নিজস্ব প্রতিবেদক : দেশের পুঁজিবাজারে একসময় দুর্বল মৌলভিত্তির কোম্পানির শেয়ার দিয়ে দাপট দেখানো হতো। কারসাজির মাধ্যমে শেয়ারদর বাড়িয়ে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরে বিপে ফেলা ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। তবে সাম্প্রতিক সময়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থার কঠোর নজরদারি, কোম্পানি যাচাইয়ের প্রক্রিয়া ও লেনদেনের স্বচ্ছতার ফলে বাজারে দৃশ্যমান পরিবর্তন এসেছে।
বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, এখন বাজে কোম্পানির দিন শেষ, মৌলভিত্তির কোম্পানি দিয়েই বাজার ঘুরে দাঁড়াবে। সাম্প্রতিক লেনেদেনের চিত্রও তারই প্রতিফলন।
গতকাল মঙ্গলবার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে সর্বোচ্চ লেনদেন করা ১০টি কোম্পানির মধ্যে অন্তত আটটি শক্তিশালী মৌলভিত্তির কোম্পানি। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ৩৫ কোটি ৬০ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেন করে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ কোম্পানি (বিএটিবিসি) শীর্ষে ছিল। দ্বিতীয় স্থানে ছিল সিটি ব্যাংক, যার শেয়ার লেনদেন হয়েছে ৩৪ কোটি ৭৮ লাখ টাকার। তৃতীয় স্থানে ছিল ব্র্যাক ব্যাংক, যার লেনদেন ৩৩ কোটি ৬৪ লাখ টাকার।
তালিকায় আরও রয়েছেÑইস্টার্ন ব্যাংক, স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস, বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন, বেক্সিমকো ফার্মা, উত্তরা ব্যাংক, গ্রামীণফোন এবং খান ব্রাদার্স পিপি ওভেন ব্যাগ ইন্ডাস্ট্রিজ।
এই তথ্যই ইঙ্গিত য়ে, বিনিয়োগকারীরা আবার ফিরছেন প্রমাণিত ট্র্যাক রেকর্ডধারী কোম্পানিগুলোর দিকে, যারা দীর্ঘ মেয়াদে টেকসই মুনাফা দেয় এবং বাজারে স্থিতিশীলতা আনে।
এ বিষয়ে প্রধান উপষ্টোর প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, দেশের অর্থনীতিতে স্বচ্ছতা এসেছে। এজন্য সবখানে শৃঙ্খলা এসেছে। এর প্রভাব পুঁজিবাজারেও পড়বে। একটু সময় লাগলেও বাজার ঘুরে দাঁড়াবে।
রাকিব হোসেন নামের একজন ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী বলেন, ‘আমি আগে অনেকবার স্পেকুলেটিভ শেয়ার কিনে ক্ষতির মুখে পড়েছি। এখন আমি শুধু মৌলভিত্তির কোম্পানি দেখি। স্কয়ার ফার্মা ও রেনেটার মতো কোম্পানি আমার পোর্টফোলিওতে ভালো রিটার্ন দিচ্ছে। সরকারের কঠোর অবস্থান থাকলে বাজার আরও ভালো হবে।’
শবনম রিজওয়ানা নামের এক মধ্যম আয়ের চাকরিজীবী বিনিয়োগকারী বলেন, ‘আগে আমরা শুধু মুখে মুখে শুনেই শেয়ার কিনতাম। এখন অনেক কিছু বুঝে শেয়ার কেনাবেচা করি। আমি সিটি ব্যাংক ও বার্জারে বিনিয়োগ করেছি এবং ইতিবাচক ফল পাচ্ছি। মনে হয় সত্যিই এবার মৌলভিত্তির শেয়ার দিয়েই বাজার ঘুরবে।’
পুঁজিবাজার বিশ্লেষক কামরুজ্জামান বলেন, ‘পুঁজিবাজার দীর্ঘদিন যাবৎ আস্থার সংকটে ভুগেছে। কারণ ছিল দুর্বল কোম্পানির কারসাজি। এখন নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও স্টক এক্সচেঞ্জের যৌথ কার্যক্রমে স্বচ্ছতা এসেছে। আর এই স্বচ্ছতার ফলেই ভালো কোম্পানিগুলোর প্রতি আস্থা ফিরেছে। ব্যতিক্রমী কিছু কোম্পানির দর কমলেও বাজারের সামগ্রিক কাঠামো অনেক বেশি গঠনমূলক।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাশে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, ‘দেশের অর্থনীতি যেভাবে ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে, তা পুঁজিবাজারেও প্রতিফলিত হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকেও এখন বাজার নিয়ে অতিরিক্ত প্রচার না করে বাস্তবতা তুলে ধরা হচ্ছে। সঠিক তথ্য পরিবেশন ও কোম্পানির মান যাচাই নিশ্চিত করলেই বিনিয়োগকারীর আস্থা গড়ে ওঠে। আমরা সেটাই দেখছি।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের অর্থনীতির পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়াও পুঁজিবাজারকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করছে। চলমান বৈশ্বিক সংকটের মাঝেও বাংলাদেশের রপ্তানি ও রেমিট্যান্স প্রবাহ স্থিতিশীল। মুদ্রাস্ফীতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে, যা মধ্য মেয়াদে পুঁজিবাজারে স্থিতি আনবে।
বর্তমান সরকার তথ্য বিকৃতি না করে বাস্তবতাকে গুরুত্ব দিয়ে চলছে, এমন মন্তব্য করেছেন একাধিক অর্থনীতিবিদ। তারা বলেন, ‘অতীতে প্রচারণায় অতিরঞ্জন দেখা গেলেও এখন বাস্তবতা তুলে ধরা হচ্ছে, যেটা বাজার ও বিনিয়োগকারীর জন্য ইতিবাচক।’
বর্তমান বাজারে যেসব শেয়ারকে বিনিয়োগকারীরা নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে বিবেচনা করছেন, তাদের মধ্যে রয়েছেÑজিপি (গ্রামীণফোন), বিএটিবিসি, স্কয়ার ফার্মা, ব্র্যাক ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক, রেনেটা, ওয়ালটন, বার্জার পেইন্টস, লিনডে বিডি, বিএসআরএম, কনফিডেন্স সিমেন্ট, হাইডেলবার্গ সিমেন্ট, মবিল যমুনা লুব্রিক্যান্টস, পম্মা ও যমুনা অয়েল।

Discussion about this post