জাহিদ হাসান : মানুষের চিন্তার স্বাধীনতা তাকে জ্ঞানবান করে, তাকে অন্ধত্ব থেকে বের করে বাস্তবিকভাবে জ্ঞানী করে তোলে। এই মুক্তচিন্তার মাধ্যমেই মানুষ ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে অবাধ অনুসন্ধান করেছে, প্রশ্ন তুলেছে, মত প্রকাশ করেছে এবং বিজ্ঞান, দর্শন, রাজনীতি থেকে শুরু করে শিল্প-সাহিত্য পর্যন্ত সব ক্ষেত্রে নতুন পথ তৈরি করেছে। কিন্তু সমস্যাটি তখনই তৈরি হয়, যখন এই মুক্তচিন্তাকে কেউ নিজের অসহিষ্ণুতা, বিদ্বেষ বা অন্যের প্রতি অশ্রদ্ধার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে। বিশেষ করে ধর্মের ক্ষেত্রে মানুষের ব্যক্তিগত বিশ্বাসকে অবমাননার উদ্দেশ্যে যখন মুক্তচিন্তার নাম ব্যবহার করা হয়, তখন তা আর মুক্তচিন্তা থাকে না, তা হয়ে ওঠে কেবল সংঘাত সৃষ্টি করার উসকানিমূলক ভাষা। সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের সমাজে এক অদ্ভুত প্রবণতা দেখা যাচ্ছে—মুক্তচিন্তার নামে ধর্মকে হেয় করা, ধর্মীয় বিশ্বাসকে উপহাস করা, এমনকি ধর্মীয় অনুশাসনকে ইচ্ছাকৃতভাবে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা যেন একধরনের ‘বুদ্ধিবৃত্তিক ফ্যাশন’ হয়ে উঠছে। এই প্রবণতাটি যেমন জ্ঞানচর্চার পথে বাধা সৃষ্টি করছে, তেমনি সমাজে বিভাজনও বাড়াচ্ছে। যে মুক্তচিন্তা ঐক্য, বোঝাপড়া এবং যুক্তির দিকে মানুষকে আহ্বান করার কথা, সেখানে তা হয়ে উঠছে একটি উত্তেজনামূলক শব্দ, যা মানুষকে দুই দলে ভাগ করে ফেলে—একদল যারা ধর্মকে সর্বদা আক্রমণের লক্ষ্য বানিয়ে আনন্দ পায়, আরেকদল যারা একটুও সমালোচনা সহ্য করতে পারে না। অথচ দুদলের কোনোটিই মুক্তচিন্তার মূল চেতনাকে ধারণ করছে না। কারণ মুক্তচিন্তা ‘Neither blind criticism, nor blind obedience.’ এটি সত্যের অনুসন্ধান, যুক্তির প্রতি অনুগত থাকা এবং মানুষের প্রতি সম্মান বজায় রেখে চিন্তা প্রকাশ করা।
অনেকেই মনে করেন, মুক্তচিন্তা মানেই ধর্মের বিরোধিতা। তারা ধরে নেন, বুদ্ধিবৃত্তিক হতে হলে ধর্মকে অস্বীকার করতে হবে, ধর্মীয় চর্চাকে হেয় করতে হবে এবং বিশ্বাসীদের একটি পশ্চাৎপদ গোষ্ঠী হিসেবে চিত্রিত করতে হবে। এই ভুল ধারণার ফলে অনেক তরুণ-তরুণী মনে করেন, ধর্ম নিয়ে প্রশ্ন তোলার সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি হলো তাকে ব্যঙ্গ করা। অথচ প্রশ্ন তোলা এবং ব্যঙ্গ করার মধ্যে একটি মৌলিক পার্থক্য আছে। প্রশ্ন তোলা হলো জ্ঞান অর্জনের পথ; ব্যঙ্গ করা হলো অন্যকে হেয় করার উপায়। প্রশ্ন তুললে নতুন আলোচনার জন্ম হয়, ব্যঙ্গ করলে শুধু উত্তেজনা ও বিভাজন বাড়ে। মুক্তচিন্তা কোনোদিনই ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের ওপর দাঁড়িয়ে থাকেনি—এটি দাঁড়িয়ে আছে যুক্তি, সদাচার এবং পরস্পরের প্রতি সম্মানবোধের ওপর। এই সম্মানবোধ যখন হারিয়ে যায়, তখন মুক্তচিন্তা নামটি ব্যবহার করা হলেও তার মধ্যে থাকে কেবল বিরোধিতা, ক্ষোভ এবং শ্রদ্ধাহীনতা।
ধর্ম একটি মানুষের ব্যক্তিগত বিশ্বাস, তার পরিচয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই পরিচয়ে আঘাত করলে তা মানুষকে কষ্ট দেয়, আর মানুষ যখন কষ্ট পায়, তখন সে যুক্তির প্রতি অনুগত থাকে না। সমাজে শান্তি, সহনশীলতা ও সম্মানের পরিবেশ বজায় রাখতে হলে মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে সম্মান করা জরুরি। কিন্তু এর মানে এই নয় যে ধর্ম সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা যাবে না বা সমালোচনা করা যাবে না। বরং সমালোচনা হোক যুক্তিনির্ভর, শালীন, তথ্যভিত্তিক এবং আলোচনাপূর্ণ; তবেই তা সমাজের জন্য উপকারী হয়। কিন্তু যখন সমালোচনার আড়ালে লুকিয়ে থাকে ঘৃণা, অবজ্ঞা এবং ব্যক্তিগত আক্রমণ, তখন তা সমালোচনা থাকে না, তা হয়ে ওঠে অপমান। আর যখন অপমানকে কেউ ‘মুক্তচিন্তা’ বলে দাবি করে, তখন মুক্তচিন্তার নামই কলঙ্কিত হয়।
অনেকেই যুক্তি দেখান, ধর্ম সমাজকে পিছিয়ে দিয়েছে, তাই ধর্মকে সমালোচনা করা মানেই প্রগতির দিকে অগ্রসর হওয়া। এই যুক্তি প্রথমত অর্ধসত্য, দ্বিতীয়ত বিপজ্জনক। কারণ সভ্যতার ইতিহাসে ধর্ম যেমন অনৈতিকতার পথ সীমাবদ্ধ করেছে, তেমনি ধর্মই মানুষকে নৈতিকতা শিখিয়েছে, মানুষকে নতুন নতুন চিন্তার খোরাক দিয়েছে, শিল্প-সাহিত্যকে অনুপ্রাণিত করেছে, জ্ঞানকে রূপ দিয়েছে, আইন ও ন্যায়বোধের ভিত্তি তৈরি করেছে। বিজ্ঞানীরা যারা মানবজ্ঞানকে সামনে এগিয়ে নিয়েছেন, তাদের অনেকেই ধর্মীয় মানুষ ছিলেন।
অনেক সময় দেখা যায়, ধর্মবিদ্বেষ ছড়িয়ে যারা নিজেদের মুক্তচিন্তার ধারক বলে দাবি করেন, তারা ঠিক সেই একই আচরণ করেন, যে ক্ষেত্রে তারা ধর্মীয় সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। অর্থাৎ, তারা নিজেরাই এক ধরনের ধর্মীয় মৌলবাদের মতো আচরণ করতে শুরু করেন যেন ‘মুক্তচিন্তা’-ই তাদের ধর্ম। অথচ মুক্তচিন্তা কখনোই ধর্ম হয়ে ওঠেনি। ধর্মে স্বাধীনভাবে চিন্তা করার স্বাধীনতা আছে, কিন্তু মুক্তচিন্তা কোনো ধর্ম নয়। মুক্তচিন্তা এমনভাবে কাজ করে যে এতে অমত থাকা সত্ত্বেও মানুষ আলোচনার সুযোগ পান। কিন্তু যখন মুক্তচিন্তার নামে অন্যের বিশ্বাসকে চূড়ান্তভাবে বাতিল করে দেয়া হয় এবং কেবল ধর্মকেই সমালোচনা করে মুক্তচিন্তা চর্চা করা হয়, তখন সেই মুক্তচিন্তা আর মুক্ত থাকে না; সেটি পরিণত হয় ‘মুক্তচিন্তায় মৌলবাদ’। তাদের আচরণ, মনোভাব, যুক্তি দেখে মনে হয় মুক্তচিন্তা করা তাদের ‘মুক্তচিন্তায় মৌলবাদ’ ধর্মের এবাদত আর তারা অন্ধভাবে সেই এবাদত পালন করছে।
ধর্মবিদ্বেষের যে স্রোত কিছু মানুষ মুক্তচিন্তার ব্যানারের নিচে বহন করছেন, তা নতুন নয়। ঐতিহাসিকভাবে দেখা যায়, সমাজে কিছু মানুষ সবসময়ই ধর্মকে অন্ধকারের উৎস হিসেবে তুলে ধরেন। কিন্তু যে কোনো যুগে আমরা দেখেছি, ধর্মকে আক্রমণ করে কেউ জ্ঞানবহ আলোচনা তৈরি করতে পেরেছে, এমন উদাহরণ খুবই কম।
শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
প্রিন্ট করুন







Discussion about this post