রামিসা রহমান : গত এক দশকে বাংলাদেশ এক অভাবনীয় উন্নয়ন যাত্রার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছে। অবকাঠামো নির্মাণ, যোগাযোগব্যবস্থার আধুনিকায়ন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সম্প্রসারণ, সমুদ্রবন্দর উন্নয়ন, ডিজিটাল রূপান্তর, রেল ও সড়ক নেটওয়ার্ক বিস্তার এবং শিল্পায়নের নতুন দিগন্ত সব মিলিয়ে দেশ আজ এক নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি। এক সময় যে বাংলাদেশকে ‘উন্নয়নশীল স্বপ্ন’ বলা হতো, আজ সেই দেশ নিজেই উন্নয়নের উদাহরণ হয়ে উঠছে। এই রূপান্তরের সবচেয়ে দৃশ্যমান প্রতীক হয়ে উঠেছে ঢাকা মেট্রোরেল, পদ্মা সেতু, পায়রা সমুদ্রবন্দর, কর্ণফুলী টানেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, একাধিক অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং শত শত কিলোমিটার নতুন মহাসড়ক ও রেলপথ।
ঢাকা মহানগরীর যোগাযোগব্যবস্থা দীর্ঘদিন ধরে ভয়াবহ যানজটে বিপর্যস্ত ছিল। ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় আটকে থেকে মানুষ নষ্ট করতো সময়, শক্তি ও অর্থ। সেই বাস্তবতা বদলাতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে মেট্রোরেল। বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো চালু হওয়া এই আধুনিক শহুরে রেলব্যবস্থা কেবল একটি পরিবহন মাধ্যম নয়, বরং একটি নতুন নাগরিক সংস্কৃতির সূচনা। উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত চালু হওয়া মেট্রোরেল প্রতিদিন লাখো যাত্রী পরিবহন করছে। শীতাতপ-নিয়ন্¿িত অত্যাধুনিক কামরা, নির্ধারিত সময়সূচি, স্টেশনভিত্তিক শৃঙ্খলা সব মিলিয়ে এটি ঢাকার গণপরিবহনে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। মেট্রো রেলের কারণে প্রতিদিন কয়েক লাখ কর্মঘণ্টা সাশ্রয় হচ্ছে, যানজট কমছে, জ্বালানি খরচ কমছে এবং পরিবেশ দূষণও তুলনামূলকভাবে হ্রাস পাচ্ছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, শুধু সময় ও জ্বালানি সাশ্রয়ের মাধ্যমেই বছরে হাজার হাজার কোটি টাকার অর্থনৈতিক সুফল মিলছে, যা দেশের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রাখছে।
একইভাবে পদ্মা সেতু বাংলাদেশের যোগাযোগ ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত এই বহুমুখী সেতু শুধু একটি স্থাপনা নয়, এটি বাঙালির সক্ষমতার প্রতীক। পদ্মা নদীর ওপর নির্মিত এই সেতু দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানী ও দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সরাসরি সংযোগ স্থাপন করেছে। যে ২১টি জেলা এক সময় ফেরির ওপর নির্ভরশীল ছিল, আজ তারা সড়কপথে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ পাচ্ছে। এর ফলে পণ্য পরিবহন সহজ হয়েছে, কৃষিপণ্য দ্রুত বাজারে পৌঁছাচ্ছে, শিল্পকারখানা স্থাপন বাড়ছে, পর্যটন শিল্প বিকশিত হচ্ছে এবং বাণিজ্যে গতি এসেছে। পরিবহন ব্যয় যেমন কমেছে, তেমনি সময়ও উল্লেখযোগ্যভাবে সাশ্রয় হচ্ছে। আগে যেখানে ভোগান্তি, অনিশ্চয়তা আর দীর্ঘ অপেক্ষা ছিল, সেখানে এখন রয়েছে দ্রুতগামী যান চলাচল ও নিশ্চিত যাতায়াত। এই সেতুর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অর্থনৈতিক প্রভাব দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধিকে কয়েক শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়ে দিতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বাংলাদেশের অবস্থান আরও শক্তিশালী করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে পায়রা সমুদ্রবন্দর। দক্ষিণাঞ্চলের কলাপাড়া উপজেলায় অবস্থিত এই বন্দরটি দেশের তৃতীয় সমুদ্রবন্দর হিসেবে ইতোমধ্যেই কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। পায়রা বন্দরের মূল উদ্দেশ্য ছিল চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরের ওপর চাপ কমিয়ে এনে নতুন বাণিজ্যদ্বার খুলে দেওয়া। ইতোমধ্যে বড় বড় জাহাজ এই বন্দরে নোঙর করছে, পণ্য খালাস হচ্ছে এবং উন্নত হচ্ছে কনটেইনার ব্যবস্থাপনা। ভবিষ্যতে গভীর সমুদ্রবন্দর হিসেবে পায়রা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য একটি প্রধান কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ ট্রানজিট ও বাণিজ্যপথ হিসেবে এর সম্ভাবনা বিশাল, যা দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যে নতুন দুয়ার খুলে দেবে।
যোগাযোগ ব্যবস্থায় আরেকটি যুগান্তকারী সংযোজন হলো কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল। দক্ষিণ এশিয়ায় নদীর তলদেশ দিয়ে নির্মিত প্রথম সড়ক টানেল হিসেবে এটি একটি প্রকৌশল বিস্ময়। চট্টগ্রাম নগর ও আনোয়ারা, পটিয়া, কক্সবাজার অঞ্চলের মধ্যে যাতায়াত এখন আরও সহজ ও দ্রুত হয়েছে। এই টানেলকে ঘিরে নতুন শিল্পাঞ্চল, পর্যটন কেন্দ্র ও বাণিজ্যিক কার্যক্রম গড়ে উঠছে, যা দক্ষিণ চট্টগ্রামের অর্থনীতিকে বদলে দেবে।
বিদ্যুৎ খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হিসেবে আলোচিত হচ্ছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। এই প্রকল্প চালু হলে দেশের জাতীয় গ্রিডে হাজার হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ যুক্ত হবে, যা দীর্ঘমেয়াদে শিল্পায়ন ও নগরায়ণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। বিদ্যুৎ সংকট বহু বছর ধরে বাংলাদেশের বড় সমস্যা ছিল, কিন্তু এখন বিদ্যুৎ উৎপাদনে দেশ প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ অবস্থায় পৌঁছেছে। নতুন পাওয়ার প্ল্যান্ট, সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প, বাতাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং গ্রিড সম্প্রসারণের ফলে গ্রামে-গঞ্জে আলো পৌঁছেছে, কলকারখানা সচল হয়েছে এবং অর্থনীতির চাকা আরও দ্রুত ঘুরছে।
সড়ক ব্যবস্থায় এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার ও ছয় লেনে উন্নীতকরণ, সিলেট, খুলনা, বরিশাল, রংপুর অঞ্চলে নতুন মহাসড়ক নির্মাণ সব মিলিয়ে দেশের ভেতরের যোগাযোগব্যবস্থা আগের চেয়ে বহুগুণে উন্নত হয়েছে। এর ফলে পণ্য পরিবহন সহজ হয়েছে, ব্যবসা-বাণিজ্য বেড়েছে, মানুষের জীবনযাত্রা গতিশীল হয়েছে। গ্রাম থেকে শহরে যাওয়ার সময় যেমন কমেছে, তেমনি শহরের সঙ্গে গ্রামের অর্থনৈতিক যোগসূত্র আরও শক্তিশালী হয়েছে।
শিল্প খাতে সরকার দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে স্থাপন করছে একাধিক অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্ক। এসব অঞ্চলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা কারখানা স্থাপন করছে, তৈরি হচ্ছে লাখো কর্মসংস্থানের সুযোগ। বিশেষ করে তৈরি পোশাক, চামড়াজাত পণ্য, ওষুধ শিল্প, আইটি খাত এবং হালকা প্রকৌশল শিল্প নতুন দিগন্ত খুলে দিচ্ছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ ধারণা থেকে এখন দেশ এগিয়ে যাচ্ছে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার পথে, যেখানে প্রযুক্তিনির্ভর অর্থনীতি ও জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখা হচ্ছে।
ডিজিটাল অবকাঠামোতেও এসেছে বড় পরিবর্তন। প্রায় সর্বত্র ইন্টারনেট সংযোগ পৌঁছে গেছে। অনলাইন ব্যাংকিং, মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস, ই-গভর্ন্যান্স, অনলাইন শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার মাধ্যমে মানুষের জীবন আরও সহজ হয়েছে। ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার, সেবা বুথ এবং সরকারি অ্যাপস ব্যবহারের ফলে সরকারি সেবা পাওয়া এখন আগের চেয়ে অনেক সহজ, দ্রুত ও স্বচ্ছ হয়েছে। ঘরে বসে আবেদন, বিল পরিশোধ, তথ্য সংগ্রহ এসবই এখন বাস্তবতা।
এই সব উন্নয়ন প্রকল্পের সম্মিলিত প্রভাব দেশের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় সুস্পষ্ট পরিবর্তন এনেছে। দারিদ্র্যের হার কমেছে, মাথাপিছু আয় বেড়েছে, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার আওতা বৃদ্ধি পেয়েছে। কৃষক তার পণ্য দ্রুত বাজারে পৌঁছাতে পারছে, শিক্ষার্থী নির্ধারিত সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছাতে পারছে, রোগী সময়মতো হাসপাতালে যেতে পারছে, সবকিছু মিলেই উন্নয়নের একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র ফুটে উঠছে।
তবে এই অগ্রযাত্রার মাঝেও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। প্রকল্প বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব কমানো, জনদুর্ভোগ হ্রাস করা এবং দীর্ঘমেয়াদে রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করা এখন বড় দায়িত্ব। উন্নয়ন যেন কেবল অবকাঠামোতে সীমাবদ্ধ না থেকে মানুষের জীবনমানেও প্রতিফলিত হয়, সেটিই হওয়া উচিত মূল লক্ষ্য।
তার পরও এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, মেট্রো রেল থেকে শুরু করে পদ্মা সেতু, পায়রা বন্দর থেকে শুরু করে কর্ণফুলী টানেল, এসব প্রকল্প বাংলাদেশের জন্য শুধু ইট-পাথরের স্থাপনা নয়, এগুলো আত্মবিশ্বাসের স্তম্ভ, অগ্রগতির সোপান এবং ভবিষ্যতের শক্ত ভিত্তি। এক সময় যে দেশ পরিচিত ছিল দুর্যোগ ও দারিদ্র্যের জন্য, আজ সেই দেশ পরিচিত হচ্ছে সাহস, সক্ষমতা ও উন্নয়নের অগ্রযাত্রার জন্য। আর এই ধারাবাহিক অগ্রগতি যদি পরিকল্পিত ও স্বচ্ছভাবে চলতে থাকে, তাহলে খুব শিগগিরই বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে একটি উন্নত ও শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে নিজ অবস্থান আরও সুদৃঢ় করতে পারবে।
গণমাধ্যমকর্মী
প্রিন্ট করুন











Discussion about this post