শেখ মোহাম্মদ রতন, মুন্সীগঞ্জ : মুন্সীগঞ্জের সদর উপজেলায় সংকট দেখিয়ে সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে অতিরিক্ত মূল্যে কৃষকদের কাছে সার বিক্রি করা হচ্ছে। সব ধরনের সার প্রতি কেজিতে ২ থেকে ১১ টাকা পর্যন্ত বেশি দামে বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা। সরকারি দামে সার কেনার কথা বললেই সার না থাকার অজুহাত দিয়ে কৃষকদের কাছে বিক্রি করছেন না ব্যবসায়ীরা। এতে চলতি আলু মৌসুমে জমি আবাদ করতে আর্থিক চাপে পড়েছেন কৃষকরা। কৃষকদের অভিযোগ, ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে সারের বাজার অস্থির করে তুলছেন।
জেলার বিভিন্ন উপজেলায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ডিলার পর্যায়ে ইউরিয়া সার ২৫ টাকা, ডিএপি (ডাই-অ্যামোনিয়াম ফসফেট) ১৯ টাকা, টিএসপি (ট্রিপল সুপার ফসফেট) ২৫ টাকা, এমওপি (মিউরেট অব পটাশ) ১৮ টাকা কেজিতে দেওয়া হয়েছে। কৃষক পর্যায়ে প্রতি কেজি ইউরিয়া ২৭ টাকা, ডিএপি ২১ টাকা, টিএসপি ২৭ টাকা ও এমওপি দাম ২০ টাকা বিক্রির নির্দেশনা রয়েছে। অথচ মুন্সীগঞ্জ সদরের মুন্সিরহাট বাজারে সার ব্যবসায়ীরা সরু ইউরিয়ার সংকট দেখিয়ে মোটা ইউরিয়া সার ২৯ থেকে ৩০ টাকা, টিএসপি ৩৭ থেকে ৩৮ টাকা, ডিএপি ২২ থেকে ২৩ টাকা ও এমওপি ২১ থেকে ২২ টাকা দরে বিক্রি করছেন।
১৩ ডিসেম্বর দুপুরে মেসার্স সরকার ট্রেডার্স থেকে সার কিনে গাড়িতে উঠাচ্ছিলেন সদর উপজেলার বাগাইকান্দি এলাকার রহমান, সাদ্দাম ও করিমসহ বেশ কয়েকজন কৃষক। দাম জিজ্ঞেস করতেই তারা আক্ষেপের সঙ্গে জানান, সারের দাম বলে আর লাভ নেই। সরকার সারের জন্য এত টাকা ভুর্তুকি দেয় আমাদের জন্য। অথচ ডিলার-ব্যবসায়ীরা যে-যেভাবে পারছেন আমাদের জিম্মি করে টাকা নিচ্ছেন। এক হাজার ৩৫০ টাকা বস্তার টিএসপি এক হাজার ৮৫০ টাকায়। এক হাজার ৫০ টাকার ডিএপি এক হাজার ৪০০ টাকা, এক হাজার ৩৫০ টাকায় সরু ইউরিয়া কেনার কথা থাকলেও মোটা ইউরিয়া এক হাজার ৫০০ টাকা করে বস্তা কিনতে হচ্ছে।
এদিন আরও ৮-১০ জন কৃষকের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, ২৭ টাকার সার ৩৮ টাকা নির্ধারণ করেছেন। প্রতি বস্তায় ৫৫০ টাকা বেশি দাম চাচ্ছেন। সারের দামের ম্যামো চাইলে সেটিও দিতে চান না ব্যবসায়ীরা। দর-দাম বেশি করলে দোকানে সার নেই, সারের মান ভালো হবে না ইত্যাদি বলে ব্যবসায়ীরা দোকান থেকে তাড়িয়ে দিচ্ছেন। মুন্সিরহাটসহ মুন্সীগঞ্জ পৌরসভার সব সার ব্যবসায়ী ও ডিলাররা সম্পূর্ণ সার বাজারটিই সিন্ডিকেট করে তাদের নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন। এতে কৃষকরা চলতি আলু আবাদ মৌসুমে চরম বিরম্বনায় পড়েছেন।
মুন্সীরহাট বাজারের মেসার্স সরকার ট্রেডার্সে গিয়ে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী আনিস সরকার কয়েকজন কৃষকের কাছে বেশি দামে বিক্রি করছেন।
এ বাজারের রিমা ট্রেডার্স নামে একটি প্রতিষ্ঠানে কয়েকজন কৃষক সারের দর-দাম করছেন। দোকান মালিক মো. রাশেদ টিএসপি সার ৩৭ টাকা, ইউরিয়া, ডিএপি ও এমওপি সার কেজিতে দুই থেকে চার টাকা বেশি চাচ্ছেন। নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দাম চাওয়ায় কৃষকরা সার না কিনে কম দামের আশায় অন্য দোকানের দিকে চলে যাচ্ছেন।
জিজ্ঞাসা করতেই বিক্রেতা মো. রাশেদ বলেন, ‘টিএসপি সার নেই। অন্য সারের সংকটও রয়েছে। ডিলাররা আমাদের সার দিচ্ছেন না। নারায়ণগঞ্জ থেকে অতিরিক্ত দামে কিনে এনে বিক্রি করছি। তাই আমাদেরও বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।’
বাজারে পর্যাপ্ত সার নেই, ডিলাররাও চাহিদামতো সার দিচ্ছে না বলে একই অভিযোগ মেসার্স মৃধা এন্টারপ্রাইজের মালিক শরিফ হোসেনের।
মায়ের দোয়া ট্রেডার্সের মালিক মো. ছালাউদ্দীনসহ বেশ কয়েকজন খুচরা সার বিক্রেতাদেরও একই অভিযোগ।
শনিবার বিকেলেও মুন্সীরহাটের জনি ট্রেডার্স, রিমা ট্রেডার্স, গাজী ট্রেডার্স, রানু এন্টারপ্রাইজে গেলে সার সংকটের কথা জানান প্রতিষ্ঠানের মালিকরা। টিএসপি সার নেই বলে জানান তারা। বন্ধ পাওয়া যায় সরকার ট্রেডার্সসহ ৮-১০টি সার ডিলার ও বিক্রয় প্রতিষ্ঠান।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, জেলায় বিসিআইসির ৭৭ জন ও বিএডিসির ১৪৪ জন সার ডিলার রয়েছেন। ২২১ জন ডিলারের জন্য চলতি রবি মৌসুমে ২৫ হাজর ৫৩৪ মেট্রিক টন ইউরিয়া, ১০ হাজার ৩৯১ মেট্রিক টন টিএসপি, ৩৩ হাজার ৮১৬ মেট্রিক টন ডিএপি ও ১৩ হাজার ৩০০ মেট্রিক টন এমওপি সারের বরাদ্দ রয়েছে।
যার মধ্যে সদর উপজেলার ডিলারদের জন্য ৫ হাজর ৬৮০ মেট্রিক টন ইউরিয়া, ২ হাজার ১৬৫ মেট্রিক টন টিএসপি, ৬ হাজার ৭৫০ মেট্রিক টন ডিএপি ও ২ হাজার ৬৮০ মেট্রিক টন এমওপি সারের বরাদ্দ রয়েছে, যা জেলার কৃষকদের জন্য পর্যাপ্ত বলে জানায় কৃষি বিভাগ।
জেলা সদরের যোগনী ঘাট এলাকার কৃষক মো. সাইফুল ইসলাম। তিনি এবার ১০ একর জমিতে আলুর আবাদ করবেন। গত এক সপ্তাহ ধরে মুন্সীগঞ্জ সদরের মুক্তারপুর, মুন্সীগঞ্জ শহরের হাটলক্ষ্মীগঞ্জ ও মুন্সিরহাট বাজারে ঘুরে ঘুরে অতিরিক্ত দামে কিছু সার কিনছেন। এখনও সার কেনার জন্য ঘুরছেন।
তবে গত তিন দিন ধরে এসব এলাকার দোকানে সার কিনতে দৌড়ঝাঁপ করলেও টিএসপি সার পাননি। অন্যান্য সারের দামও কেজিতে দুই থেকে চার টাকা করে বেশি চাচ্ছেন বলে জানান এই আলুচাষি।
সার সংকট ও বেশি দামে বিক্রির চিত্র জেলার টঙ্গিবাড়ী উপজেলাতেও দেখা গেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে মুন্সীগঞ্জ সদরের মতো জেলার ৬টি উপজেলায় অতিরিক্ত দামে সার বিক্রি করছেন ডিলার ও ব্যবসায়ীরা।
টঙ্গীবাড়ী উপজেলার চাঠাতিপাড়া গ্রামের কৃষক মিঠুন মণ্ডল এবার ৬৫০ শতক জমিতে আলুর আবাদ করছেন। উপজেলার মিঠুন মণ্ডল বলেন, ১০ দিন টঙ্গিবাড়ী বাজারের বিভিন্ন ডিলারের দোকান ঘুরেছি। কোথাও টিএনপি সার নেই। টিএসপি বাদে অন্য সার কিনতে বাধ্য হয়েছি। যেখানে সরকারি দামে সার কিনলে খরচ হতো ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা। অথচ সেই সার সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের কারণে ১ লাখ ৬০ হাজার টাকায় কিনতে হয়েছে। এবার এমন অবস্থায় আমাদের শত শত কৃষকদের ভুগতে হয়েছে।
জেলার কোথাও কোনো সারের সংকট নেই। পর্যাপ্ত পরিমাণ সার রয়েছে বলে জানান জেলা কৃষি প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা মো. তাজুল ইসলাম। মো. তাজুল ইসলাম জানান, বছরের এ সময় জেলায় আলু আবাদের জন্য সারের ব্যাপক চাহিদা থাকে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা সারের দাম বেশি রাখছেন। আমরা ইতোমধ্যে এ বিষয়ে অভিযান করেছি। বিভিন্ন উপজেলায় আমাদের কর্মকর্তারাও অভিযান চালাচ্ছে।
মুন্সীগঞ্জ জেলা প্রশাসক সৈয়দা নুরমহল আশরাফী জানান, প্রশাসন প্রতিটি উপজেলার প্রতিটি বাজারে তদারকি শুরু করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের জেলায় পর্যাপ্ত পরিমাণে সার মজুত রয়েছে। ডিলারদের তাদের চাহিদা অনুসারে সরবরাহ করা হচ্ছে। এর পরও যারা সারের কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে সার বিক্রি করছেন, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
