শাহ মো. জিয়াউদ্দিন : ভারতে অবৈধভাবে বসবাসকারী বাংলাদেশি সন্দেহে ধরপাকড় শুরু করে সে দেশের সরকার। ধরপাকড় শুরু হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশে পুশ ব্যাক করে দেয়ার বেশ কয়েকটি ঘটনা গণমাধ্যমে এসেছে। ভারতের দিক থেকে যেটা পুশ ব্যাক, বাংলাদেশের চোখে সেটাই পুশ ইন। শুধু ভারতের গুজরাট এবং রাজস্থানেই সম্প্রতি এক হাজারেরও বেশি মানুষকে চিহ্নিত করেছে ওই রাজ্যগুলোর পুলিশ। তাদের দাবি, এ চিহ্নিতরা বে আইনিভাবে বাংলাদেশ থেকে এসে বসবাস করছে। বিবিসি বাংলা নিশ্চিত করতে পেরেছে, সম্প্রতি সীমান্ত দিয়ে যাদের পুশ ব্যাক করা হয়েছে, তাদের মধ্যে এমন ব্যক্তিরাও ছিলেন, যাদের আনা হয়েছে গুজরাট ও ভারতের অন্যান্য রাজ্য থেকে।
আবার রাজস্থান থেকে যারা ধরা পড়েছেন, তাদের মধ্যে ১৪৮ জনের প্রথম দলটিকে বিশেষ বিমানে চাপিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ত্রিপুরার আগরতলায়। ২০২৫-এর ২৫ মে রাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর সীমান্তে যে পুশ ব্যাকের চেষ্টা হয়েছিল, তাদের মধ্যে কেউ রাজস্থানে ধরা পড়া কথিত বাংলাদেশি কি না, তা নিশ্চিত করা যায়নি। গুজরাট ও রাজস্থান—দুই রাজ্যের পুলিশই জানিয়েছে, বাংলাদেশের যেসব নাগরিকের পরিচয় তারা নিশ্চিত করতে পেরেছেন, তাদের সকলকেই ফেরত পাঠানো হবে। ওড়িশাসহ অন্য কয়েকটি রাজ্যেও বাংলাদেশের এমন নাগরিকদের ধরা হচ্ছে যারা ভারতের পুলিশের ভাষ্যমতে ‘অনুপ্রবেশকারী’। সীমান্তে পুশ ব্যাক বা পুশ ইন আসলে এমন একটা পদ্ধতি যে সীমান্তে মানুষগুলো ধরা পড়ে তাদের অন্য সীমান্ত দিয়ে পুশ ব্যাক করা হয়। এই প্রক্রিয়ার কোনো আইনি স্বীকৃতি নেই ভারতে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরেই এই পদ্ধতি চলে আসছে, যেটা আনুষ্ঠানিকভাবে কেউই স্বীকার করে না। গুজরাট ও রাজস্থানে যাদের ‘বাংলাদেশি’ বলে ধরা হয়েছে, তাদের কাউকেই প্রায় আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আটক করা হচ্ছে না বলে অভিযোগ করছেন সে দেশের সামাজিক কর্মকর্তারা। গুজরাট ও রাজস্থানে পশ্চিমবঙ্গের পরিযায়ী শ্রমিকদের সহায়তা করার জন্য রয়েছে একটি সংগঠন। এই সংগঠনটি একটি হেল্প-লাইন নম্বর চালু করেছে, সেখানে যত ফোন এসেছে, তাদের মধ্যে মাত্র একজনের খবর পাওয়া গেছে, যাকে রাজস্থানের আদালতে তোলা হয়েছিল। পরিযায়ী শ্রমিক ঐক্য মঞ্চ নামের ওই সংগঠনটির রাজ্য সম্পাদক আসিফ ফারুক বলছিলেন, প্রায় এক মাস হতে চলল আমরা হেল্প-লাইন চালু করেছি। গুজরাট থেকে প্রায় সাড়ে ৫০০ আর রাজস্থান থেকে প্রায় দুশো ফোন পেয়েছি। ফোন পাওয়ার পরে আমরা সেখানকার স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করে পশ্চিমবঙ্গের মানুষদের ছাড়িয়ে আনার ব্যবস্থা করছি। এতদিনে গুজরাটের ৬৮টি ঘটনা আর রাজস্থানের ১০৯টি অভিযোগের সমাধান করতে পেরেছি। তবে মাত্র একটি ঘটনায় আমরা জানতে পেরেছি যে পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার বাসিন্দা এক ধৃত ব্যক্তিকে আদালতে তোলা হয়েছিল এবং তিনি এখন ডিটেনশন ক্যাম্পে আছেন, বিবিসিকে এই তথ্য জানান আসিফ ফারুক।
ভারত কেন তা আইনি পথে ফেরত দিচ্ছি না এই সম্পর্কে, বিবিসির সংবাদ থেকে আরও জানা যায়, গুজরাট, রাজস্থানের পুলিশ বা ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ এই প্রসঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে মুখ খুলতে চায়নি। বিএসএফ সব সময়েই বলে থাকে যে তাদের ডিকশনারিতে ‘পুশ ব্যাক’ শব্দটাই নেই। কিন্তু নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর কয়েকটি সূত্র নিশ্চিত করেছে যে, সম্প্রতি অবৈধ বাংলাদেশি বলে যাদের চিহ্নিত করা হয়েছে, তাদের ছোট-বড় দলে ভাগ করে ‘পুশ ব্যাক’ই করা হচ্ছে। ওই সূত্রগুলো বিবিসিকে জানিয়েছে, গ্রেপ্তার দেখানো হলে ধৃতদের বিরুদ্ধে মামলা চলবে, তারপর সাজা হলে জেলে রাখতে হবে। তারও পরে দীর্ঘ কূটনৈতিক জটিলতা কাটিয়ে তাদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে হবে। এই গোটা পদ্ধতি অতি সময়সাপেক্ষ। কয়েক বছর লেগে যায় এই প্রক্রিয়ায়। এই প্রক্রিয়া চালালে তাদের সমস্যা কারণ তাদের ভাষ্য মতে, এখন শত শত অবৈধ বাংলাদেশি ধরা পড়ছে কয়েকটি রাজ্যে। এদের যদি গ্রেপ্তার করতে হয়, তাহলে তো জেল থেকে অন্য বন্দিদের বার করে দিতে হবে। কারণ তাদের জেলে এত জায়গা নাই। নাম উল্লেখ না করার শর্তে বিবিসিকে বলছিলেন একজন কর্মকর্তা। প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশ সরকার কেন এই বিষয়টিতে ভূমিকা রাখছেন না। বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের অবশ্য ভারতের কাছে পুশ ব্যাকের বিষয়ে জানা দরকার। কেন ভারত আইনগতভাবে তাদের দেশে ধরা পড়া বাংলাদেশিদের বাংলাদেশের সরকারের কাছে ফেরত দিচ্ছে না। বাংলাদেশের প্রথম শ্রেণির জাতীয় দৈনিক প্রথম আলোর তিনটি সংবাদ থেকে জানা যায়, মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার কাজিপুর সীমান্ত দিয়ে ১৮ জনকে ঠেলে পাঠিয়েছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)। গত ২৯ জুলাই দুপুরে গাংনী উপজেলার কাজিপুর সীমান্ত এলাকা থেকে তাদের আটক করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। আটক ব্যক্তিদের মধ্যে ১৫ জনের পরিচয় জানা গেছে। তাদের বাড়ি খুলনা, যশোর, নড়াইল ও ঠাকুরগাঁও জেলায়। কাজের সন্ধানে অবৈধভাবে ভারতে গিয়ে দীর্ঘদিন ধরে তারা সেখানে বসবাস করে আসছিলেন। ২৬ জুলাইয়ের সংবাদ থেকে জানা যায়, মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখার সীমান্ত এলাকা দিয়ে ভারত থেকে ফিরে আসা নারী-শিশুসহ ১১ জনকে আটক করেছে বিজিবির টহল দল। তারা সবাই বাংলাদেশের নাগরিক। এই গণমাধ্যমের আরও একটি সংবাদ থেকে জানা যায়, মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার সীমান্ত এলাকা দিয়ে নারীসহ পাঁচজনকে বাংলাদেশে ঠেলে পাঠিয়েছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)। বিজিবি ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ২৫ জুলাই শুক্রবার ভোর সোয়া ৫টার দিকে জেলার বড়লেখা উপজেলার লাতু বিওপির সীমান্তবর্তী কুমারশাইল পাহাড়ি এলাকায় বিজিবির একটি টহল দল নারীসহ পাঁচজনকে ঘোরাঘুরি করতে দেখে। পরে তাদের আটক করা হয়। এই পাঁচজনের মধ্যে পুরুষ চারজন ও নারী একজন। এই পুশ ইন বা পুশ ব্যাক আন্তর্জাতিক আইনে কতটা সিদ্ধ? তা কি খতিয়ে দেখছেন আর্ন্তজাতিক মানবাধিকার কমিশন? প্রতিদিন গণমাধ্যমে পুশ ইনের খবর পাওয়া যায়। আর এভাবে পুশ ব্যাক হওয়া মানুষগুলোকে কাটাতে হয় মানবেতর জীবন।
ভারতের একটি সংবাদপত্রের শিরোনাম ছিল, ‘তোদের বাংলাদেশি বানিয়ে দেব’, সংবাদটি লিখেছেন, সে দেশের সাংবাদিক রণদীপ মিত্র মুরারই। সংবাদটির শিরোনাম এটা হওয়ার কারণ হলো এ হুমকিটি দেয়া হয়েছে যাদেরকে ধরা হচ্ছে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসরত পশ্চিম বঙ্গের বাসিন্দাদের। এ শিরোনাম থেকে যে সংবাদটি বিশদভাবে প্রকাশিত হয় তা হলো, সংবাদে উল্লিখিত পুশ ব্যাকের সংখ্যা ছয়জন মানুষ, এ ছয়জনই ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার বাসিন্দা। তারা যে বীরভূমের বাসিন্দা তার প্রমাণ হিসেবে তাদের পরিবারের কাছে আছে আছে ১৯৬৬ সালের জমির দলিল। তবুও ‘পুশ ব্যাক’-এর শিকার ভাদু শেখ নামের জনৈক ব্যক্তির পরিবারের ছয়জন। ভাদু শেখের পরিবারের পুশ ব্যাক হওয়া সদস্যদের সন্ধানে চার বছরের নাতিকে নিয়ে তার স্ত্রী দিল্লি গিয়েছিলেন। মা মা করে কেঁদেই চলেছে দুধের এই শিশু। পুশব্যাকের শিকার হয়েছেন এই ছোট্ট শিশু আনিশার বাবা-মা-ভাই। বীরভূমের প্রত্যন্ত জনপদ পাইকরের দর্জিপাড়া থেকে সপরিবারে দানিশ শেখরাও পাড়ি দিয়েছিলেন দিল্লি। স্রেফ ভাতের জোগাড়ের তাগিদে। দানিশ ছাড়াও সেই দলে ছিলেন তার স্ত্রী সোনালি বিবি, শ্বশুর ভোদু সেখ, শাশুড়ি, মেয়ে আনিশা ও ছেলে। দিল্লিতে ভাংরির বেচাকেনা করে কোনোমতে পেট চালাচ্ছিলেন হতদরিদ্র এ পরিবার। কোররানির সময় ভোদু শেখ, তার স্ত্রী ও তাদের নাতনি অর্থাৎ দানিশের মেয়ে আনিশাকে নিয়ে ফিরে আসেন বীরভূমের গাঁয়ে। দিন কয়েক পর থেকে ভোদু শেখ তার জামাই দানিশ, মেয়ে সোনালি ও ছোট্ট নাতির আর কোনো খোঁজ পাচ্ছিলেন না। দিশাহারা ভোদু শেখ দিল্লিতে পড়শির সঙ্গে যোগাযোগ করেন। পড়শিরা খোঁজখবর করে জানতে পারেন পুলিশ আটক করেছে দানিশদের। আর মন স্থির থাকে না ভোদু ও তার স্ত্রীর। তিনি হাঁপানি রোগী, হাঁপানির চোটে জেরবার ভোদু শেখ সাংবাদিককে জানিয়েছেন, আমি দু’পা হাঁটতে পারি না। হাঁপাতে থাকি। কিন্তু তিনি খোঁজ লাগাতে পারছিলেন না। এরপর তারা দিল্লির এক থানায় চেঁচামেচি করলে পুলিশ জানিয়েছে, মেয়ে-জামাইকে বাংলাদেশ পাঠিয়ে দিয়েছে। গত ১৮ জুন দানিশের পরিবারকে আটক করেছিল দিল্লি পুলিশ। ২৬ জুন তাদের বিএসএফের মাধ্যমে ঠেলে পাঠিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশে। শুধু দানিশরাই নন, পাইকর গ্রামেরই দর্জিপাড়ার সুইটি বিবি ও তার দুই ছেলেও রয়েছে এই দলে। মাসখানেক আগে এই সুইটি বিবির পরিবারে একটি ফোন এসেছিল বলে জানিয়েছেন ভোদু শেখ। বাংলাদেশ থেকে ফোনে দানিশ-সুইটিরা বলেছিল, এক ফাঁকা জায়গায় ছেড়ে দিয়ে গেছে তাদের বিএসফ। তাদের খাবার নেই। পোশাক নেই। থাকার জায়গা নেই। খুব কষ্টে আছি। একটি ভিডিও বার্তা পাঠাতে পেরেছিলেন তারা। তাতে সোনালি বিবি, সুইটি বিবিরা কাঁদতে কাঁদতে হাতজোড় করে জানিয়েছিলেন—দিল্লির রোহিণী থানায় আটকে রেখেছিল পুলিশ। আমরা বললাম যে, আমরা বাংলাদেশি নই। তারপর থানা ওয়ালারা বলল, ‘তোরা বাংলাদেশি না হলেও, তোদের বাংলাদেশি বানিয়ে দেব। গাড়িতে তোলার সময়েও ভীষণ মারধর করা হয়েছে আমাদের। ছবি তুলেছে। আঙুলের ছাপ নিয়েছে। হাসপাতালেও পরীক্ষা করিয়েছে। তারপর আমাদের বাংলাদেশে ঢুকিয়ে দিয়েছে। আমরা মানুষের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে বেড়াচ্ছি। চেয়ে চিন্তে বাচ্চাদের খাওয়াচ্ছি। এক কাপড়ে রয়েছি’—এটা ছিল ভোদু শেখের পরিবারের কাহিনি। সংবাদ থেকে আরও জানা যায়, গত ৯ জুলাই এই মর্মে কলকাতা হাইকোর্টে হেবিয়াস কর্পাস মামলা দায়ের হয়েছে। হাইকোর্ট দিল্লি সরকারের কাছে কেন, কোন আইনে এবং কিসের এফআইআরের ভিত্তিতে এই আটক এবং তার প্রক্রিয়া সংক্রান্ত পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর জানতে চেয়েছে। সেই সঙ্গে এ রাজ্যের মুখ্যসচিবকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক ও দিল্লি সরকারের সঙ্গে সমন্বয় করে তথ্য জোগাড়ের নির্দেশ দিয়েছে। ভোদু শেখ আরও জানায় যে, আমাদের কাছে ১৯৩৬ সালের কাগজ আছে। তাও কেন আমাদের বাংলাদেশি বলছে? আমরা গরিব বলেই কি এই অত্যাচার? মেয়ে, জামাই, নাতি কোথায় আছে? কি খাচ্ছে? কি পরছে? এসব প্রশ্নের উত্তরই হাতড়ে বেড়াচ্ছেন হাঁপানির দাপে ন্যুব্জ ভোদু শেখ।’ এটা হলো সাংবাদিক রণদীপ মিত্রের লেখা সংবাদ।
এ রকম পুশ ইন বা পুশ ব্যাকের নামে মানুষের ওপর চলছে অমানবিক কার্যকলাপ। তাই পুশ ইন বা পুশ ব্যাকবিষয়ক বাংলাদেশ সরকারের জোরালো প্রতিবাদ জানানো উচিত। আন্তর্জাতিক মহলের এই বিষয়টিতে হস্তক্ষেপ করাটা জরুরি।
উন্নয়নকর্মী, মুক্ত লেখক
কাদিরগঞ্জ দরিখোরবোনা, রাজশাহী

Discussion about this post