ্যে সংস্কার আনা দরকার।

তিনি আরও বলেন, বাসাভাড়া কীভাবে বাড়বে এটা নিয়মের মধ্যে আনা উচিত। বাসা ভাড়া দেয়া এক প্রকার মানব সেবা। হুট করে বাসা ভাড়া বাড়িয়ে দেয়া এটা মানব সেবার আওতায় পড়ে না। এ কারণে সীমিত আয়ের মানুষদের কষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

নগর পরিকল্পনাবিদরে মতে, এটা শুধু একটি বিশ্বব্যিালয়ের প্রভাব নয় বরং একটি বড় আর্থসামাজিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত। ঢাকা শহরের কোনো অঞ্চলে যখন উন্নয়নের ছোঁয়া লাগে, তখন তা স্বাভাবিকভাবেই গরিব মানুষদের ওপর প্রভাব ফেলে। এই প্রবণতা দীর্ঘমেয়াদে শহরায়ণের জন্য ক্ষতিকর।

শহরের প্রতিটি কোণেই এভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল বা বাণিজ্যিক স্থাপনা গড়ে ওঠাকে কেন্দ করে নি¤œআয়ের মানুষের জীবনে ধাক্কা লেগে চলেছে। মেরুল বাড্ডার পরিবর্তন তার একটি নতুন উদাহরণ। সমাজবিদদের মতে, এই ধাক্কা শুধু অর্থনৈতিক নয়Ñ এটি সাংস্কৃতিক ও মানসিকও।