অরণ্য আজাদ : মাছের আঁশ সাধারণত উচ্ছিষ্ট বা বর্জ্য হিসেবে বিবেচনা করে ফেলে দেয়া হয়। তবে সেই আঁশ এখন দেশে বৈদেশিক মুদ্রা আনতে শুরু করেছে, যা দিন দিন বাড়ছে। বর্তমানে প্রতি বছর ২০০ কোটি টাকার বেশি মাছের আঁশ রপ্তানি করা হচ্ছে। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে প্রতি বছর হাজার হাজার টন আঁশ রপ্তানি হয় জাপান, চীন, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশগুলোয়। প্রতি টন আঁশ ৩৫০ থেকে ৪৭০ ডলারে বিক্রি হয়।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) এক জরিপে অনুসারে, ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ১৪ দশমিক ৯৯ মিলিয়ন ডলারের মাছের আঁশ ও বর্জ্য রপ্তানি হয়েছে, যার বেশিরভাগই মাছের আঁশ।
তার পর থেকে বাংলাদেশ থেকে বছরে গড়ে ২০০ কোটি টাকার মাছের আঁশ রপ্তানি হচ্ছে। তবে ২০২০ সাল থেকে রপ্তানির পরিমাণ বেড়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সালে রপ্তানি ১৭ মিলিয়ন ডলার বা ২০৬ কোটি টাকায় পৌঁছেছে।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য তথ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ভোলজার বৈশ্বিক আমদানি তথ্য অনুসারে, ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশ ৩৯ জন আন্তর্জাতিক ক্রেতার কাছে মাছের আঁশের ২০৮টি চালান রপ্তানি করেছে। ১৭ বাংলাদেশি রপ্তানিকারক এই আঁশ সরবরাহ করেছেন। এই হার আগের ১২ মাসের তুলনায় চার শতাংশ বেশি। এই সময়ের মধ্যে শুধু ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসেই বিশ্ব বাংলাদেশ থেকে মাছের আঁশের ১২টি চালান নিয়েছে। এটি ২০২৩ সালের জানুয়ারির তুলনায় ৩৩ শতাংশ বেশি এবং ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের তুলনায় ১২ শতাংশ বেশি। বিশ্বের বেশিরভাগ মাছের আঁশই চীন, ভিয়েতনাম ও ভারত থেকে রপ্তানি হয়।
বিশ্বে মাছের আঁশের শীর্ষ তিন আমদানিকারক হলো যুক্তরাষ্ট্র, ইউক্রেন ও পেরু। ২ হাজার ১৮৪টি চালান নিয়ে মাছের আঁশ আমদানিতে শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, ৯৫৩টি চালান নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ইউক্রেন এবং ৬৮৬টি চালান নিয়ে পেরু আছে তৃতীয় স্থানে।
প্রায় এক যুগ ধরে মাছের আঁশ কিনে দেশের বাইরে রপ্তানি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত থাকা যশোরের মো. কামরুজ্জামান জানান, দেশের দক্ষিণ ও উত্তরাঞ্চলের সব জেলা থেকে তিনি মাছের আঁশ সংগ্রহ করেন। মাসে অন্তত ১০ টন আঁশ রপ্তানি করেন তিনি। এই ব্যবসায়ী বলেন, আগে উদ্যোক্তারা মাছের আঁশ ভালোভাবে প্রক্রিয়াজাত করতে পারতেন না। পরে স্থানীয় এনজিও প্রোগ্রাম ফর কমিউনিটি ডেভেলপমেন্টের (পিসিডি) মাধ্যমে প্রশিক্ষণ, সহায়তা ও প্রযুক্তির মাধ্যমে বিশেষ প্রক্রিয়ায় তৈরি করায় পণ্যের মান ভালো হয়। এখন দামও পাওয়া যায় বেশি।
এসব আঁশ কিনে তিনি বিভিন্ন পক্ষের মাধ্যমে চীন, জাপান ও কোরিয়ায় রপ্তানি করেন।
পাবনার সদর উপজেলার রানীগ্রামের মর্জিনা খাতুন বছর চারেক আগেও অন্যের বাড়িতে গৃহসহায়ক হিসেবে কাজ করতেন। তবে বাড়িতেই মাছের আঁশ আর বর্জ্যে করেছেন কর্মের সংস্থান। এখন আঁশ-বর্জ্য বিক্রির আয় দিয়েই চলে তার সংসার।
মর্জিনা জানান, এখন তার স্বামী ও প্রতিবন্ধী ছেলে স্থানীয় বাজারে মাছের ব্যবসা করেন। তারা বাজার থেকে মাছের ভেজা আঁশ আর বর্জ্য কিনে আনেন। সেগুলো পরিষ্কার করে শুকিয়ে বিক্রি করেন ব্যবসায়ীদের কাছে। আঁশ বিক্রি করে তাদের মাসে ৩০ হাজার টাকার বেশি আয় হয়।
সেই অর্থে একসময়কার সহায়-সম্বলহীন মর্জিনা এখন জমি কিনে বাড়ি করেছেন। করছেন নিজের পুকুরে মাছ চাষ। বাড়ির উঠান ঘেঁষে কিনেছেন এক বিঘা জমিও। ভবিষ্যতে মাছের আঁশ ব্যবসার মাধ্যমে গ্রামের নারীদের কর্মসংস্থানের স্বপ্ন দেখছেন মর্জিনা।
বিশেষজ্ঞরা জানান, মাছের আঁশের বিশ্বব্যাপী নানা ধরনের ব্যবহার রয়েছে। মাছের আঁশে থাকে কোলাজেন, যা খাদ্য, ওষুধ, ফুড সাপ্লিমেন্ট ও কসমেটিকস শিল্পে ব্যবহার করা হয়। কোলাজেন নামক একটি পণ্য বিক্রি হয় ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে। চীন ও জাপানে এ আঁশ ব্যবহার করে বায়ো পাইজোইলেকট্রিক ন্যানো জেনারেটর তৈরি করা হয়, যেগুলো দ্বারা রিচার্জেবল ব্যাটারিতে চার্জ দেয়া যায়। ঘরোয়া বিদ্যুৎ উৎপাদনেও এটি ব্যবহƒত হয়ে থাকে। এ ছাড়া মাছের আঁশ ব্যাটারি তৈরি, বৈদ্যুতিক পণ্য, কৃত্রিম কর্নিয়া, মাছ ও পোলট্রি খাদ্য হিসেবে ব্যবহার হয়।
মৎস্য গবেষকেরা বলছেন, সাধারণত একটা মাছের দৈহিক ওজনের ২০ থেকে ২৫ শতাংশ বর্জ্য হিসেবে ধরা হয়। আর কৃষিবিজ্ঞানী ও মৎস্য গবেষকেরা বলছেন, মাছের শরীরজুড়ে বিস্তৃত আবরণ হলো আঁশ, যা মাছ কাটার পর সাধারণত ফেলে দেয়া হয়। আগে এসব বর্জ্য যেখানে-সেখানে ফেলে পরিবেশ দূষণ হতো। কিন্তু এই মাছের আঁশ আর বর্জ্য অর্থনৈতিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই আঁশ আর বর্জ্য আমিষ ও ক্যালসিয়ামে ভরপুর। মাছের আঁশে সাধারণত ৬৫ থেকে ৬০ শতাংশ আমিষ ও ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ হাইড্রক্সিঅ্যাপাটাইট থাকে। দুটি উপাদানই মানবদেহের জন্য অত্যন্ত উপকারী।
মৎস্য অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘মাছের আঁশের নানা ধরনের ব্যবহার রয়েছে। জিন্স প্যান্ট ও গ্যাভার্ডিন কাপড়ের ওপর এক ধরনের আঠার প্রলেপ দেয়া হয়, যার ফলে কাপড়ের ঔজ্জ্বল্য বৃদ্ধি পায়। ক্যাপসুলের খোসা ও প্রসাধন সামগ্রী তৈরিতেও মাছের আঁশ ব্যবহার করা হয়। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে এ আঁশ নিয়ে বিভিন্ন সময় গবেষণা করে সফল হয়েছে।’
শের-ই-বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বায়োলজি অ্যান্ড জেনেটিক্স বিভাগের অধ্যাপক কাজী আহসান হাবীব বলেন, মাছের আঁশ প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে কোলাজেন (সোডিয়াম, সালফার, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস ও ম্যাগনেসিয়াম রয়েছে এতে), কোলাজেন পেপটাইড, হাইড্রোক্সিঅ্যাপাটাইট, জৈবসার, ওষুধের ক্যাপসুল আবরণ, কসমেটিকসসহ বিভিন্ন ধরনের উচ্চমূল্য দ্রব্য উৎপাদন করা সম্ভব। কোলাজেন হাড়, ত্বক ও প্রাণীর সংযোগকারী টিস্যুতে উপস্থিত একটি তন্তুযুক্ত প্রোটিন। মাছের আঁশ দেশে প্রক্রিয়াজাত করা গেলে অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হবে। ইতিবাচক প্রভাব পড়বে অর্থনীতিতে।
দেশের গ্রামীণ অর্থনীতির কাঠামো দৃঢ় করতে পাবনা, সিরাজগঞ্জ, রাজশাহী, নওগাঁসহ ২৩ জেলার ৪৯টি উপজেলায় মাছ চাষ, মাছের আঁশ ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে উদ্যোক্তা তৈরিতে দেশজুড়ে রুরাল মাইক্রোএন্টারপ্রাইজ ট্রান্সফরমেশন প্রজেক্টের মাধ্যমে উচ্চমূল্যের পণ্য তৈরি ও বাজারজাতকরণে কাজ করছে বিভিন্ন এনজিও।
এই খাতে দেড় লাখের বেশি মানুষ জড়িত রয়েছেন। তাদের মধ্যে ৫০ হাজারের বেশি নারী। এই প্রকল্পে অর্থায়ন করছে আন্তর্জাতিক কৃষি উন্নয়ন তহবিল, পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) ও ডানিডা।
পিকেএসএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ফজলুল কাদের জানান, দেশে মাছের আঁশের অর্থনৈতিক বাজার ২৫০ কোটি টাকার ওপরে। শত শত উদ্যোক্তা এই শিল্পে জড়িত।
তিনি বলেন, মাছের আঁশ দিয়ে চীনারা জিলাটিন তৈরি করে খাদ্য ও ওষুধশিল্পে কাজে লাগায়। ‘আমরা সেসব পণ্য ছয়গুণ দামে আমদানি করি। তবে আশার কথা, আমরাও মাঝারি পর্যায়ে উৎপাদনকারী তৈরির পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি। তাদের মাধ্যমে আগামীতে আঁশ থেকে দেশেই পণ্য তৈরি করতে চাই। এ শিল্পের জন্য স্থানীয় উদ্যোক্তাদের মধ্যে অনেকে আগ্রহও প্রকাশ করেছেন। এটি করা গেলে দেশের অর্থনীতি আরও শক্তিশালী হবে।
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির নিউট্রিশন অ্যান্ড ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের সহকারী অধ্যাপক মো. হারুন-অর রশীদ, যিনি মাছের আঁশ থেকে বিভিন্ন খাদ্য উপাদান তৈরির প্রযুক্তি উদ্ভাবন নিয়ে পিএইচডির গবেষণা করছেন, তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে মাছের আঁশ থেকে বিভিন্ন উপাদান তৈরির সুযোগ রয়েছে, যার মাধ্যমে পরিবেশের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব না ফেলেও অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়া যাবে। কিন্তু এর মূল অন্তরায় হচ্ছে প্রযুক্তির অপ্রতুলতা বা প্রযুক্তি উদ্ভাবনের গবেষণার অভাব, বাজারে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান সৃষ্টির জন্য সহযোগিতার অভাব সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের এ সেক্টরে বিনিয়োগের সংস্কৃতি তৈরি না হওয়া।’