Print Date & Time : 21 November 2025 Friday 4:40 am

মুন্সীগঞ্জে চারার বাজার চার কোটি টাকার

শেখ মোহাম্মদ রতন, মুন্সীগঞ্জ : শীত মৌসুম সামনে রেখে মুন্সীগঞ্জের সদর ও টঙ্গীবাড়ি উপজেলার উঁচু জমিতে শীতকালীন সবজির বীজতলা তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন প্রান্তিক কৃষকেরা। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে উৎপাদিত সবজির চারা যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন জেলায়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, গুণগত মান ভালো হওয়ায় এই অঞ্চলের বীজতলায় উৎপাদিত চারার কদর দেশজুড়ে।

শীতকালীন সবজির চারা উৎপাদনে প্রসিদ্ধ জেলা মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার রামপাল, পঞ্চসার, মহাকালী, বজ্রযোগিনী ইউনিয়ন এবং টঙ্গীবাড়ি উপজেলার ধামারণ, আলদী, কাঠাদিয়া, আব্দুল্লাপুর, বেতকা গ্রামসহ আশপাশের গ্রামে গ্রামে বীজতলা প্রস্তুত করছেন কৃষক। ফুলকপি, বাঁধাকপি, লাউ, টমেটো, ব্রোকলি, কুমড়া, বেগুন প্রভৃতি সবজির চারা উৎপাদনে এখন জমিতে পুরোপুরি ব্যস্ত কৃষকরা।

আগস্টের মাঝামাঝি বীজতলা তৈরির কাজ শুরু করেন তারা। চারা উৎপাদন ও বিক্রি চলে ডিসেম্বর পর্যন্ত। বীজ বোনার ২৫ দিনের ব্যবধানেই চারা বিক্রি শুরু করেন। প্রত্যেক বীজতলায় তিন থেকে চার বার চারা উৎপাদন করা যায়। এ অঞ্চলে প্রতি মৌসুমে দুই থেকে আড়াই কোটি সবজি চারা উৎপাদন হয়, যা বিক্রি হয় তিন থেকে চার কোটি টাকায়। সবজির প্রকারভেদে প্রতি হাজার চারা বিক্রি হয় ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার টাকায়। তবে এ বছর অতিবৃষ্টিতে বীজতলার চারা নষ্ট হওয়ায় ক্ষতিতে পড়েন কৃষক।

মুন্সীগঞ্জ সদরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, গ্রামে গ্রামে কৃষকরা সারা দিন চারা পরিচর্যা করছেন। রোদ-বৃষ্টি থেকে রক্ষায় বীজতলা ঢেকে রেখেছেন বিশেষভাবে তৈরি মাচায়। প্রতিদিন সন্ধ্যায় মাচা ঢেকে দেন বীজতলা। পরদিন সকালে রোদ উঠলে মাচা সরিয়ে নেন। দুপুরে রোদের প্রখরতা বাড়লে মাচায় ঢেকে দিচ্ছেন। আবার বৃষ্টিতেও মাচাগুলো বীজতলায় ঢেকে দেন। তাছাড়া এক-দুই দিন পরপরই পানি ওষুধ স্প্রে করছেন। সবজির প্রকারভেদে প্রতি হাজার চারা বিক্রি হয় এক হাজার ৫০০ টাকা থেকে  ২ হাজার টাকায়।

সদর উপজেলার পঞ্চসার ইউনিয়নের ভট্টাচার্যেরবাগ গ্রামের শিহাব সিকদার চলতি মৌসুমে ৪২ শতাংশ জমিতে বীজতলা করেছেন। খরচ হয়েছে প্রায় ৮ লাখ টাকা। তিনি জানান, চারা উৎপাদনে বীজতলার যত্ন নিতে হয় বেশ। এতে বিনিয়োগ করে অর্ধেক পরিমাণ লাভ হয়।

একই ইউনিয়নের বনিক্যপাড়া গ্রামের কৃষক হারুন মিয়া বলেন, এখানকার বীজতলার চারা উৎকৃষ্ট মানের। এতে দেশের বিভিন্ন জেলার কৃষকের কাছে এর চাহিদা বেশি। তাই কখনো বীজতলা করে লোকসান হয়নি।

একই ইউনিয়নের পঞ্চসার গ্রামের আমির হোসেন জানান, তিনি আগস্টের মাঝামাঝি ৫০ শতাংশ জমিতে ফুলকপি ও বাঁধাকপির চারা উৎপাদনে বীজতলা করেছেন। প্রায় সাড়ে ৪ লাখ টাকা খরচ হয়েছে তার। ইতোমধ্যে চারা উত্তোলন করে বিক্রিও করেছেন। একই বীজতলায় আরও তিনবার চারা করবেন। আর এতে সব খরচ বাদে তিনি লাভের আশা দেখছেন।

সদর উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নের কৃষকরা বংশ পরম্পরায় বীজতলা করে আসছেন বলে জানিয়েছেন দেওয়ান বাজার গ্রামের কৃষক আমজাদ হোসেন। তিনি ৩৫ শতাংশ জমিতে ফুলকপি, ব্রোকলি ও বাঁধাকপি চারার বীজতলা করেছেন। এতে তার খরচ হয়েছে দুই লাখ টাকা। বীজতলা থেকে উৎপাদিত চারা তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা বিক্রি করতে পারবেন বলে তার আশা।

রামপাল ইউনিয়নের জোড়ার দেউল গ্রামের কৃষক হুমায়ুন মিয়া জানান, বীজতলা তৈরিতে বেশ পরিশ্রম বটে। তিনি প্রতি বছর ১৫ থেকে ১৬ লাখ টাকার ফুলকপি-বাঁধাকপিসহ বিভিন্ন সবজির চারা বিক্রি করেন। এতে উৎপাদন খরচ বাদে প্রতি বছর তার কয়েক লাখ টাকা লাভ হয়।

জেলা কৃষি সম্প্র্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, চলতি বছর জেলায় ৪ হাজার ৯০৭ হেক্টর জমিতে শীতকালীন সবজি আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। আর উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ লাখ ২৫ হাজার ৪২৩ মেট্রিক টন সবজি।

জেলা কৃষি সম্প্র্রসারণ অধিদপ্তরের উপসহকারী কর্মকর্তা রনি দাস জানান, শীতকালীন সবজি চারা উৎপাদন লাভজনক পেশা। জেলার দুই উপজেলার বেশ কয়েকটি গ্রামের কৃষক বীজতলায় চারা উৎপাদন পেশা হিসেবে নিয়েছেন। চারা উৎপাদনে জৈবসার ও খৈল ব্যবহার হয়ে থাকে। এ কারণে এখানকার চারার গুণগতমান ভালো।

তিনি আরও জানান, স্থানীয় চাহিদা মেটানোর পর এখানকার সবজি চারা কেরানীগঞ্জ, সাভার, মানিকগঞ্জ, সিলেট, কুমিল্লা, হবিগঞ্জ, চাঁদপুর ও বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন জেলার পাইকারদের কাছে বিক্রি হয়ে থাকে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. মো. হাবিবুর রহমান জানান, এ জেলায় শীতকালীন সবজি আবাদ শুরু হয়ে গেছে। প্রাথমিক পর্যায়ে চারা উৎপাদনে বীজতলা করেছেন কৃষকরা। উৎপাদিত চারা জেলার স্থানীয় কৃষকের চাহিদা পূরণ করে দেশের ২৫টি জেলায় বিক্রি হচ্ছে। এসব চারার গুণগতমান ভালো। যেসব কৃষক ভালো ফলন প্রত্যাশা করেন, দেশের যে কোনো প্রান্তের কৃষক হোন না কেন— এ চারা নিয়ে আবাদ করতে পারেন।

তিনি আরও জানান, অতিবৃষ্টি ও বীজের দাম বৃদ্ধির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে কৃষকরা শীতকালীন সবজি উৎপাদনের লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।

মুন্সীগঞ্জ কৃষি সম্প্র্রসারণ অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণবিষয়ক কর্মকর্তা তাজুল ইসলাম বলেন, মুন্সীগঞ্জের উৎপাদিত চারা স্থানীয় কৃষকের চাহিদা মিটিয়ে দেশের ২৫ জেলায় যাচ্ছে। এসব চারার গুণগতমান ভালো হওয়ায় কদর রয়েছে দেশজুড়ে।