আরশী আক্তার সানী : আজকের যুগে আমাদের জীবন অনেক পরিবর্তিত হয়েছে। আগে মানুষ অনেক বই পড়ত। ছোট থেকে বড় সবাই গল্পের বই, উপন্যাস, কবিতা বা শিক্ষামূলক বই পড়ত। স্কুলে পড়াশোনার অংশ হিসেবে বই পড়া খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। মানুষ বই পড়ে জ্ঞান পেত, কল্পনা বাড়াত এবং ভাবনাশক্তি উন্নত করত। বই আমাদের শেখায়, আমাদের চিন্তা করতে সাহায্য করে, আর আমাদের কল্পনাকে শক্তিশালী করে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে মানুষ আগের মতো বই পড়ে না। এর অনেক কারণ আছে। প্রথম কারণ হলো প্রযুক্তি। মোবাইল ফোন, কম্পিউটার, ট্যাবলেট আর টিভি এখন মানুষের সবচেয়ে বড় মনোযোগের কেন্দ্র। সোশ্যাল মিডিয়া, ছোট ভিডিও, গেম—এগুলো মানুষের সময় দখল করছে। তাই অনেকেই বইয়ের বদলে ভিডিও বা গেমের মাধ্যমে সময় কাটাচ্ছে; দ্বিতীয় কারণ হলো সময়ের অভাব। মানুষ এখন খুব ব্যস্ত। স্কুল, কলেজ, কাজ, বাড়ির কাজ—সবকিছুর মধ্যে বই পড়ার সময় পাওয়া কঠিন। মানুষ দ্রুত তথ্য পেতে চায়। তাই অনেকেই দীর্ঘ বই পড়ে না। তারা সংক্ষিপ্ত খবর, ছোট গল্প বা ভিডিও দেখেই তথ্য নেয়ার চেষ্টা করে। তৃতীয় কারণ হলো আগ্রহের পরিবর্তন। আগে মানুষ বই পড়াকে বিনোদন এবং শেখার প্রধান মাধ্যম মনে করত। এখন অনেকের আগ্রহ বইয়ের পরিবর্তে ইন্টারনেট, ভিডিও বা গেমের দিকে চলে গেছে। চতুর্থ কারণ হলো পরিবারের পরিবেশ। কিছু পরিবারে বই পড়ার পরিবেশ নেই। বাবা-মা যদি বই না পড়েন বা সন্তানকে উৎসাহ না দেন, শিশুরাও বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে পারে না। তাই পরিবারে বইয়ের গুরুত্ব বোঝানো খুব গুরুত্বপূর্ণ।
তবুও এর মানে এই নয় যে, মানুষ একদম বই পড়া ভুলে যাবে। যারা বই পড়তে ভালোবাসে, তারা সব সময় বই পড়বে। বই আমাদের জ্ঞান দেয়, চিন্তাশক্তি বাড়ায় এবং কল্পনাশক্তি উন্নত করে। বই শুধু শিক্ষার মাধ্যম নয়, আমাদের ভাবনার জগৎও সমৃদ্ধ করে।
ভবিষ্যতে যদি আমরা চাই মানুষ বই পড়া ভুলে না যায়, আমরা ছোটবেলা থেকেই শিশুদের বইয়ের সঙ্গে পরিচয় করাতে হবে। শিশুদের জন্য গল্পের বই, ছবিসহ শিক্ষামূলক বই, ছোট উপন্যাস এবং উপকথা দেয়া উচিত। এই ধরনের বই শিশুদের কল্পনা, বুদ্ধি ও মননশীলতা বাড়ায়। যখন মানুষ ছোটবেলা থেকেই বই পড়ে অভ্যস্ত হয়, তারা বড় হয়ে ও বই পড়তে আগ্রহী হয়।
পরিবারের পাশাপাশি বিদ্যালয়ের ভূমিকাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। বিদ্যালয়ে বই পড়ার পরিবেশ আনন্দময় করা উচিত। শিক্ষকরা পাঠ্যপুস্তক ছাড়াও শিক্ষার্থীদের নানারকম গল্পের বই ও শিক্ষামূলক বই দেওয়া উচিত। শিক্ষার্থীরা যদি ছোটবেলা থেকেই বই পড়ার অভ্যাসে অভ্যস্ত হয়, তারা বড় হয়ে বইকে গুরুত্ব দেবে।
প্রযুক্তি বই পড়ার জন্য বাধা হলেও আমরা এটিকে সাহায্যের হাত হিসেবে ব্যবহার করতে পারি। ই-বুক, অডিওবুক এবং শিক্ষামূলক অ্যাপ্লিকেশন শিশুদের বই পড়ার অভ্যাসে সাহায্য করতে পারে। সঠিক দিকনির্দেশনা এবং পরিবার ও শিক্ষকের সহায়তায় প্রযুক্তি বই পড়ার আগ্রহ বাড়াতে পারে।
বই শুধু জ্ঞানই দেয় না, এটি আমাদের চরিত্র গঠনে সাহায্য করে। বই পড়া মানুষকে ধৈর্য, মনোযোগ এবং বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা শেখায়। বইয়ের মাধ্যমে আমরা বিভিন্ন মানুষের জীবন ও সমাজের বাস্তবতা বুঝতে পারি। আমরা বই পড়ে বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও ইতিহাস জানতে পারি।
বইয়ের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো কল্পনাশক্তি বৃদ্ধি করা। আমরা যখন গল্পের বই পড়ি, তখন আমাদের মনের চোখে চরিত্রগুলো তৈরি হয়। আমরা কল্পনা করি, ভাবি কীভাবে গল্পের ঘটনা ঘটছে। এই কল্পনাশক্তি আমাদের জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে নতুন ধারণা, সমাধান এবং সৃজনশীলতার জন্য সাহায্য করে।
ভবিষ্যতে মানুষ হয়তো কম বই পড়বে। কারণ প্রযুক্তি সব জায়গায় প্রবেশ করেছে। মানুষ দ্রুত তথ্য পেতে চায়। তবে যারা বই পড়ার প্রতি আগ্রহ রাখে, তারা সব সময় বই পড়বে। বইয়ের শক্তি, জ্ঞান এবং আনন্দ কোনো প্রযুক্তি বা দ্রুত তথ্যপ্রবাহ দ্বারা কখনো প্রতিস্থাপিত করা সম্ভব নয়।
আমরা চাইলে বইকে আরও আকর্ষণীয় করতে পারি। ছোটগল্প, ছবি ও গল্পের অডিও এবং ই-বুকের মাধ্যমে বই পড়াকে আরও সহজ এবং আনন্দময় করা সম্ভব। বই পড়া শুধু শিক্ষার মাধ্যম নয়, এটি বিনোদনেরও একটি উৎস হতে পারে।
বই মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রযুক্তি যতই উন্নত হোক না কেন, বই আমাদের জীবনকে সমৃদ্ধ করে। বই পড়া একটি সুন্দর অভ্যাস, যা আমাদের জীবনকে বুদ্ধিমান, চিন্তাশীল এবং কল্পনাশক্তি সম্পন্ন করে। আমরা যতই ব্যস্ত থাকি না কেন, বই আমাদের বন্ধু, শিক্ষক এবং গাইড হিসেবে সব সময় প্রয়োজন। তাই ভবিষ্যতে মানুষ হয়তো কম বই পড়বে, তবে বই একদম হারাবে না। বই আমাদের জীবনের জন্য চিরন্তন মূল্যবোধ বহন করে।
শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়