নুসরাত জাহান : অর্থনীতি এক বিশাল গাছের মতো। এই গাছের শিকড় হলো কর্মসংস্থান, আর শাখা-প্রশাখায় ঝুলে থাকে মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা। কিন্তু যদি শিকড় শুকিয়ে যায়, যদি ডালপালায় রস না পৌঁছায়, তবে সেই গাছ কখনোই সবুজ থাকতে পারে না। বাংলাদেশের অর্থনীতিও আজ তেমন এক বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে মূল্যস্ফীতি আর কর্মসংস্থানের অভাব মিলেই গাছের প্রাণশক্তি কেড়ে নিচ্ছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাংলাদেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি মানুষের জীবনযাত্রাকে অস্থির করে তুলেছে। বাজারে গেলে দেখা যায়, একই চাল, ডাল বা তেলের দাম কয়েক মাসের মধ্যে দ্বিগুণ হয়ে গেছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে কর্মসংস্থানের সীমাবদ্ধতা। হাজারো তরুণ-তরুণী স্নাতক শেষ করেও দীর্ঘদিন ধরে চাকরির অপেক্ষায় থাকে। অর্থাৎ আয় বাড়ছে না, কিন্তু ব্যয় দিন দিন বেড়েই চলছে। এই বৈপরীত্যই দারিদ্র্যকে গভীর করছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে দেশে সাধারণ মূল্যস্ফীতি হার ছিল প্রায় ৯ শতাংশ, যা গত এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। একই সময়ে বেকারত্বের হার ৪ দশমিক ৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, তবে বাস্তব চিত্রে এ হার আরও বেশি। প্রায় ৩০ শতাংশ তরুণ বর্তমানে কর্মসংস্থানের বাইরে। এছাড়া বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রায় দুই কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ না হলে এ সংখ্যা আগামী কয়েক বছরে আরও বৃদ্ধি পাবে।
মূল্যস্ফীতি ও কর্মসংস্থান সংকটের কয়েকটি বড় কারণ রয়েছে। প্রথমত, বৈশ্বিক বাজারে জ্বালানি ও কাঁচামালের দাম বাড়ায় দেশের আমদানি ব্যয় বেড়ে গেছে, যার চাপ সরাসরি পড়ছে ভোক্তার ওপর। দ্বিতীয়ত, বাজারে সিন্ডিকেট ও মজুতদারির কারণে দ্রব্যমূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তৃতীয়ত, কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমিত হওয়ার পেছনে শিল্পোন্নয়নের ধীরগতি, প্রযুক্তিনির্ভর চাকরির অভাব এবং দক্ষতার ঘাটতি বড় ভূমিকা রাখছে। চতুর্থত, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও নীতিনির্ধারণে সমন্বয়ের অভাবও অর্থনীতিকে দুর্বল করে তুলছে।
মুদ্রাস্ফীতির মতো সমস্যার সমাধানের পথ অবশ্যই আছে, যার মধ্যে কিছু পদক্ষেপ উল্লেখযোগ্য। প্রথমত, সরকারকে বাজার ব্যবস্থায় শক্ত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সিন্ডিকেট ও মজুতদারদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। দ্বিতীয়ত, কর্মসংস্থান বাড়াতে শিল্পায়ন, কৃষি খাতের আধুনিকায়ন, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা উন্নয়ন ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। তৃতীয়ত, তরুণদের দক্ষতা উন্নয়নের জন্য কারিগরি শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। চতুর্থত, বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণে স্বচ্ছতা ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে। পঞ্চমত, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিকে আরও বিস্তৃত ও কার্যকর করতে হবে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ আর কর্মসংস্থান বৃদ্ধি কেবল অর্থনীতির প্রশ্ন নয়Ñএটি মানুষের বেঁচে থাকার প্রশ্ন, এটি সামাজিক স্থিতিশীলতার প্রশ্ন। ক্ষুধার্ত মানুষ কখনও শান্ত থাকতে পারে না। বেকার তরুণ হতাশা থেকে বিপথে চলে যেতে পারে। তাই যদি আমরা সত্যিই একটি স্থিতিশীল ও উন্নত বাংলাদেশ চাই, তবে অবিলম্বে বাজার নিয়ন্ত্রণ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। অন্যথায় দারিদ্র্যের কশাঘাতে সাধারণ মানুষের জীবন আরও অনিশ্চিত হয়ে পড়বে, আর সেই অস্থিরতার বোঝা পুরো সমাজকেই বহন করতে হবে।
শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

Discussion about this post