রোদেলা রহমান : একসময় আকাশপথ ছিল যেন এক অধরা স্বপ্ন, কেবল সমাজের উচ্চবিত্ত শ্রেণির জন্য সংরক্ষিত এক বিলাসী বাসনা। তবে গত এক দশকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিমান পরিবহন খাতে এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। মধ্যবিত্তরাও এখন যখন-তখন উড়াল দিচ্ছেন আকাশপথে; যা দেশের এভিয়েশন শিল্পে প্রাণচাঞ্চল্য এনে দিয়েছে।
সাশ্রয়ী ভাড়া, রুট সংখ্যা ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পাওয়া, উন্নত যাত্রীসেবার কারণে সড়কের পরিবর্তে অভ্যন্তরীণ আকাশপথেও চলাচল বেড়েছে। এতে ভ্রমণ যেমন আরামদায়ক হয়েছে, তেমনি অল্প সময়ে দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে পৌঁছে ব্যবসায়িক প্রয়োজনসহ অন্যান্য দাপ্তরিক প্রয়োজন মেটানোও সম্ভব হচ্ছে।
বর্তমানে দেশের অভ্যন্তরে উড়োজাহাজে যাত্রী পরিবহনকারী শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস, নভোএয়ার, ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন। এই বহরে নতুন করে যুক্ত হয়েছে এয়ার অ্যাস্ট্রা।
ছুটির দিন এবং উৎসবের সময়গুলোয় দেশের বিমানবন্দরগুলোয় যাত্রীদের উপচে পড়া ভিড় লক্ষ্য করা যায়, যা এই খাতের ক্রমবর্ধমান চাহিদাকে ইঙ্গিত করে।
যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সড়কপথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকার ভোগান্তি এড়াতে অনেকেই এখন আকাশপথ বেছে নিচ্ছেন। ঢাকা থেকে কক্সবাজার বা সিলেট যেতে যেখানে সড়কপথে ৬-১০ ঘণ্টা সময় লাগে, সেখানে বিমানে মাত্র ৪৫ মিনিট থেকে ১ ঘণ্টায় একই দূরত্ব পাড়ি দিতে পারছেন তারা। ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য ভ্রমণকারী, পর্যটক এবং জরুরি প্রয়োজনে যাতায়াতকারীদের কাছে সময় সাশ্রয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ঢাকার দক্ষিণ বনশ্রীর বাসিন্দা পারভীন নাহার একটি ব্যাংকে চাকরি করেন। কিছুদিন আগে পরিবার নিয়ে ঢাকা থেকে কক্সবাজার ঘুরে এসেছেন আকাশপথে। তিনি বলেন, ‘আগে কল্পনাও করিনি যে আমরা বিমানে চড়তে পারব। বাসের চেয়ে একটু বেশি ভাড়া, কিন্তু সময় বাঁচল কয়েক গুণ। বাচ্চাদের নিয়ে বাসে দীর্ঘভ্রমণ খুব কষ্টকর। বিমানে মাত্র ৪৫ মিনিটে কক্সবাজার পৌঁছে গেলাম, যা আমাদের ভ্রমণের অভিজ্ঞতাকে আরও আনন্দময় করে তোলে।’
তবে ঢাকা-বরিশাল আকাশপথে পর্যাপ্ত যাত্রী না পাওয়ায় নভোএয়ার এয়ারলাইনসের ফ্লাইট চলাচল বন্ধ হচ্ছে আগামী ১ আগস্ট থেকে। রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস ফ্লাইট কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে একই কারণে। দক্ষিণাঞ্চলবাসীর স্বপ্নের পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় বেড়েছে সড়কপথে যাত্রীদের যাতায়াত। ঢাকা থেকে মাত্র তিন ঘণ্টায় বরিশাল কেন্দ ীয় বাস টার্মিনালে আসতে পারছে যাত্রীরা। এ কারণে বরিশাল রুটে যাত্রী কমেছে আশঙ্কাজনক হারে। অন্যদিকে, যশোর রুটেও একই কারণে প্রতিনিয়ত যাত্রী কমছে।
রাজশাহীর বাসিন্দা নুসরাত জাহান উচ্চশিক্ষার জন্য ঢাকায় থাকেন। তিনি বলেন, ঈদের ছুটিতে বাড়ি যেতে বাসের টিকিটের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়াতে হতো, আর জ্যামে পড়ে কখন পৌঁছাব তার কোনো ঠিক ছিল না। তাই আমি গত ঈদের ৩ মাস আগে ঢাকা থেকে রাজশাহীর বিমান টিকিট কেটে রেখেছিলাম। তবে মজার বিষয়, ৩ থেকে ৪ মাস আগে টিকিট কেটে রাখলে টিকিটের দাম তুলনামূলক কম লাগে। খুব কম সময়ে যাওয়া যায় বলে পরিবারের সঙ্গে বেশি সময় কাটানো যায়।
ঢাকা-সৈয়দপুর, ঢাকা-রাজশাহী, ঢাকা-কক্সবাজার, ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-যশোরÑএই রুটে প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫টি ফ্লাইট চলচল করে। রোজকার কর্মব্যস্ত জীবনে সময়ের দাম যেহেতু বেশি, তাই অফিস ছুটি না নিয়েই কেউ কেউ সকালে গিয়ে রাতেই ফিরছেন।
শাফিন আহমেদ প্রায়ই অফিসের কাজে দেশের বিভিন্ন জেলায় যাতায়াত করেন। তিনি বলেন, ‘আগে সিলেট যেতে সারাটা দিন বাসের ধকলে কেটে যেত। এখন সকালের ফ্লাইটে গিয়ে কাজ শেষ করে দুপুরের মধ্যেই ঢাকায় ফিরে আসা যায়। এতে একদিকে যেমন আমার মূল্যবান সময় বাঁচছে, তেমনি শারীরিক ক্লান্তিও অনেক কমেছে। এখন বাসের ভাড়ার চেয়ে বেশি ভাড়া হলেও আমি বিমানকেই অগ্রাধিকার দিই।’
বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) তথ্যমতে, ২০১৫ সালে অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটে যাত্রী সংখ্যা ছিল প্রায় ১২ লাখ। ২০২৪ সালে তা দাঁড়ায় ২৭ লাখে। প্রায় দ্বিগুণের বেশি যাত্রী এখন দেশের অভ্যন্তরে ফ্লাইটে চলাচল করছেন।
দেশের একমাত্র সরকারি বিমান সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার মো. আল মাসুদ খান শেয়ার বিজকে বলেন, ‘এক দশক আগেও আমাদের অভ্যন্তরীণ রুটে যাত্রী সংখ্যা অনেক কম ছিল। তখন শুধু জরুরি প্রয়োজন বা উচ্চবিত্তের মানুষেরাই বিমানে যাতায়াত করতেন। কিন্তু গত ৫-৭ বছরে ভাড়ার কাঠামো পরিবর্তন, রুটে নতুন উড়োজাহাজ যুক্ত করা এবং অনলাইন টিকিট ব্যবস্থার উন্নতির কারণে যাত্রী সংখ্যা বহুগুণ বেড়েছে।’
তিনি বলেন, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানসম্পন্ন সেবার প্রতি তাদের আগ্রহ বাড়ছে। এছাড়া দেশের পর্যটন খাতের বিকাশও অভ্যন্তরীণ বিমান চলাচলে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। নতুন নতুন পর্যটন কেন্দ গড়ে ওঠা এবং সেগুলোয় সহজ যোগাযোগব্যবস্থা নিশ্চিত হওয়ায় পর্যটকরা বিমান ব্যবহারে উৎসাহিত হচ্ছেন।
দেশের বেসরকারি বিমান সংস্থা ইউএস-বাংলার ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার কামরুল ইসলাম শেয়ার বিজকে বলেন, আমাদের প্রতিষ্ঠান সবসময়ই যাত্রীদের সাধ্যের মধ্যে রেখে সর্বোচ্চ মানের সেবা প্রদানের অঙ্গীকারবদ্ধ। বিগত বছরগুলোয় নতুন প্রজন্মের অত্যাধুনিক উড়োজাহাজ আমাদের বহরে যুক্ত হয়েছে। ফলে ফ্লাইট অপারেশনে দক্ষতা বেড়েছে এবং জ্বালানি খরচ কমেছে। এই সাশ্রয় আমরা যাত্রীদের জন্য ভাড়া কমানোর মাধ্যমে প্রতিফলিত করতে পেরেছি।
তিনি বলেন, নতুন নতুন অভ্যন্তরীণ রুট চালু এবং ফ্লাইট ফ্রিকোয়েন্সি বৃদ্ধির ফলে যাত্রীদের জন্য আরও বেশি বিকল্প তৈরি হয়েছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের মধ্যে আকাশপথে ভ্রমণের আগ্রহ অপ্রত্যাশিতভাবে বাড়ায় অভ্যন্তরীণ রুটে আমাদের যাত্রী সংখ্যা রেকর্ড পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে।
দেশের বেসরকারি বিমান সংস্থা এয়ার অ্যাস্ট্রা এয়ারলাইনসের পাবলিক রিলেশনের ডেপুটি ম্যানেজার সাবিক হাসান শুভ বলেন, মধ্যবিত্ত শ্রেণির পেশাজীবী এবং ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ ভ্রমণের প্রবণতা বেড়েছে। ২০২৪ সালের আগস্ট মাসে যাত্রী সাময়িকভাবে কমে গিয়েছিল কিন্তু এখন প্রতিদিন যাত্রীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
তবে মধ্যবিত্ত যাত্রীদের অভিযোগন, ডিসকাউন্ট ফেয়ারের টিকিট খুব দ্রুত শেষ হয়ে যায় এবং অনেক সময় ফ্লাইট বাতিল বা দেরি হওয়ার ঘটনাও ঘটে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, একটি ফ্লাইটে সিট থাকে ৭০টি। এর মধ্যে ২০টি সিটের ওপর ডিসকাউন্ট ফেয়ার দেয়া হয়, এ জন্য টিকিট খুব দ্রুত শেষ হয়ে যায়।
দেশের বেসরকারি বিমান সংস্থা নভোএয়ারের মার্কেটিং অ্যান্ড মিডিয়া কমিউনিকেশন বিভাগের নির্বাহী কর্মকর্তা নিলাদ্রি মহারতœ শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আমরা লক্ষ্য করছি যে সাপ্তাহিক ছুটির দিনে বা দীর্ঘ ছুটির সময় পর্যটন কেন্দ গুলোয় আমাদের ফ্লাইটের চাহিদা থাকে আকাশচুম্বী। আমাদের ফ্রিকোয়েন্ট ফ্লায়ার প্রোগ্রাম এবং বিভিন্ন ধরনের প্রমোশনাল অফার মধ্যবিত্ত যাত্রীদের আকৃষ্ট করতে সাহায্য করছে। আমরা সময়ানুবর্তিতা এবং নির্ভরযোগ্যতার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিই, যা যাত্রীদের আস্থা অর্জনে সহায়ক হচ্ছে।
জানা গেছে, গত ১৫-২০ বছর আগেও বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিমান পরিবহন খাত ছিল অত্যন্ত সীমিত পরিসরের। তখন অভ্যন্তরীণ রুটে হাতেগোনা কয়েকটি ফ্লাইট পরিচালিত হতো এবং টিকিটের মূল্য ছিল অনেক বেশি। সাধারণ মানুষের কাছে বিমান ভ্রমণ ছিল বিলাসী বিষয়, যা কেবল সমাজের উচ্চবিত্ত এবং জরুরি প্রয়োজনে বিদেশগামী যাত্রীরাই ব্যবহার করতেন। সে সময় রাষ্ট্রীয় বিমান সংস্থা ‘বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস’-এর একচেটিয়া আধিপত্য ছিল এবং বেসরকারি খাতের তেমন কোনো শক্তিশালী উপস্থিতি ছিল না। ফলে প্রতিযোগিতার অভাবে ভাড়া কমানোর বা সেবার মান বাড়ানোর তাগিদও কম ছিল।
সাম্প্রতিক দশকগুলোয় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি মধ্যবিত্ত শ্রেণির আয় বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়েছে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ার সঙ্গে জীবনযাত্রার মানও উন্নত হয়েছে। এর ফলে তারা এখন যাতায়াতের জন্য দ্রুত এবং আরামদায়ক মাধ্যম হিসেবে বিমানকে বেছে নিচ্ছেন।
বেসরকারি বিমান সংস্থাগুলোর আগমন এবং তাদের মধ্যে সুস্থ প্রতিযোগিতা ভাড়ার ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। প্রতিটি সংস্থা এখন যাত্রীদের আকৃষ্ট করতে সাশ্রয়ী অফার, বিশেষ প্যাকেজ এবং উন্নত যাত্রীসেবায় জোর দিচ্ছে।
তাছাড়া টিকিট বুকিং এখন আর আগের মতো এজেন্সিনির্ভর নয়। মোবাইল অ্যাপ, বিকাশ, নগদ, রকেটÑসব মাধ্যমেই এখন সরাসরি টিকিট কাটা যায়। ফলে সহজ হয়েছে প্রক্রিয়া, স্বচ্ছতা বেড়েছে এবং তা মধ্যবিত্তদের আকর্ষণ করেছে।

Discussion about this post