আলী ওসমান শেফায়েত : মাদকাসক্তি বর্তমান বিশ্বের এক ভয়াবহ সমস্যা, যা তরুণ প্রজন্মকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে। জাতিসংঘের পক্ষ থেকে ১৯৯১ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত পুরো একটি দশককে ‘মাদকবিরোধী দশক’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল এবং ২৬ জুনকে ‘মাদক বিরোধী দিবস’ হিসেবে পালিত হয়। কিন্তু এতকিছুর পরও মাদকের আগ্রাসী থাবা থেকে আমরা মুক্তি পাচ্ছি না, বরং এর বিস্তার ক্রমেই বাড়ছে। সম্প্রতি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) সমীক্ষা অনুযায়ী, বাংলাদেশে মাদকাসক্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় ৮৩ লাখ, যা দেশের মোট জনসংখ্যার ৪ দশমিক ৮৯ শতাংশ। এই পরিসংখ্যান আমাদের জন্য এক গভীর উদ্বেগের কারণ।
মাদকাসক্তি কী: আধুনিক গবেষণায় মাদকাসক্তিকে মস্তিষ্কের একটি ডিসঅর্ডার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এটি মস্তিষ্কের চিন্তা প্রক্রিয়া, ডোপামিন নিঃসরণের মাধ্যমে ভালো লাগার অনুভূতি এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে। দীর্ঘমেয়াদি মাদকাসক্তি মস্তিষ্কের স্থায়ী পরিবর্তন ঘটায় এবং মৃত্যু পর্যন্ত ডেকে আনতে পারে। এমনকি দীর্ঘদিন মাদক থেকে দূরে থাকলেও মস্তিষ্কের এই পরিবর্তনগুলো পুরোপুরি সেরে ওঠার সম্ভাবনা কম থাকে, যার ফলে চিকিৎসা পরবর্তী সময়েও আবার আসক্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। তাই উন্নত চিকিৎসা পদ্ধতির মাধ্যমে মাদকাসক্তি নির্মূল করা অত্যন্ত জরুরি।
মাদকাসক্তির মূল কারণ: মানুষ কেন মাদকের প্রতি আসক্ত হয়, এর পেছনে রয়েছে অসংখ্য কারণ। মাদকের ক্ষণিকের ভালো লাগার অনুভূতি, আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি বা মানসিক চাপ কমানোর ক্ষমতা অনেককে এর দিকে আকৃষ্ট করে। তবে এর মূল কারণগুলো বেশ জটিল ও বহুমুখী—
১. মাদকের সহজলভ্যতা: দেশে প্রায় সকল প্রকার মাদক, যেমন সিগারেট, গাঁজা, হেরোইন, মদ, ফেনসিডিল ও ইয়াবা সহজেই পাওয়া যায় এবং এগুলোর মূল্যও তুলনামূলকভাবে কম, যা উপার্জনক্ষম থেকে শুরু করে বেকার ও শিক্ষার্থীদেরও আকৃষ্ট করে।
২. সঙ্গদোষ: মাদকাসক্ত বন্ধুদের প্রভাবে ভালো ও মেধাবী শিক্ষার্থীরাও মাদকের পথে পা বাড়াচ্ছে। বর্তমান সমাজে এটি একটি প্রকট সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
৩. সামাজিক ও পারিবারিক অবস্থা: পারিবারিক অনুশাসনের অভাব এবং অস্থির সামাজিক পরিবেশ মাদকাসক্তির একটি বড় কারণ। বস্তিগুলোতে শিশুরা অনেক সময় মাদকাসক্ত পরিবেশে বেড়ে ওঠে এবং অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ে।
৪. হতাশা ও দুশ্চিন্তা: তরুণদের মধ্যে হতাশা, দুশ্চিন্তা, কাজের ব্যর্থতা, প্রিয়জনের সঙ্গে বিচ্ছেদ বা পারিবারিক অশান্তি মাদকাসক্তির অন্যতম কারণ। তারা মনে করে, মাদক এসব মানসিক চাপ থেকে সাময়িক মুক্তি দিতে পারে, যা আসলে তাদের আরও গভীর সংকটে ফেলে দেয়।
৫. নিছক আনন্দ ও কৌতূহল: অনেক কিশোর-কিশোরী কৌতূহলবশত বা নিছক স্মার্টনেস দেখানোর জন্য মাদক গ্রহণ শুরু করে। তারা ভাবে, নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে; কিন্তু অজান্তেই মাদকের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।
ফাওলারের ২০০৭ সালের গবেষণা দেখা যায়, মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের মস্তিষ্কের স্মৃতিকেন্দ্র, সিদ্ধান্ত নেয়ার অংশ এবং আচরণ নিয়ন্ত্রণের অংশ স্বাভাবিক মানুষের থেকে ভিন্ন হয়, যা মাদক নিরাময় পদ্ধতির উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
পৃথিবীতে মাদকের বিস্তার
আফিম, যা পপি ফুল থেকে তৈরি হয়, খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০ সাল থেকে ব্যথা কমানো এবং আনন্দদায়ক অনুভূতি তৈরি করতে ব্যবহূত হয়ে আসছে। উনিশ শতকে আফিম থেকে ‘মরফিন’ এবং পরে পরীক্ষাগারে ‘হেরোইন’ তৈরি হয়। গত শতকের ৮০ ও ৯০-এর দশকে ওষুধ কোম্পানিগুলো ব্যথানাশক হিসেবে মরফিনজাতীয় দ্রব্যের ব্যাপক প্রচলন ঘটায়, যার নেশাসৃষ্টিকারী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া গোপন রাখা হয়েছিল। এই মাদকের কবলে পড়ে হাজার হাজার মানুষ।
আফিমজাতীয় মাদক মস্তিষ্কের কোষে ব্যথার অনুভূতি জাগানো এন্ডোরফিনের রিসেপ্টর বন্ধ করে দেয় এবং ডোপামিন ও অ্যাড্রেনালিন তৈরিতে সাহায্য করে, যা এক ধরনের ভালো লাগার অনুভূতি সৃষ্টি করে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মস্তিষ্কের কোষে এই পদার্থের প্রতি সহনশীলতা বাড়ে, ফলে একই অনুভূতি পেতে আরও বেশি মাদকের প্রয়োজন হয় এবং আসক্তি জন্মায়। মাদক ব্যবহার বন্ধ করলে পেশী ব্যথা, বমি, জ্বর, উচ্চ রক্তচাপ, ডিপ্রেশন-সহ নানা সমস্যা দেখা দেয়, যা কাটানো বেশ কষ্টকর।
শিশু ও মাদকাসক্তি: আমাদের দেশে ছোট শিশুদের মধ্যেও মাদকাসক্তির প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। একটি জরিপে দেখা গেছে, ৭-১১ বছর বয়সী এক হাজার শিশুর মধ্যে দুজন মাদক সেবনকারী। এই বয়সে শিশুরা সাধারণত পরিবার ও সামাজিক পরিবেশের কারণে মাদকাসক্ত হয়। বস্তি এলাকায় অনেক শিশু মাদক চোরাচালানসহ নানা অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ে এবং মাদকাসক্ত হয়ে ওঠে। জিনগত প্রভাবও মাদকাসক্তির কারণ হতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, ৪০-৬০ শতাংশ ক্ষেত্রে এপিজেনেটিক্স এবং পরিবেশগত প্রভাব একজন ব্যক্তির মাদকাসক্তির কারণ হিসেবে কাজ করে।
বয়সের সঙ্গে নেশার সম্পর্ক
মাদকাসক্তির ব্যাপকতা বর্তমানে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। সাধারণত ছোট অবস্থায় পারিবারিক অনুশাসন এবং মাদকের সহজলভ্যতা না থাকায় শিশুদের মধ্যে মাদকের ব্যবহার কম দেখা যায়। অন্যদিকে মাদকাসক্তদের গড় আয়ু স্বাভাবিক মানুষের চেয়ে কম হওয়ায় অনেকেই বার্ধক্যে পৌঁছানোর আগেই মারা যান। তাই মাদকসেবীদের মধ্যে বৃদ্ধের হার কম। বর্তমানে বাংলাদেশে মাদকাসক্তদের মধ্যে মাত্র ৩৭ শতাংশ শিশু ও বৃদ্ধ, আর ৬৩ শতাংশই তরুণ ও কিশোর-কিশোরী। ১৮ বছরের বেশি বয়সী ৩ দশমিক ৩ শতাংশ এবং ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সী ১ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ মাদকসেবী।
মাদক গ্রহণে ক্ষতি: মাদক গ্রহণ স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এটি কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ, স্ট্রোক, ফুসফুসের ক্যানসার, মুখের ক্যানসার এবং এমনকি এইচআইভির মতো রোগের কারণ হতে পারে। গর্ভকালীন সময়ে মায়ের মাদক সেবন শিশুর এনএএস (Neonatal Abstinence Syndrome) জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। কিছু মাদক গর্ভাবস্থায় সন্তানের মস্তিষ্কের বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে অটিজমের কারণ হতে পারে। দুগ্ধদানকালীন সময়েও কিছু মাদক দুধের মাধ্যমে শিশুর দেহে প্রবেশ করে ক্ষতি করতে পারে।
ইনজেকশনের মাধ্যমে মাদক গ্রহণ এইডস এবং হেপাটাইটিস সি সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ায়। প্রতি ১০ জন এইডস রোগীর মধ্যে ১ জন ইনজেকশনের মাধ্যমে আক্রান্ত হন। মাদক গ্রহণ করে গাড়ি চালানোর ফলে প্রতি বছর অসংখ্য দুর্ঘটনা ঘটে, কারণ মাদকের প্রভাবে প্রতিক্রিয়া সময় বেড়ে যায় এবং বিপদ এড়ানো কঠিন হয়ে পড়ে।
মাদকাসক্তিজনিত সামাজিক ক্ষতি: একজন মাদকসেবীর আশেপাশে থাকা মানুষও এর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অন্যের সেবন করা মাদকের ধোঁয়া গ্রহণ করাকে প্যাসিভ স্মোকিং বলা হয়, যা শিশুদের ব্রঙ্কাইটিস, অ্যাজমা এবং নিউমোনিয়ার কারণ হতে পারে। প্যাসিভ স্মোকিং অনেক সময় সরাসরি ধূমপানের চেয়েও বেশি ক্ষতিকর। শৈশবে প্যাসিভ স্মোকিংয়ের শিকার হলে বড় হওয়ার পর তাদের ধূমপানের সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমও মাদকের বিস্তারে ভূমিকা রাখে। সহপাঠী ও আশেপাশের মানুষের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অনেকে মাদক গ্রহণকে স্বাভাবিক বিষয় মনে করে। যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয় কিশোর-কিশোরীদের সিগারেট কেনার প্রবণতা পাঁচগুণ এবং মদ্যপানে আসক্তির সম্ভাবনা তিনগুণ বেশি।
মাদকাসক্তের চিকিৎসা: গবেষণার মাধ্যমে প্রাপ্ত কিছু পদ্ধতি মাদকমুক্ত জীবনযাপনে সাহায্য করতে পারে, তবে অন্যান্য জীবাণুঘটিত রোগের মতো মাদকের কারণে সৃষ্ট ডিসঅর্ডার পুরোপুরি নিরাময় করা যায় না। সামান্য অসতর্কতায় রোগী আবার আসক্ত হতে পারে। চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে না চললে আবার আসক্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। মাদকের চিকিৎসা সাধারণত দুই ধাপে হয়—
১. প্রাথমিক চিকিৎসা: প্রথমবার মাদক ছাড়ার পর রোগীর শারীরিক ও মানসিক অবস্থার অবনতি ঘটে। ডিপ্রেশন, ঘুম না হওয়া, উচ্চ রক্তচাপ, দুশ্চিন্তা—এসব উপসর্গ দেখা দেওয়া খুবই স্বাভাবিক। চিকিৎসক প্রথমে এসব উপসর্গের চিকিৎসা করেন। রোগী বারবার মাদক গ্রহণে বাধ্য হলে সাইকোথেরাপি কার্যকর ভূমিকা রাখে।
২. পুনর্বাসন ও প্রতিরোধমূলক থেরাপি: বারবার মাদকের কাছে ফিরে যাওয়া রোগীদের জন্য বিশেষ থেরাপি এবং কিছু ক্ষেত্রে ওষুধের সাহায্য নেয়া হয়। আফিমজাতীয় মাদকের জন্য মেথাডোন, বিউপ্রেনরপাইন, নাল্ট্রেক্সোন, লোফেক্সিডিন এবং তামাকজাতীয় মাদকের জন্য বিউপ্রপিওন, ভারেনিক্লিন-জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করা হয়।
বর্তমান পরিস্থিতি ও চ্যালেঞ্জ: মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০১৯ সালে প্রতিদিন ১১৪ জন মাদক নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসা নিয়েছিল, যা ২০১৭ সালে ছিল মাত্র ৬৯ জন। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী এবং মিয়ানমার থেকে ইয়াবা চোরাচালান বাড়ার কারণে এই সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। দেশের বাজারে ইয়াবার একটি পিল ৩৫০ টাকার বেশি হলেও রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভেতরে ৫০ টাকায় পাওয়া যায়। এই পরিসংখ্যান মাদকের ভয়াবহ বিস্তারকে নির্দেশ করে।
২০১৮ সালের ৪ মে বাংলাদেশ মাদক নিয়ন্ত্রণের জন্য যুদ্ধ ঘোষণা করে। তবে সুইজারল্যান্ড ও পর্তুগালের মতো দেশ দেখিয়েছে, মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ মাদকের ব্যবহার কমাতে খুব একটা কার্যকর নয়। বরং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা এবং উন্নত চিকিৎসার মাধ্যমে এর মোকাবিলা করা বেশি জরুরি।
মাদকাসক্তির এই আগ্রাসী থাবা নিয়ন্ত্রণের জন্য বাংলাদেশে বেশ কিছু ব্যবস্থা নেয়া হলেও তা যথেষ্ট নয়। ২৩টি জেলায় এখনো কোনো মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র তৈরি হয়নি। এছাড়া বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মাদকাসক্তকে সাহায্য করার বদলে নিরাময় কেন্দ্রগুলোয় রোগীকে শিকল দিয়ে বেঁধে নির্যাতনের ঘটনাও সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে, যা অত্যন্ত দুঃখজনক।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) হাসান মারুফ হোসেন সম্প্রতি স্বীকার করেছেন, অধিদপ্তরের সীমিত সম্পদ ও সুবিধা দিয়েই নিরাময় ও পুনর্বাসন কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।
দেশের মাদক পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক। মাদকাসক্তদের মধ্যে ৭৭ লাখ ৬০ হাজার পুরুষ, ২ লাখ ৮৫ হাজার নারী এবং ২ লাখ ৫৫ হাজার শিশু-কিশোর অন্তর্ভুক্ত। প্রায় ৬১ লাখ গাঁজা, ২৩ লাখ ইয়াবা ও ২০ লাখ ২৪ হাজার মদ্যপানে আসক্ত। ৩ লাখ ৪৬ হাজারের বেশি মানুষ ফেনসিডিল ও সমজাতীয় মাদকে, ৩ লাখ ২০ হাজার মানুষ হেরোইনে এবং ৩ লাখ মানুষ ঘুমের ওষুধে আসক্ত। প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার মানুষ ড্যান্ডির মতো আঠা মাদক হিসেবে ব্যবহার করে। প্রায় ৩৯ হাজার মানুষ শিরায় মাদক গ্রহণ করে। এই সংখ্যাগুলো একই ব্যক্তির একাধিক মাদকে আসক্তির কারণে কিছু ক্ষেত্রে পুনরাবৃত্তি হওয়ায় মোট মাদকাসক্তের সংখ্যা ৮৩ লাখে এসে দাঁড়িয়েছে।
অরক্ষিত সীমান্ত এবং আন্তর্জাতিক মাদক চোরাচালানের রুটের কেন্দ্রে বাংলাদেশের অবস্থান মাদক পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। দেশের চারটি অঞ্চলের ১০৪টি ঝুঁকিপূর্ণ সীমান্ত পয়েন্ট চিহ্নিত করা হয়েছে, যা দিয়ে প্রতিনিয়ত মাদক দেশে প্রবেশ করছে। বড় মাদক ব্যবসায়ীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে এবং মাদক মামলার তদন্ত ও সাক্ষ্যদানে দুর্বলতার কারণে অনেক আসামি খালাস পেয়ে যাচ্ছে। ২০২৪ সালে ৩ হাজার ৬৯৮টি মাদক মামলার রায়ের ৫৫ শতাংশ মামলায় সব আসামি খালাস পেয়েছে, যা মাদক নিয়ন্ত্রণের দুর্বলতারই প্রমাণ।
মাদকের সর্বনাশা প্রভাব: মাদকের বিস্তারের ফলে তরুণদের জীবন নষ্ট হয়ে যায়, পরিবারে অশান্তি বাড়ে এবং মাদকাসক্তরা নানা ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। তারা নানা রোগে আক্রান্ত হয় এবং তাদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনে বিপুল অর্থ ব্যয় হয়। জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়নবিষয়ক সংস্থা আঙ্কটাডের ২০২৩ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে মাদকের কারণে প্রতিবছর ৪৮ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার (৫ হাজার ৯০০ কোটি টাকা) পাচার হয়ে যায়। মাদক কেনাবেচা করে অর্থ পাচারের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে পঞ্চম।
মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসার জন্য বিশেষায়িত চিকিৎসাকেন্দ্রের অভাব রয়েছে। ঢাকার কেন্দ্রীয় মাদক নিরাময় কেন্দ্রসহ চারটি বিভাগীয় শহরের চারটি কেন্দ্রে একসঙ্গে মাত্র ১৯৯ রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব। এছাড়া স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে জাতীয় মানসিক হাসপাতালে ৫০টি শয্যা এবং পাবনা মানসিক হাসপাতালে ৩০টি শয্যা রয়েছে মাদকাসক্তিজনিত মানসিক রোগীদের জন্য। অর্থাৎ, সরকারি পর্যায়ে মাত্র ২৭৯ জন রোগীকে একসঙ্গে সেবা দেওয়া যায়। বেসরকারি পর্যায়ে ৩৮৭টি মাদক নিরাময় কেন্দ্র থাকলেও তা অপ্রতুল। নতুন করে সরকারিভাবে ঢাকায় ২৫০ শয্যার এবং দেশের বাকি সাতটি বিভাগে ২০০ শয্যাবিশিষ্ট আরও সাতটি পূর্ণাঙ্গ মাদকাসক্তি নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
প্রতিকার ও করণীয়: মাদকাসক্তি প্রতিরোধে এবং এর প্রতিকারে আমাদের সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। ‘একটা সমস্যাকে প্রতিকার করার চেয়ে সেটাকে প্রতিরোধ করাই উত্তম’ এই উক্তিটি মাদকের ক্ষেত্রে অত্যন্ত প্রযোজ্য।
১. প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা জোরদার করা
সচেতনতা বৃদ্ধি: শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পরিবার এবং গণমাধ্যমের মাধ্যমে মাদকের ভয়াবহতা সম্পর্কে ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে মাদকের ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরতে হবে।
মাদকের সহজলভ্যতা কমানো: মাদকের সরবরাহ বন্ধ করতে সীমান্ত সুরক্ষা জোরদার করতে হবে এবং চোরাচালান চক্রকে ভেঙে দিতে হবে। মাদক ব্যবসায়ীদের, বিশেষ করে গডফাদারদের আইনের আওতায় আনতে হবে।
সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধন সুদৃঢ় করা: পরিবারে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে এবং সন্তানদের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। সুস্থ বিনোদন ও খেলাধুলার সুযোগ তৈরি করে তরুণদের বিপথগামী হওয়া থেকে রক্ষা করতে হবে।
মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা: হতাশা, দুশ্চিন্তা বা মানসিক চাপের শিকার তরুণদের জন্য পর্যাপ্ত মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা ও কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।
২. চিকিৎসা ও পুনর্বাসন ব্যবস্থার উন্নয়ন
যথেষ্টসংখ্যক নিরাময় কেন্দ্র স্থাপন: সারাদেশে পর্যাপ্ত আধুনিক মাদক নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি উভয় পর্যায়ে এই উদ্যোগ নিতে হবে।
বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ব্যবহার: নিরাময় কেন্দ্রগুলোয় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ও প্রশিক্ষিত জনবল নিশ্চিত করতে হবে, যাতে রোগীদের যথাযথ চিকিৎসা ও পুনর্বাসন করা যায়। কোনো প্রকার নির্যাতন বা অমানবিক আচরণ কাম্য নয়।
পুনরায় আসক্তি প্রতিরোধের ব্যবস্থা: মাদক থেকে মুক্তি পাওয়ার পর রোগীদের নিয়মিত ফলো-আপ এবং সামাজিক পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে তারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে এবং আবার আসক্ত হওয়ার ঝুঁকি কমে।
৩. আইন প্রয়োগ ও বিচারব্যবস্থার কার্যকারিতা বৃদ্ধি
সক্রিয় মাদকবিরোধী অভিযান: মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও কোস্টগার্ডের মধ্যে সমন্বয় বাড়িয়ে মাদকবিরোধী অভিযান জোরদার করতে হবে।
আইনের সঠিক প্রয়োগ: মাদক মামলার তদন্ত ও সাক্ষ্যদান প্রক্রিয়াকে আরও শক্তিশালী করতে হবে, যাতে বড় মাদক ব্যবসায়ীরা শাস্তি পায় এবং অপরাধীরা সহজেই খালাস না পায়।
মাদকের এই আগ্রাসী থাবা থেকে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করতে হলে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। এটি শুধু সরকারের একার কাজ নয়, বরং প্রতিটি পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে সম্মিলিতভাবে এই ভয়াবহ সমস্যার বিরুদ্ধে লড়তে হবে। মাদকমুক্ত একটি সুস্থ ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে আমাদের সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে।
মুক্ত লেখক

Discussion about this post