Print Date & Time : 21 September 2025 Sunday 3:54 am

ভারত কেন প্রতিবেশীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে ব্যর্থ?

 ওয়াসিম ফারুক : দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে ভারতের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ভৌগোলিক আকার, জনসংখ্যা, অর্থনৈতিক শক্তি ও সামরিক সক্ষমতার কারণে ভারতকে এ অঞ্চলের প্রভাবশালী রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এত শক্তি ও সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও ভারত তার প্রতিবেশীদের সঙ্গে স্থায়ী ও সৌহার্দ্যমূলক সম্পর্ক গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে। নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, পাকিস্তান, বাংলাদেশ কিংবা বৃহৎ শক্তি চীন সবার সঙ্গেই ভারতের সম্পর্কে নানা টানাপোড়েন বিরাজমান। প্রশ্ন জাগে, কেন ভারত তার প্রতিবেশী কূটনীতিকে সফলভাবে পরিচালনা করতে পারে না? দক্ষিণ এশিয়া এমন এক ভূখণ্ড যেখানে ভৌগোলিক নৈকট্য, ঐতিহাসিক অভিন্নতা, সাংস্কৃতিক সাদৃশ্য এবং অর্থনৈতিক আন্তঃনির্ভরতা থাকা সত্ত্বেও প্রায়ই দ্বন্দ্ব, অবিশ্বাস ও প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবর্ণনীয় হয় ভারত। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটলেও ভারত বিভাজনের ক্ষত বহন করে স্বাধীনতা লাভ করে। পাকিস্তানের সঙ্গে শুরু হয় সীমান্ত বিরোধ, কাশ্মীর ইস্যু এবং একাধিক যুদ্ধ। স্বাধীনতার প্রথম থেকেই ভারতের কূটনীতিতে একটি আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের মানসিকতা কাজ করেছে। প্রতিবেশীরা এটিকে প্রায়ই আধিপত্যবাদী মনোভাব হিসেবে দেখেছে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ ভারতের অবদানকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে, কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকেই পনিবণ্টন, সীমান্ত হত্যা, বাণিজ্য বৈষম্যসহ নানা ইস্যুতে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক শীতল তো হয়ই নাই বরং মাঝেমধ্যে চরম উত্তপ্ত হয়েছে।

ভারত দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় ৭৫ শতাংশ আয়তন ও জনসংখ্যা দখল করে রেখেছে। সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তির ব্যবধান এত বেশি যে প্রতিবেশী দেশ গুলি স্বাভাবিকভাবেই নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত থাকে। ভারত প্রায়ই ছোট দেশগুলোর ওপর কৌশলগত চাপ নানা প্রয়োগ করে থাকে। বাংলাদেশে তিস্তা চুক্তি ঝুলে থাকা, নেপালে কয়েক দফা অবরোধ আরোপ, শ্রীলঙ্কায় তামিল ইস্যুতে সরাসরি হস্তক্ষেপ কিংবা মালদ্বীপের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভূমিকা এসব কারণে প্রতিবেশীরা মনে করে ভারত নিজেকে এই অঞ্চলের বড় ভাইয়ের ভূমিকায় অবর্ণনীয় হয়ে আছে, যা বর্তমান সময়ে এ অঞ্চলের তরুণ প্রজন্ম মোটের সহজভাবে গ্রহণ করতে পারছে না। ভারতের সঙ্গে প্রতিবেশীদের সবচেয়ে বড় দ্বন্দ্ব হলো সীমান্ত ও নদী। কারণ ভারত একটি বড় দেশ হওয়ায় ভাটিতে থাকা দেশগুলোর অধিকাংশ নদ-নদীর উৎপত্তিস্থল হিমালয় বা ভারতের  ভেতর থাকা বিভিন্ন পার্বত মালা। বাংলাদেশের সঙ্গে ৪,০৯৬ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত বিশ্বের সবচেয়ে বড় স্থলসীমান্তগুলোর একটি। প্রায়ই সীমান্তে বিএসএফের গুলি, হত্যাকাণ্ড ও চোরাচালানের ঘটনা ঘটে। তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে আছে, যার কারণে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে কৃষি ও পরিবেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। লিপুলেখ, কালাপানি ও লিম্পিয়াধুরা অঞ্চলে সীমান্ত বিরোধ আজও সমাধান হয়নি। ২০১৫ সালে ভারতের অবরোধ নেপালে তীব্র বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল।  কাশ্মীর ইস্যু দীর্ঘদিন ধরেই দুই দেশের সম্পর্কের প্রধান অন্তরায়। পানি বণ্টনের জন্য ১৯৬০ সালে ইন্দুস ওয়াটার ট্রিটি হলেও অভিযোগ প্রতিবাদ চলছেই। এসব ইস্যুতে ভারতের অনমনীয়তা প্রতিবেশীদের আস্থাকে দুর্বল করেছে। ভারতের অর্থনীতি প্রায় ৪ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার, যেখানে প্রতিবেশীদের অর্থনীতি তুলনামূলকভাবে ক্ষুদ্র। ভারত তাদের বাজারকে পুরোপুরি উন্মুক্ত করে না, অথচ প্রতিবেশীদের বাজারে প্রবেশ করে বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ায়। উদাহরণস্বরূপ বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য ঘাটতি প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। এতে বাংলাদেশের ব্যবসায়ী মহলে ক্ষোভ জমা হয়। একই চিত্র নেপাল, ভুটান বা শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রেও দেখা যায়।

ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিও প্রতিবেশী সম্পর্ককে জটিল করে তোলে। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি তিস্তা চুক্তিকে বারবার আটকে দিয়েছে। আসামের নাগরিকপঞ্জি (NRC) ও নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (CAA) বাংলাদেশে তীব্র উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। তামিলনাড়ুর রাজনীতি শ্রীলঙ্কার তামিল ইস্যুকে উত্তপ্ত রাখে। ফলে প্রতিবেশী সম্পর্ক প্রায়ই ভারতের আঞ্চলিক রাজনীতির জিম্মি হয়ে পড়ে। দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের উপস্থিতি ভারতের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। শ্রীলঙ্কায় হাম্বানটোটায় চীনা বন্দর, পাকিস্তানে সিপিইসি প্রকল্প, নেপালে চীনের বিনিয়োগ, মালদ্বীপে চীনা অবকাঠামোম—এসব ভারতের জন্য কৌশলগত উদ্বেগের কারণ। ভারত প্রায়ই প্রতিবেশীদের ওপর চাপ প্রয়োগ করে চীনের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক সীমিত করতে চায়। কিন্তু এতে উল্টো ফল হয় প্রতিবেশীরা ভারতের বদলে চীনের দিকে ঝুঁকে পড়ে। দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সহযোগিতা জোট সার্ক কার্যত অচল হয়ে পড়েছে মূলত ভারত-পাকিস্তান বিরোধের কারণে। ভারতের”প্রতিবেশী প্রথম নীতি প্রায়ই ঘোষণায় সীমাবদ্ধ থাকে। বাস্তবে দেখা যায়, আঞ্চলিক প্ল্যাটফর্মে ভারত নেতৃত্ব দিতে চাইলেও সমমর্যাদার ভিত্তিতে সহযোগিতা গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়।

ভারতের বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ হলো সে প্রতিবেশীদের সমান মর্যাদা দিতে চায় না। ছোট দেশগুলো নিজেদের স্বাধীন নীতি অনুসরণ করতে চাইলে ভারত তা পছন্দ করে না। এ কারণে সম্পর্কের জায়গায় সন্দেহ, শঙ্কা ও আস্থাহীনতা তৈরি হয়। যেমন বাংলাদেশের মানুষ প্রায়ই মনে করে ভারত শুধু নিজেদের স্বার্থেই চুক্তি করে নেপাল মনে করে ভারত তাদের সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ করে শ্রীলঙ্কা মনে করে ভারত তামিল ইস্যুতে অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ করেছে। ভারত যদি সত্যিই দক্ষিণ এশিয়ায় নেতৃত্ব দিতে চায়, তবে তাকে বড় ভাই নয়, সহযোগী বন্ধু হিসেবে আচরণ করতে হবে। সমান মর্যাদা, ন্যায়সঙ্গত বাণিজ্য, সীমান্তে মানবাধিকার রক্ষা, জলবণ্টনের ন্যায্য সমাধান এবং আঞ্চলিক সহযোগিতা জোরদার করতে পারলেই কেবল আস্থা ফিরবে। অন্যথায় চীনসহ অন্যান্য শক্তি এই শূন্যতা পূরণ করবে, আর ভারত ক্রমেই একা হয়ে পড়বে। প্রতিবেশী সম্পর্ক কেবল ভৌগোলিক নৈকট্যের কারণে নয়, পারস্পরিক আস্থা ও সম্মানের ভিত্তিতেই গড়ে ওঠে। ভারত যদি আধিপত্যবাদী মানসিকতা থেকে বেরিয়ে না আসে, তবে তার শক্তি ও সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও দক্ষিণ এশিয়ায় সে একটি বিচ্ছিন্ন দৈত্য হিসেবেই থেকে যাবে। তাই ভারতের জন্য এখন সবচেয়ে জরুরি—প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্ককে প্রকৃত অর্থে সমান অংশীদারিত্বে রূপান্তর করা। অন্যথায় আঞ্চলিক শান্তি, স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধি অধরাই থেকে যাবে।

মুক্ত লেখক, অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট