নিজস্ব প্রতিবেদক : ছাগলকাণ্ডে আলোচিত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক কর্মকর্তা মতিউর রহমানকে গোপন বৈঠকের সুযোগ করে দেয়ায় ১১ পুলিশ সদস্যকে বরখাস্ত করা হয়েছে।
ঢাকা মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালত থেকে কিশোরগঞ্জ কারাগারে নেয়ার পথে গত ১২ আগস্ট দুপুরে নরসিংদীর শিবপুর উপজেলার ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের সৈয়দনগরে নিরালা হাড্ডি নামের রেস্তোরাঁয় এ ঘটনা ঘটে। ওই দিন দুপুরে খাবারের বিরতিতে ওই রেস্তোরাঁয় নেমেছিলেন তারা। অভিযোগ উঠেছে, পুলিশ সদস্যরা উৎকোচ নিয়ে ওই রেস্তোরাঁর একটি কেবিনে এক ব্যক্তির সঙ্গে মতিউর রহমানের গোপন বৈঠকের সুযোগ করে দেন।
এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে এক উপ-পরিদর্শকসহ ১১ পুলিশ সদস্যকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে কিশোরগঞ্জ জেলা পুলিশ। গত শনিবার কিশোরগঞ্জের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হাছান চৌধুরীর সই করা এক আদেশে ১১ পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করার বিষয়টি জানানো হয়।
সম্প্রতি আল জাজিরার সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের ফেসবুক একটি ভিডিও করেন। পোস্টে শেয়ার হওয়া এক ভিডিওতে দেখা গেছে, এনবিআরের সাবেক কর্মকর্তা মতিউর রহমান কারাগারে ফেরার পথে নরসিংদীর একটি হোটেলে দীর্ঘ সময় যাত্রা বিরতি করেন। এরপর থেকেই আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয়।
এ বিষয়ে পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হাছান চৌধুরী বলেন, ‘বিষয়টি জানার পরই পুলিশের পক্ষ থেকে তিন সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটি এ ঘটনার সত্যতা পেয়েছে। এর ভিত্তিতে ঘটনায় জড়িত ১১ পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করে পুলিশ লাইনসে ক্লোজ করা হয়েছে।’
সাময়িক বরখাস্ত হওয়া পুলিশ সদস্যদের মধ্যে একজন এসআই, বাকিরা কনস্টেবল। এসআইয়ের নাম আবুল কাশেম। বাকি ১০ জন কনস্টেবল হলেনÑমনিরুজ্জামান, কবির হোসেন, ইমরান, নির্জন খান, শামীম আলম, রনি হোসেন, শরীফুল ইসলাম, তানভীর রহমান, আবু সাইদ মিয়া ও রবীন্দ্র দাস। তাদের সবাইকে কিশোরগঞ্জ পুলিশ লাইনসে সংযুক্ত করা হয়েছে।
জেলা পুলিশের আদেশে বলা হয়, ১২ আগস্ট ওই পুলিশ সদস্যরা কিশোরগঞ্জ কারাগার থেকে মতিউর রহমানকে ঢাকা মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালতে হাজিরা দিতে নিয়ে যান। আদালতে হাজিরা শেষে ফিরতি পথে নরসিংদীর একটি রেস্টুরেন্টে খাবারের জন্য যাত্রাবিরতি দেয়া হয়। অভিযোগ ওঠে, স্কর্টের দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যরা উৎকোচ নিয়ে হাজতি মতিউর রহমানকে নানা সুযোগ-সুবিধা দেন।
এ ঘটনায় অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) নেতৃত্বে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটি তদন্ত শেষে প্রতিবেদন দেয়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, পুলিশ সদস্যরা হাজতি মতিউর রহমানকে আলাদা কক্ষে বসিয়ে আর নিজেরা সাধারণ স্থানে খাবার গ্রহণ করেন। এটি স্পষ্টত দায়িত্বে অবহেলা।
কিশোরগঞ্জ জেলা কারাগারের জেল সুপার রিতেশ চাকমা বলেন, সাবেক এনবিআর কর্মকর্তা মতিউর রহমানকে গত ১১ এপ্রিল কিশোরগঞ্জ কারাগারে আনা হয়। এর মধ্যে তাকে মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ ঢাকা আদালতে তিনবার হাজির করা হয়। সর্বশেষ তাকে গত ১২ আগস্ট হাজির করতে কিশোরগঞ্জ কারাগার থেকে ঢাকায় নেয়া হয়েছিল এবং একই দিন আবার কিশোরগঞ্জ কারাগারে ফিরিয়ে আনা হয়। তবে ২৬ আগস্ট মতিউর রহমানকে কিশোরগঞ্জ থেকে কাশিমপুর-২ কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থানান্তর করা হয়।
গত বছর কোরবানির জন্য রাজধানীর মোহাম্মদপুরের সাদিক অ্যাগ্রো থেকে ইফাত নামের এক তরুণের ১৫ লাখ টাকা দামে ছাগল কেনার ফেসবুক পোস্ট ঘিরে মতিউর রহমানকে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় সমালোচনা শুরু হয়।
তার আগে ছাগল কিনতে গিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছিলেন ইফাত। ধানমন্ডির বাসায় ঈদের দিন ছাগলটি কোরবানি দেয়ার কথা বলেছিলেন তিনি। তখন ছাগলসহ ইফাতের ছবি জুড়ে দিয়ে অনেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রশ্ন তোলেনÑ১৫ লাখ টাকা দিয়ে ছাগল কেনার অর্থের উৎস কী?
এ প্রশ্ন ঘিরে সামনে আসতে থাকে ইফাতের পরিচয়। ইফাত নিজেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছবিসহ পোস্ট দিয়ে ও সংবাদমাধ্যমে বাবার পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন, তার বাবা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাস্টমস, এক্সসাইজ ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের সভাপতি মতিউর রহমান।
ইফাতের বাবার পরিচয় ধরে অনেকে প্রশ্ন তোলেন, একজন সরকারি কর্মকর্তার ছেলের বিপুল ব্যয়ে কোরবানির পশু কেনার সামর্থ্য হলো কী করে?
অবশ্য ছাগলটি ইফাত শেষ পর্যন্ত কেনেননি বলে দাবি সাদিক এগ্রোর কর্ণধার মোহাম্মদ ইমরান হোসাইনের। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমকে তিনি বলেছেন, ইফাত শুধু ১ লাখ টাকা দিয়ে ছাগলটির বুকিং করেছিলেন। তবে অবশিষ্ট মূল্য পরিশোধ করে ছাগলটি তিনি আর নিয়ে যাননি।
মতিউর রহমান এ আলোচনায় ঘি ঢালেন ছেলের পরিচয় ‘অস্বীকার’ করে। একটি টেলিভিশনের প্রশ্নের জবাবে তিনি দাবি করেন, মুশফিকুর রহমান ইফাত নামে কেউ তার ছেলে বা আত্মীয় নয়, এমন নামে কাউকে চেনেন না পর্যন্ত। তার একটিই ছেলে, তার নাম তৌফিকুর রহমান।
এরপর ইফাতের পরিচয় ও পারিবারিক ঠিকুজি নিয়ে ফেসবুকে নানা তথ্য আসতে থাকে। ইফাতের সঙ্গে মতিউর রহমান এবং পরিবারের অন্যদের ছবিও প্রকাশিত হয়।
এক পর্যায়ে সামনে আসেন ফেনী-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারী। একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠানে তিনি দাবি করেন, ইফাত তার মামাতো বোনের সন্তান। আর মতিউর রহমানই ইফাতের বাবা।
নিজাম হাজারী বলেন, ইফাত এনবিআর কর্মকর্তা মতিউর রহমানের দ্বিতীয় পক্ষের (স্ত্রীর) ছেলে। মতিউর রহমানের প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজ লাকি ছিলেন শিক্ষা ক্যাডারের সাবেক কর্মকর্তা। সরকারি চাকরি ছেড়ে তিনি নাম লেখান রাজনীতিতে। পরে নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হন।
ছাগলকাণ্ডের আলোচনার মধ্যে মতিউর রহমানকে এনবিআর থেকে সরানো হয়। চলতি বছরের ১৪ জানুয়ারি মতিউর রহমান এবং তার স্ত্রী লায়লা কানিজ লাকিকে গ্রেপ্তার করে ডিবি পুলিশ।
তার আগে ৬ জানুয়ারি মতিউর রহমান ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে তিনটি মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। প্রতিটি মামলায়ই মতিউর রহমানকে আসামি করা হয়।

Discussion about this post