Print Date & Time : 17 August 2025 Sunday 8:02 am

মৎস্যসম্পদ বৃদ্ধি, সুরক্ষণ, উন্নয়ন ও টেকসই ব্যবহার জরুরি

 রেজাউল করিম খোকন : দেশের মৎস্যসম্পদ বৃদ্ধি, সুরক্ষণ, উন্নয়ন ও টেকসই ব্যবহারে জনসচেতনতা তৈরির জন্য মৎস্য সপ্তাহ পালনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ‘অভয়াশ্রম গড়ে তুলি, দেশি মাছে দেশ ভরি’ প্রতিপাদ্য সামনে রেখে এ বছর ১৮ আগস্ট থেকে ‘জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ, ২০২৫’ শুরু হচ্ছে। দেশের প্রাণিজ আমিষ ও পুষ্টি চাহিদার বড় অংশ আসে মাছ থেকে। মিঠাপানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের তৃতীয় অবস্থানে। দারিদ্র্য বিমোচন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে এই খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশিক মুুদ্রা দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে। মাছের মাধ্যমে মানুষের পুষ্টি ও আমিষের চাহিদা পূরণ করার পাশাপাশি উৎপাদিত মাছ নিরাপদ করতে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ রয়েছে। ইতোমধ্যে মৎস্য পরিদর্শন ও মাননিয়ন্ত্রণ আইন করা হয়েছে। সমুদ্রসীমাসহ অন্য জায়গায় যারা মাছ ধরার সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাদের প্রতিটি নৌযানে যান্ত্রিক পদ্ধতি সংযোজন করা হচ্ছে, যাতে তাদের পর্যবেক্ষণের আওতায় রাখা যায়। পাশাপাশি মাছ ধরার কোনো নৌযান দুর্ঘটনায় পড়লে সেটির অবস্থান জানার জন্যও এ পদ্ধতি কাজে লাগবে। উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি মাছের বহুমুখী ব্যবহারে সরকার অত্যন্ত গুরুত্ব দিচ্ছে। মাছ থেকে চিপস, কেকসহ অন্যান্য মৎস্যজাত পণ্য তৈরি করলে ভোক্তা বাড়বে। মাছের বহুমুখী ব্যবহার নিয়ে কাজ করলে সহজ শর্তে, স্বল্প সুদে কৃষিঋণ, প্রশিক্ষণসহ সরকার নানারকম সহায়তা দিচ্ছে। ইলিশ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে শীর্ষস্থানে রয়েছে। বিশ্বে অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মৎস্য আহরণে বাংলাদেশ এখন তৃতীয়, বদ্ধ জলাশয়ে চাষকৃত মাছ উৎপাদনে পঞ্চম এবং তেলাপিয়া উৎপাদনে চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে।

এবারের ‘জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ, ২০২৫’ কর্মসূচির অন্যতম লক্ষ্য শক্তিশালী মৎস্য খাত গড়ে তোলা। মৎস্য খাতে উৎপাদন, বিপণন, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও রপ্তানির প্রক্রিয়ায় সময়োপযোগী প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে। উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণে মৎস্য খাত থেকে সর্বোচ্চ অবদান রাখার লক্ষ্য নিয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় কাজ করছে। নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত মাছ উৎপাদন এবং দেশে ও বিদেশে সরবরাহের জন্য সরকার দেশে আন্তর্জাতিক মানের পরীক্ষাগার তৈরি করেছে। পরীক্ষাগারে পরীক্ষার মাধ্যমে বিদেশিদের চাহিদা অনুযায়ী মাছ রপ্তানি করা হচ্ছে। অন্যদিকে বিদেশ থেকে মাছের জন্য যেসব খাদ্য উপাদান আসে, সেগুলোও এ পরীক্ষাগারে পরীক্ষা করা হচ্ছে, যাতে মাছ উৎপাদন, আহরণ ও বিপণনে অস্বাস্থ্যকর কোনো উপাদান প্রবেশ করতে না পারে। শুধু মাছ উৎপাদন নয়, বরং স্বাস্থ্যসম্মত ও খাবার উপযোগী নিরাপদ মাছ উৎপাদন সরকারের লক্ষ্য। আগে আমাদের লক্ষ্য ছিল মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি। এখন আমাদের লক্ষ্য দেশে স্বাস্থ্যসম্মত ও নিরাপদ মাছ উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তোলা। মাছ উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি মাছের বহুমুখী ব্যবহারে সরকার অত্যন্ত গুরুত্ব দিচ্ছে। মাছ থেকে চিপস, কেকসহ অন্যান্য মৎস্যজাত পণ্য তৈরি করলে মাছের ভোক্তাও বৃদ্ধি পাবে। এভাবে মাছের বহুমুখী ব্যবহার প্রক্রিয়াকে সরকার উৎসাহিত করছে। মাছের বহুমুখী ব্যবহার নিয়ে যারা কাজ করতে চায়, তাদের সহজ শর্তে ও স্বল্প সুদে কৃষিঋণ দেয়া হচ্ছে। তাদের উৎসাহিত করার জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়াসহ সরকার নানারকম সহায়তা প্রদান করছে। পৃথিবীর ৫২টি দেশে বাংলাদেশের মাছ রপ্তানি হয়। মাছ রপ্তানির মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে। গ্রামাঞ্চলে মাছ উৎপাদনের মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতি সচল হচ্ছে। মৎস্য খাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এক কোটি ৯৫ লাখ মানুষ সম্পৃক্ত থেকে জীবিকা নির্বাহ করছে। ইলিশ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে শীর্ষ স্থানে রয়েছে। মিঠাপানি ও বদ্ধ জলাশয়ের মাছ উৎপাদনেও ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। বিশ্বে অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মৎস্য আহরণে বাংলাদেশ এখন তৃতীয়, বদ্ধ জলাশয়ে চাষকৃত মাছ উৎপাদনে পঞ্চম ও তেলাপিয়া উৎপাদনে চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে। দেশের জলসীমায় প্রচলিত ও অপ্রচলিত মাছ উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সরকার কাজ করছে। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী ও গবেষকরা ৩৯ প্রজাতির দেশীয় বিলুপ্তপ্রায় মাছ ফিরিয়ে এনেছে। দেশীয় মাছ বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষার জন্য ময়মনসিংহে লাইভ জিন ব্যাংক করা হয়েছে। জাতীয় মৎস্য সপ্তাহে মুক্ত ও বদ্ধ জলাশয়ে মাছের পোনা অবমুক্তকরণের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মাছ ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। ২০২০ সালে মৎস্য পরিদর্শন ও মাননিয়ন্ত্রণ আইন করা হয়েছে। সমুুদ্রসীমাসহ অন্যত্র যারা মাছ আহরণে সম্পৃক্ত, তাদের প্রতিটি নৌযানে যান্ত্রিক পদ্ধতি সংযোজন করা হচ্ছে, যাতে তাদের মনিটরিংয়ের আওতায় রাখা যায়। পাশাপাশি কোনো মৎস্য নৌযান দুর্ঘটনায় পতিত হলে তাদের অবস্থান জানার জন্যও এই পদ্ধতি কাজে লাগানো হচ্ছে। এভাবে মৎস্য খাতে ডিজিটালাইজড পদ্ধতি যুক্ত করা হয়েছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি আর দূষণের কারণে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশে স্বাদুপানির মাছের উৎপাদন কমছে। চাষের মাছের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা চলছে। এর মধ্যে উজ্জ্বল ব্যতিক্রম হিসেবে চারটি দেশ উৎপাদন বৃদ্ধির ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছে। বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার ও উগান্ডা হলো সেই চার দেশ। বাংলাদেশের মুক্ত জলাশয়ের মাছ উৎপাদনে সফলতার ক্ষেত্রে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে। আর চাষের মাছের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মৎস্যবিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত মাছের জাতগুলো চাষিদের কাছে দ্রুত জনপ্রিয় ও লাভজনক হয়েছে। ফলে তাতে উৎপাদনও বেড়েছে। বাংলাদেশে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে সরকার গবেষণার ওপর বেশি নজর দিচ্ছে। একই সঙ্গে নতুন উদ্ভাবিত জাতগুলোকে চাষিদের হাতে পৌঁছে দিতে মাছের রেণু ও পোনা উৎপাদন বাড়ানো হচ্ছে। জলাশয় ও নদ-নদীর দূষণ কমাতে পারলে উৎপাদন আরও বাড়বে।

পৃথিবীর ৫২টি দেশে বাংলাদেশের মাছ রপ্তানি হয়। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশে বছরে ৪৭ দশমিক ৫৯ মেট্রিক লাখ টন মাছ উৎপাদিত হয়। উৎপাদিত মাছ যাতে মানবস্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ হয়, সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ রয়েছে। মৎস্য খাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দেশের প্রায় দুই কোটি মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে। কিন্তু এ খাতের উন্নয়নকে টেকসই করতে হলে পরিকল্পিত অর্থায়ন দরকার। সরকারের কৃষিঋণ, সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণসহ বিভিন্ন আর্থিক খাতের বিনিয়োগে মৎস্য খাতকে গুরুত্ব দিতে হবে। মৎস্য খাতে উৎপাদন বেড়ে যাওয়াসহ অনেক সাফল্য এলেও এ খাতে এখনও প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ আসেনি। চাষিরা কীভাবে ঋণ পাবেন, তা নিয়েও ধারণার যথেষ্ট অভাব আছে, যে কারণে এখনও অনেক চাষি উচ্চ সুদে দাদন বা ঋণ নেন। সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলো এ খাতে বিনিয়োগ বাড়ালে তা সামগ্রিকভাবে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি ও পুষ্টি নিরাপত্তায় ভূমিকা রাখবে। এ খাতে এতদিন যৌক্তিকভাবে বিনিয়োগ হয়নি। তবে বিদেশে রপ্তানির জন্য সরকার তিনটি মাছকে চিহ্নিত করেছে। সেগুলো হলো পাঙাশ, তেলাপিয়া ও কই মাছ। এই মাছগুলোর রং, স্বাদ ও পুষ্টিগুণ বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে, যাতে তা রপ্তানিযোগ্য করা যায়। দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো যেভাবে ঋণ দিতে অভ্যস্ত এবং ঋণ আদায়ের যে সংস্কৃতি তা মৎস্য খাতবান্ধব নয়। তারা মনে করে, মৎস্য খাতে বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ। ব্যাংক খাতের বাইরের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ওই খাতে ঋণ দিতে চায় না। তাই এ সংস্কৃতি থেকে আর্থিক খাতকে বেরিয়ে আসতে হবে। বাংলাদেশ থেকে চিংড়ি ছাড়া অন্য মাছের রপ্তানির অভিজ্ঞতা কম। মাছের উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি এর গুণগত মান বাড়াতে হবে। একসময় দেশ থেকে ব্যাঙ ও সাপ রপ্তানি হতো। জীববৈচিত্র্যের ক্ষতির কারণে সরকার তা বন্ধ করে দেয়। তবে এখন কুঁচে ও কাঁকড়া রপ্তানি হচ্ছে। দেশের অন্যান্য সাদা মাছের উৎপাদনও মানসম্পন্নভাবে করা গেলে তা রপ্তানি করা যাবে। ফলে এই খাতে বিনিয়োগও টেকসই হবে। দেশের অনেক তরুণ চাকরি ছেড়ে দিয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে উদ্যোক্তা হয়ে উঠছেন। এসব শিক্ষিত তরুণের পেছনে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলো অর্থায়নে এগিয়ে আসছে। বাংলাদেশের একজন মানুষ বছরে প্রায় ২৩ কেজি মাছ খায়। দেশের ১২ শতাংশ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মৎস্যশিল্পের সঙ্গে যুক্ত। দেশের তৃতীয় রপ্তানি খাত হচ্ছে মাছ আর জিডিপির ৩ দশমিক ৫২ শতাংশ আসে এই খাত থেকে। সম্প্রতি মাছের খাবারের দাম প্রায় ৫০-৬০ শতাংশ বেড়ে গেছে। ফলে এই খাতে আরও বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। দেশের মৎস্য খাত কৃষি ও জাতীয় উন্নয়নে যতটুকু ভূমিকা রাখে, ততটুকু আলোচিত হয় না। দেশের পুকুর ছাড়াও সমুদ্রে মৎস্য চাষের আরও সম্ভাবনা আছে। তা কাজে লাগাতে আরও বিনিয়োগ দরকার। আমাদের ব্যাংক থেকে মৎস্য খাতে ঋণ দেয়া হচ্ছে। উদ্যোক্তারা ওই ঋণ নিয়ে মৎস্য খাতে ব্যবহার করছেন কি না, ব্যাংকগুলোকে তা তদারকি করতে হবে। পদ্মা সেতুর কারণে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের মৎস্য খাতে নতুন সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। একে কাজে লাগাতে হবে।

‘মাছে ভাতে বাঙালি’ এটা বাংলার জনপ্রিয় প্রবাদ। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় আমাদের খাদ্যতালিকায় মাছের প্রাধান্য আগের মতো নেই। দেশের নদী, খালবিল ও হাওর-বাঁওড়ে এখন মাছের পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে। তবে আধুনিক মৎস্য চাষাবাদ পদ্ধতি ফের দেশকে মাছের বাড়তি জোগান এনে দিয়েছে। দেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় মাছের সরবরাহ ক্রমাগতভাবে বাড়ছে। এতে অভ্যন্তরীণ চাহিদা যেমন মিটছে, তেমনি বিশ্ববাজারেও বাড়ছে রপ্তানি। তবে এ খাতে এখন পর্যন্ত সমুদ্রের অবদান সামান্যই। এখন সমুদ্রে যে বিপুল অর্থনৈতিক এলাকা বাংলাদেশের আওতায় এসেছে, সেখানে মৎস্য সম্পদ আহরণের জন্য চাই প্রয়োজনীয় অবকাঠামো সুবিধা গড়ে তোলা। সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ আহরণের দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ২৫, অথচ মিঠাপানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে। সমুদ্র বিজয়ে দেশে ব্লু ইকোনমির ব্যাপক সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। দেশের উন্নয়নের জন্য অর্থনীতির সমৃদ্ধির জন্য এই সম্পদের দ্রুত ও কার্যকরভাবে কাজে লাগানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। মৎস্য খাতে সার্বিক উন্নয়নের জন্য দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টি এবং গভীর সমুদ্রে মৎস্য সম্পদ আহরণের জন্য বাংলাদেশ এ বিষয়ে ইতোমধ্যে সক্রিয় হয়ে উঠেছে বলে মনে হয়। ভারত ও মিয়ানমারের কাছ থেকে মীমাংসিত সমুদ্রসীমায় মাছের উৎপাদন বাড়াতে উদ্যোগী হয়েছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। এজন্য বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় দস্যুতা ও বিদেশি ট্রলারের অবৈধ অনুপ্রবেশ রোধে জনবল বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে। এর পাশাপাশি দেশে ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে ইলিশ ট্রাস্ট ফান্ড গঠনেরও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। দেশের মৎস্য সম্পদের আহরণ ও উন্নয়নে সরকারের উদ্যোগের মধ্যে রয়েছে, তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্পে মাছ চাষ, চিংড়িচাষিদের এক অঙ্কের সুদে ঋণ, চিংড়ির রেনু পোনা আহরণ বন্ধে দরিদ্র জেলেদের খাদ্য সহায়তা ও বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা, হস্তান্তরিত জলমহালগুলো মৎস্য অধিদপ্তরের অধীনে ন্যস্ত করা, হালদা নদী রক্ষায় রবার ড্যাম তুলে ফেলা, মৎস্য উৎপাদনে ব্যবহূত বিদ্যুৎ বিল ও ভূমি উন্নয়ন করে ছাড় দেয়া, মাছের খাবারের উপাদান আমদানিতেও শুল্কছাড়-সহ বেশকিছু উল্লেখযোগ্য গঠনমূলক প্রকল্প। মাছের উৎপাদন উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ায় জাতীয় অর্থনীতিতে নতুন প্রত্যাশার সৃষ্টি হয়েছে। কৃষির অন্যান্য খাত-উপখাতের তুলনায় মাছের উৎপাদন বাড়ার হার বেশি। বিগত বছরগুলোয় এ খাতে বছরে ১৫ লাখের বেশি মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। মৎস্য বিভাগের হিসাব অনুযায়ী সাগর এলাকায় প্রতি বছর ৮০০ মিলিয়ন টন মাছ ধরা পড়ে। এর মধ্যে মাত্র দশমিক ৭০ মিলিয়ন টন মাছ দেশের জেলেরা ধরে থাকে। বিশাল সমুদ্রসীমায় মৎস্য সম্পদের এক শতাংশও ধরতে পারছে না বাংলাদেশের জেলেরা উন্নত জাহাজ ও প্রযুক্তির অভাবে। অন্যদিকে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় কী পরিমাণ মৎস্য সম্পদ রয়েছে, সে ব্যাপারেও কোনো তথ্য সরকারের কাছে নেই। সমুদ্র থেকে আহরিত মাছ বিদেশে রপ্তানির মাধ্যমে অনায়সেই বিলিয়ন ডলার আয় করা যায়। এছাড়া মাছের তেল থেকে ওষুধ, সস প্রভৃতি তৈরি করা সম্ভব। এতে নতুন কর্মসংস্থানের পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনও সম্ভব। সমুদ্রে যে বিপুল অর্থনৈতিক এলাকা বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণে সেখানে মৎস্য সম্পদ আহরণের জন্য চাই প্রয়োজনীয় অবকাঠামো সুবিধা গড়ে তোলা। একই সঙ্গে দক্ষ জনবল তৈরির ওপরও গুরুত্ব দিতে হবে। মাছের বাজার নিয়ে দুর্ভাবনা নেই। বলা যায়, গোটা বিশ্বেই মাছের অপরিমেয় চাহিদা রয়েছে। এ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতকেও এগিয়ে আসতে হবে। এজন্য বিদেশি বিনিয়োগকেও স্বাগত জানাতে হবে।

মিয়ানমারের মতো সমুদ্রে মাছ ধরার সব নৌযানকে নিবন্ধনের আওতায় আনা এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে মৎস্য অধিদপ্তর করা উচিত। সামুদ্রিক জেলেদের জন্য ‘সামুদ্রিক মৎস্য পরামর্শ কেন্দ্র’ চালু করা যায়। এই কেন্দ্রের মাধ্যমে জেলেরা প্রতিদিন ‘মাছের বসতি’ সম্পর্কে জানতে পারবে। এতে জেলেদের অর্থ ও সময় বাঁচবে। এ কাজে মৎস্য বিজ্ঞানীদের লাগানো যায়। আধুনিক ট্রলার বা ফ্রিজার ঘন্টায় এক টনেরও বেশি মাছ ধরতে ও প্রক্রিয়াজাত করতে সক্ষম। ভারত, থাইল্যান্ড, মিয়ানমারসহ অনেক দেশই এ প্রক্রিয়ায় গভীর সমুদ্র থেকে মাছ ধরে প্রক্রিয়াজাত করে। উন্নত ট্রলারে থাকা-খাওয়ার সুবিধাও ভালো। এর চেয়ে বড় কথা, এগুলো অনেক নিরাপদ। ফলে এসব দেশের জেলেরা দীর্ঘদিন সমুদ্রে অবস্থান করে মাছ ধরতে পারে। মিয়ানমার ও ভারতের সমুদ্রসীমায় স্রোত ও ঢেউ বেশি থাকায় আমাদের জলসীমা থেকে তারা অনেক সময় মাছ ধরে নিয়ে যায়। সামুদ্রিক ঢেউ ও স্রোতের বিষয়টি মাথায় রেখে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীন নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) ও বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশন (বিএফডিসি) আধুনিক জাহাজ আমদানি করে পিপিপি’র মাধ্যমে বা কিস্তিতে জেলেদের দিতে পারে। ডেটাবেস করে সামুদ্রিক মাছ ধরার প্রতিটি নৌকা ও মালিককে সরকারি নিয়ন্ত্রণের আওতায় আনতে হবে। এছাড়া মৎস্য আহরণ বাড়াতে সামুদ্রিক নৌযান, ট্রলারগুলোয় আধুনিক প্রযুক্তি সংযোজন করে সমুদ্রের সর্বশেষ অবস্থা সব সময় জানানোর ব্যবস্থা করতে হবে। গভীর সমুদ্রে মৎস্য সম্পদ আহরণে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম প্রভৃতি দেশের সহায়তা নেওয়া যেতে পারে। হংকং, সিঙ্গাপুরের মতো দেশগুলো শুধু সমুদ্রকে ব্যবহার করেই বিশ্বে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হয়েছে। সমুদ্র শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় রয়েছে। আমাদের সমুদ্রসীমা নিয়ে অনেক দিন নানা ধরনের বিরোধ ছিল, এখন সে অবস্থা নেই। তারপরেও আমরা কেন আমাদের সমুদ্রসীমায় পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারছি না, সেটাও বিবেচনার বিষয়। সমুদ্রসম্পদ আহরণ এবং এর যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে আমাদের অর্থনীতির চেহারাও বদলে দেয়া সম্ভব। বিশেষ করে আমাদের সমুদ্রসীমায় মৎস্য সম্পদ আহরণে বিরাজমান সমস্যাগুলো অবিলম্বে দূর করা প্রয়োজন। এখনও আমাদের জেলেরা নির্বিঘ্নে নিশ্চিন্তে গভীর সমুদ্রে গিয়ে মাছ ধরতে পারছে না। তাদের জানমাল নানা হুমকির মধ্যে পড়ছে হরহামেশাই। সামগ্রিক বাস্তবতা অনাকাঙ্ক্ষিত ও অনভিপ্রেত। সমুদ্রসম্পদ অনুসন্ধান ও আহরণের ব্যাপারে বিলম্ব করার কোনো অবকাশ নেই। এক্ষেত্রে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশকেও এগিয়ে যেতে হবে।

একসময় এদেশ মাছের জন্য সমৃদ্ধ ছিল। কিন্তু এখন আর আগের সেই অবস্থা নেই। আগে যেখানে পুকুর, খাল, নদীনালা, বিলঝিলে মাছের আবাসস্থল ছিল, এখন সময়ের বিবর্তনে সব পাল্টে গেছে। মাছের আবাসস্থলগুলো ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে। সেইসঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের দেশে দেশীয় প্রজাতির বিভিন্ন ধরনের মাছ। দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে পুকুর, খাল ও বিল ভরাট করে নতুন নতুন বাড়িঘর নির্মাণের কারণে পুকুর ও খালবিল হারিয়ে যাচ্ছে। অপরদিকে নদীনালা ও বিলঝিলে কলকারখানার দুষিত বর্জ্য এসে এসব এলাকার পানি দূষিত করে ফেলছে। জমিতে চাষাবাদের জন্য কৃষকরা বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করায় দেশীয় প্রজাতির আবাসস্থলগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এসব কারণে আমাদের দেশে দুই দশক ধরে দেশীয় প্রজাতির মাছের বংশ বিস্তার ঘটছে না। ক্রমেই দেশীয় প্রজাতির বিভিন্ন ধরনের মাছ ক্রমেই বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। দেশীয় প্রজাতির মাছের জায়গায় এখন স্থান দখল করে বসেছে বিদেশি প্রজাতির হাইব্রিড মাছগুলো। কয়েক বছর ধরে আমাদের দেশে বিদেশি মাছের ব্যাপক চাষ হয়ে আসছে। এসব বিদেশি মাছের মধ্যে রয়েছে তেলাপিয়া, নাইলেটিকা, পাঙাশ, থাই কৈ, আফ্রিকান মাগুর পিরানহা, ঘ্রাসকার্প, সিলভারকার্পসহ আরো কিছু প্রজাতির মাছ। এসব হাইব্রিড মাছ চাষে অধিক লাভবান হওয়ায় মাছচাষিরা ব্যাপকভাবে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে মাছের চাষ করছেন, যে কারণে দেশের মানুকে বাধ্য হয়ে এসব হাইব্রিড জাতীয় মাছ খেতে হচ্ছে। এসব হাইব্রিড জাতীয় মাছের স্বাদ ও গন্ধ দেশি প্রজাতির মাছের মতো নয়। দেশি প্রজাতির মাছের স্বাদ ও গন্ধ অতুলনীয়। এসব দেশি প্রজাতির মাছ সীমিত আকারে আবার অনেকে চাষ শুরু করেছেন। প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, বিলুপ্তপ্রায় দেশি প্রজাতির মাছের মধ্যে রয়েছে পাবদা, টেংরা, পুঁটি, কৈ, মাগুর, শিং, শোল, গজার, বোয়াল, আইড়, চাপিলা, খলিসা, তারাবাইন, গলদাচিংড়ি, চাঁদা, তপসে, তিন কাটা, চিতল, ফলই-সহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। একসময় আমাদের দেশে ২৬০ প্রজাতির দেশীয় মাছ পাওয়া যেত। বর্তমানে ৫৪ প্রজাতির মাছের অস্তিত্ব বিপন্ন। এর মধ্যে ১৪০ প্রজাতির মাছের অস্তিত্ব চোখে পড়ে না। দেশীয় প্রজাতির মাছের অস্তিত্ব রক্ষায় দ্রুত উদ্যোগ নিতে হবে। এজন্য মৎস্য বিভাগকে এগিয়ে আসতে হবে। দেশীয় মাছের অস্তিত্ব রক্ষার উদ্দেশ্যে দেশীয় প্রজাতির মাছের ব্যাপক চাষের উদ্যোগ নিতে হবে। মৎস্য হ্যাচারিগুলো কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে মাছের পোনা উৎপাদনের করে দেশের বিভিন্ন স্থানে নতুন নতুন চাষের ক্ষেত্র তৈরি করে দেশি প্রজাতির মাছের চাষের ব্যবস্থা করতে পারে। বর্তমানে দেশের কিছু কিছু স্থানে দেশি প্রজাতির মাছের উৎপাদনের লক্ষ্যে অনেকেই এগিয়ে আসছেন। বিশেষ করে ময়মনসিংহ জেলার বিভিন্ন স্থানে দেশি প্রজাতির মাছের খামার গড়ে উঠেছে। দেশি প্রজাতির মাছ বিদেশি প্রজাতির মাছের তুলনায় দাম একটু বেশি। যে কারণে দেশি প্রজাতির মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানের পুকুর, বিল, ঝিল, নদী, নালা, খাল, হাওরগুলোকে মৎস্য চাষের উপযোগী করে তুলতে হবে। বিদেশি মাছের চাষ কমিয়ে দেশি প্রজাতির মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে। দেশের মানুষকে মাছের প্রকৃত স্বাদ গ্রহণের লক্ষ্যে দেশি প্রজাতির মাছের চাষের কোনো বিকল্প নেই। এজন্য সরকারের তরফ থেকে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। দেশের প্রতিটি জেলা, উপজেলায় সরকারি উদ্যোগে দেশি প্রজাতির মাছের হ্যাচারি গড়ে তুলে সেখান থেকে মাছের পোনা মৎস্যচাষিদের মাঝে বিতরণ করে দেশি মাছের চাষের ব্যাপারে উৎসাহিত করতে হবে। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, দেশি প্রজাতির মাছের চাষের উদ্যোগ নেয়া হলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে দেশি প্রজাতির মাছ আবার তার আগের অবস্থায় ফিরে আসবে।

অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলাম লেখক