রেজাউল করিম খোকন : চব্বিশের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধে প্রথম একটি মামলার রায় হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ গতকাল সোমবার ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা করেছেন। অপর দুই আসামি সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানকে মৃত্যুদণ্ড ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক এবং এই মামলার রাজসাক্ষী চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। আদালত শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের সম্পত্তি বাজেয়াপ্তের আদেশ দেন। এছাড়া জুলাই আন্দোলনে ‘শহিদ ও আহতদের ক্ষতিপূরণ’ দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। এই রায় জুলাই অভ্যুত্থানে শহিদ পরিবারগুলোর জন্য স্বস্তির এবং ন্যায়বিচারের পথে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বলে প্রতীয়মান হয়েছে। গত বছরের জুলাই-আগস্ট মাসে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমন করতে গিয়ে বিচারবহির্ভূত ও নির্বিচার হত্যা, হামলা, মারাত্মক শারীরিক নির্যাতন, নির্বিচার গ্রেপ্তারের মতো অপরাধ ব্যাপক মাত্রায় সংঘটিত হয়েছিল। রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা নির্বিচার প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করেন। হেলিকপ্টার ব্যবহার করেও ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালানো হয়। এতে প্রায় দেড় হাজার মানুষ প্রাণ হারান। তাদের বেশির ভাগই প্রাণ হারান রাইফেল ও শটগানের গুলিতে। আহত হন ২০ হাজারের বেশি মানুষ, যাদের অনেকে চিরতরে অন্ধ হয়েছেন ও অঙ্গ হারিয়েছেন। গত ফেব্রুয়ারি মাসে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয়ের তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে আসে, জুলাই-আগস্টে আন্দোলন দমনে নিরাপত্তা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সমন্বয় কাজে নেতৃত্ব দিয়েছেন তখনকার প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। প্রতিবেদনে আরও ওঠে আসে, সাবেক সরকার এবং এর নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা কাঠামো আওয়ামী লীগের সহিংস গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে একত্র হয়ে মারাত্মক মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে পদ্ধতিগতভাবে জড়িয়ে পড়েছিল।
ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতেই শেখ হাসিনা রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলো ও দলীয় নেতাকর্মীদের আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে আইনবহির্ভূত বলপ্রয়োগের কাজে ব্যবহার করেছিলেন। পরপর তিনটি একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে যে চরম অগণতান্ত্রিক ও কর্তৃত্ববাদী শাসন তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেটাই এই মানবতাবিরোধী অপরাধের ক্ষেত্র রচনা করেছিল। এই রায় নিশ্চিতভাবেই বাংলাদেশের সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য একটি বড় শিক্ষা। যারা রাষ্ট্রক্ষমতায় রয়েছেন বা ভবিষ্যতে যাবেন, তাদের সবাইকে মনে রাখতে হবে, কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নন। পরাক্রমশালী এক প্রধানমন্ত্রী ও তার স্তাবকদের কেউই তাদের ঘুণাক্ষরেও ভাবেননি একদিন চোরের মতো পালাতে হবে নিজ বাড়ি থেকে, নিজ দেশ থেকে। গত বছরের ৫ আগস্ট যেদিন হাসিনা ও তার বোন চারটি সুটকেস হাতে নিয়ে দেশ ছাড়েন, তাদের মুখে হাসির জায়গায় স্থান পেয়েছিল ভীতি ও গভীর উদ্বেগ। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, তিনি সিদ্ধান্ত গ্রহণে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। লাখো জনতা গণভবনের দিকে এগিয়ে আসছে—এ কথা জানার পরও তার অনুগত সামরিক বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছিলেন ‘লেথ্যাল উইপন’ ব্যবহার করে বিক্ষোভ থামাতে। সেনাধ্যক্ষরা সম্মত হননি। শেষ চেষ্টা হিসেবে যোগাযোগ করা হলো বিদেশে অবস্থানরত তার ছেলে মার্কিন নাগরিক জয়ের সঙ্গে। তিনিও নাকি বলেছেন, ‘মা, আর বিলম্ব নয়।’ শোনা যায়, নিরুপায় হাসিনা নাকি হেলিকপ্টারে ওঠার আগে স্বগত স্বরে শুধু বলেছিলেন, ‘এত কিছু করলাম, এই তার প্রতিদান!’ হাসিনাই একমাত্র ক্ষমতাধর ব্যক্তি নন, জনতার রোষে যাকে পালাতে হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে পূর্ব জার্মানির এরিক হোনেকার, ইরানের শাহেনশাহ রেজা শাহ পাহলভি, ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট ফার্দিনান্দ মার্কোস অথবা আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনির কথা ভাবতে পারি। হাসিনার পতনের সঙ্গে কাছাকাছি মিল রয়েছে মার্কোসের। একটানা ২১ বছর একনায়ক হিসেবে দেশ শাসনের পর জনতার রোষে পতন হয় মার্কোসের।
ইতিহাস আমাদের শিক্ষা দিয়েছে যতই পরাক্রমশালী হও, ক্ষমতার অপব্যবহার তোমাকে সিংহাসন থেকে একসময় টেনে নামাবে সেই জনতা, যাদের নামে তুমি সিংহাসন দখল করেছ। এই পতন হবে দ্রুত, তুমি সামলে নেয়ার আগেই। রেজা শাহ, ফার্দিনান্দ মার্কোস বা শেখ হাসিনা প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই ক্ষমতার গতিপথ এবং তার ঊর্ধ্ব ও নিম্নরেখা, কার্যত অভিন্ন। তাদের হাতে রাষ্ট্র, সরকার ও নেতা হয়ে পড়েন এক ও অভিন্ন। তারা কেবল সব ক্ষমতার কেন্দ্রই নন, সব ক্ষমতার উৎসও বটে। একনায়কদের পতনের এটাই মূল কারণ। নেতা হয়ে ওঠেন সেই অক্ষ, যার চারদিকে সবকিছু ঘোরে। ফলে যখন সেই অক্ষ বিপদে পড়ে, তাকে বাঁচানোর জন্য এগিয়ে আসার আর কেউ থাকে না। শেখ হাসিনার কথা ভাবুন। এমন বিপুল ক্ষমতাধর মানুষ, অথচ বিপদ যখন ঘরের দোরগোড়ায়, তার পাশে কেউ নেই। এমনকি দীর্ঘ সময় ধরে যে সামরিক বাহিনীর ওপর ছিল তার পুরো নিয়ন্ত্রণ, বিপদের সময় তারাও উধাও। ক্ষমতাধরেরা শুধু নিষ্ঠুর শক্তির জোরেই ক্ষমতা আঁকড়ে থাকেন না, তাকে টিকে থাকতে একটি চমৎকার গল্প ফাঁদতে হয়। বাংলাদেশের হাসিনা, ইরানের শাহ, মিসরের হোসনি মোবারক অথবা রোমানিয়ার চসেস্কু তারা প্রত্যেকেই দেশের জন্য অপরিহার্য হিসেবে নিজেদের উপস্থিত করেছিলেন। নিজেকেই বাংলাদেশের সবকিছুর নিয়ন্তা ভাবতে শুরু করেছিলেন। এসব নেতার বলা গল্পগুলো ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বলার জন্য স্তাবকদের অভাব থাকে না। দেশের মানুষ সে গল্প বিশ্বাস করুক বা না করুক, এসব নেতা সম্ভবত এসব গালগপ্পো নিজেরা বিশ্বাস করতেন। পালানোর সময় হাসিনার বিস্মিত মুখটি স্মরণ করুন, তিনি বিশ্বাসই করতে পারেননি এই দেশের মানুষ, যাদের জন্য তিনি ‘প্রাণপাত’ করেছেন, তারাই চাইছিলেন তার পদত্যাগ।
কিন্তু একটা সময় আসে, যখন দেশের মানুষ বানিয়ে বানিয়ে বলা এই গল্প আর বিশ্বাস করতে চান না। রাজনৈতিক নিষ্পেষণের ভয় দেখিয়েও তাদের হাতে রাখা যায় না। ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের পক্ষে হয়তো সব সময় তাদের পতনের রেখাচিত্রটি সহজে ধরা পড়ে না। হাসিনার পতন এবং পরে বিচারের রায়ে তার ফাঁসির নির্দেশ থেকে এ কথা আমরা বলতে পারি কোনো নেতা বা নেত্রী, তা তিনি যত ক্ষমতাধরই হোন না কেন, অপরিহার্য নন। ভীতি অথবা মিথ্যা গালগপ্পো তার অনন্ত ক্ষমতা ধারণের কোনো নিশ্চয়তা নয়। জাতি হিসেবে এটা আমাদের জন্য ভীষণ দুর্ভাগ্যের এবং কলঙ্কের। সাম্প্রতিক সময়ের ইতিহাসে এই রাষ্ট্রের মাটিতে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। আবার আমাদের জন্য এটা ভীষণ গৌরবেরও একটা সত্যিকার গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আমরা সেই অপরাধকারীদের পতন ঘটিয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য করতে পেরেছি। অপরাধকারীদের পতনের পর জাতি হিসেবে আমাদের ওপরে সেই অপরাধের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার দায়িত্ব ন্যস্ত হয়েছে। প্রতিটি ন্যায়বিচার ভবিষ্যতে একই ধরনের অপরাধের ক্ষেত্রে নিবৃত্তকারী হিসেবে কাজ করে। শেখ হাসিনার অপরাধ এবং বিচার যেহেতু আন্তর্জাতিক মনোযোগ পেয়েছে, তাই একই ধরনের অপরাধ নিবৃত্তকারী হিসেবে এটার আন্তর্জাতিক প্রভাবও আছে। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ ছিল, সেগুলো নেহাত হত্যা কিংবা নির্যাতন না, এগুলো মানবতাবিরোধী অপরাধ। শুধু জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময়ই না, তার শাসনামলের পুরোটা সময় গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মতো অপরাধ সংঘটিত হয়েছে নিয়মিতভাবেই। এর বাইরেও বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপরে এবং একটা সময় পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামীর কর্মীদের ওপরেও পরিকল্পিতভাবে হেফাজতে নির্যাতন, গায়েবি মামলাসহ নানা রকম নিপীড়নও মানবতাবিরোধী অপরাধের আওতায় পড়বে। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে করা মামলার প্রথম মামলাটির রায়ে প্রত্যাশিতভাবেই পাঁচটি অভিযোগের মধ্যে তিনটির জন্য তিনি সর্বোচ্চ শাস্তি, মৃত্যুদণ্ড পেয়েছেন। বাকি দুটির জন্য পেয়েছেন আমৃত্যু কারাদণ্ড।
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গণ-অভ্যুত্থান এক অভাবনীয় উদাহরণ হয়ে থাকবে পৃথিবীর ইতিহাসে। কোনো রকম মারণাস্ত্র ছাড়া রাষ্ট্রীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে শুধু নৈতিক শক্তিকে পুঁজি করে নেমে যাওয়া মানুষের ওপরে অকল্পনীয় বর্বরতা চালানো হয়েছে। সেই বিক্ষোভ দমনে শেখ হাসিনা ঠান্ডা মাথায় মারণাস্ত্র ব্যবহার করতে নির্দেশ দিচ্ছেন এমন ফোন রেকর্ড আছে। আল-জাজিরা এবং বিবিসির মতো প্রতিষ্ঠান তাদের ডকুমেন্টারিতে সেই অডিও ব্যবহার করার জন্য নিজেরা ফরেনসিক টেস্ট করে নিশ্চিত হয়েছে সেটা তারই কল রেকর্ড; কোনো প্রযুক্তির সহায়তায় তৈরি করা নয়। শেখ হাসিনার প্রতিষ্ঠিত মাফিয়াতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যারা কোনো না কোনোভাবে যুক্ত ছিলেন, বিশেষ করে নিহত ব্যক্তিদের স্বজন, অন্ধ-বিকলাঙ্গ মানুষ, আহত ব্যক্তিদের নিশ্চয়ই বেশি নজর ছিল এই বিচারের প্রতি। তবে আমরা স্মরণ করব, এই অভ্যুত্থানে শুধু নয়, আওয়ামী শাসনের দীর্ঘ ১৫ বছর (বিশেষ করে অবৈধভাবে ক্ষমতায় থাকার সাড়ে ১০ বছর) বিরুদ্ধাচরণ করে নিপীড়নের শিকার অসংখ্য রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও অরাজনৈতিক ব্যক্তি এবং লুণ্ঠিত গণতন্ত্রের দেশে মানবাধিকার ও নাগরিক অধিকার বঞ্চিত হয়ে রীতিমতো প্রজায় পরিণত হওয়া কোটি কোটি মানুষেরও এই রায়ের প্রতি নজর ছিল। এই রায় নিশ্চয়ই ন্যায়বিচার নিশ্চিত করেছে। তবে প্রশ্ন আসতেই পারে, এই রায় কি শেষ পর্যন্ত প্রতীকী বিষয়ে পরিণত হবে?
শেখ হাসিনার জীবদ্দশায় তাকে দেশে এনে রায় কার্যকর করা যাবে, এই সম্ভাবনা এখনও দেখা যাচ্ছে না। ভারত সরকার যেভাবে তার আশ্রয় ও নিরাপত্তা বিধান করছে তাতে এটা প্রায় নিশ্চিত যে ভারত শেখ হাসিনাকে ফেরত দেবে না। ভারতের মানসিকতার প্রমাণ পেতে পারি স্বয়ং প্রধান উপদেষ্টাসহ বাংলাদেশ বারবার আপত্তি জানানোর পরও ভারত শেখ হাসিনাকে ক্রমাগত বাংলাদেশের বিরুদ্ধে উসকানিমূলক কথা বলায় বাধা দিচ্ছে না। এমনকি রায় ঘোষণার আগের দিনও তিনি তাঁর বক্তব্যে গণ-অভ্যুত্থানের শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে মারাত্মক সব হুমকি দিয়েছেন। মৃত্যুদণ্ডবিরোধী অবস্থানের কারণে জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে ফেরানোর জন্য ভারতের ওপর চাপ তৈরি করা প্রায় অসম্ভব হবে। তবে বাংলাদেশ সরকারের উচিত হবে সরাসরি ভারত সরকারের ওপর শেখ হাসিনাকে হস্তান্তরের জন্য চাপ তৈরি করা। ভারত সরকারকে ভাবতে হবে, তারা যদি শেখ হাসিনার সময়ের মতো শুধু একজন ব্যক্তি বা একটি দলের সঙ্গে সম্পর্ক না করে একটি টেকসই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক তৈরির জন্য বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করতে চায়, তাহলে শেখ হাসিনার ব্যাপারে তাদের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করতে হবে। আমরা আশা করতে পারি, সরকার, বিশেষ করে প্রধান উপদেষ্টা তার আন্তর্জাতিক অবস্থানকে ব্যবহার করে এসব চাপ সামাল দিতে পারবেন। জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনকে দিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করানো শেখ হাসিনার বিচারের ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের একটা অসাধারণ সিদ্ধান্ত হিসেবে বিবেচিত হবে। সেই তদন্তের রিপোর্টে সংস্থাটি জানিয়েছিল, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় বাংলাদেশে উচ্চমাত্রায় মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছিল। এসব অপরাধের সিদ্ধান্ত, নেতৃত্ব, পরিচালনা এবং সমন্বয়ের ক্ষেত্রে শেখ হাসিনাই ছিলেন প্রধান ব্যক্তি। সময়ই বলবে শেখ হাসিনাকে এনে রায় কার্যকর করা যাবে কিনা, তবে সেটা করা না গেলেও এই রায়ের মাধ্যমে এটা নিশ্চিত হলো শেখ হাসিনার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ এখানেই শেষ হচ্ছে। দল হিসেবে আন্তর্জাতিক আদালতে আওয়ামী লীগের বিচার হওয়ার কথা আলোচনায় আছে। আলোচনার সুবিধার জন্য যদি এটা ধরেও নিই যে, সেই বিচারে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে সংগঠন হিসেবে মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রমাণ না পেয়ে দলটিকে নিষিদ্ধ করা হলো না। তারপরও এটা বলতেই হচ্ছে যে, বয়স শেখ হাসিনার পক্ষে নেই। আর এই রায়ের পর সেই প্রেক্ষাপট তৈরি হলেও বাংলাদেশে ফিরে এসে শেখ হাসিনার পক্ষে দলের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করা এবং নেতৃত্ব দেয়া একেবারেই অসম্ভব হবে বলে মনে হয়। কিছু অডিও বক্তব্যের মাধ্যমে (তার পরাজিত চেহারা দেখাবেন না বলে তিনি ভিডিও বার্তায় আসবেন না সম্ভবত) তিনি হয়তো উসকানি দিয়ে যেতে পারবেন, যা আদতে তার দলের প্রতি নেতিবাচক প্রভাবই ফেলবে। শেখ হাসিনা এবং তার ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা মানুষদের অনেকটা চেনা আছে বলেই এটা অপ্রত্যাশিত নয় যে তিনিসহ সেই সময়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িতরা কোনোভাবে তাদের দায় স্বীকারের আশপাশেও যাবেন না। কিন্তু দলটির সমর্থকদের একটা বড় অংশ এখনো শেখ হাসিনা এবং তার সহযোগীদের অপরাধের মাত্রা এবং ব্যাপ্তি অনুধাবন করছেন না; এটা হতাশার। এই রায় সাধারণ সমর্থকদের মনে কিছু ভিন্ন চিন্তার উদ্রেক করবে বলে আশা করতে চাই আমরা।
মানুষ রাষ্ট্র তৈরি করেছিল এমন একটা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে, যার মাধ্যমে সব মানুষ কিছু নিয়মনীতির মধ্যে বসবাস করবে এবং এর ব্যত্যয় হলে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার মাধ্যমে রাষ্ট্র ও সমাজে নজির স্থাপিত হবে। কোনো রাষ্ট্র যদি ন্যায়বিচার করতে ব্যর্থ হয়, বিশেষ করে মানবতাবিরোধী অপরাধের মতো ক্ষেত্রে, সেটা সেই রাষ্ট্রের আর যেকোনো বিচার করার অধিকারকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের এই রায়কে কেন্দ্র করে গত কয়েক দিন কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের অনলাইনে ডাকা কর্মসূচি ঘিরে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় বাসে আগুন, চোরাগোপ্তা ককটেল বিস্ফোরণ, ব্যাংকে আগুন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পেট্রলবোমা, গাছ কেটে সড়ক অবরোধসহ নানা ধরনের নাশকতামূলক কর্মকা্লে জননিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। রায় ঘোষণার পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যাতে অবনতি না হয়, সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। নাশকতাকারীদের বিরুদ্ধে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অবশ্যই সজাগ ও কঠোর হতে হবে।
অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলাম লেখক
প্রিন্ট করুন







Discussion about this post