প্রতিনিধি, যশোর : যশোরের মনিরামপুরের ঢাকুরিয়ার প্রতাপকাটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠে গতকাল শুক্রবার অনুষ্ঠিত হলো প্রায় ৭৫ বছরের পুরোনো ঐতিহ্যবাহী ‘জামাই মেলা’। দুর্গাপূজার বিজয়া দশমীর দিনে আয়োজিত এ ব্যতিক্রমী মেলায় প্রধান আকর্ষণ ছিল বড় আকারের দেশীয় মাছ। একেকটি মাছের ওজন ছিল ৫ থেকে ১৩ কেজি পর্যন্ত। আর এ মাছ ঘিরেই তৈরি হয় প্রতিযোগিতা, উৎসব আর আনন্দের মেলবন্ধন।
বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত দিনভর চলে এ মাছের মেলা। স্থানীয় বণিক সমিতির দাবিÑএক দিনেই এখানে বিক্রি হয়েছে প্রায় কোটি টাকার মাছ। তবে ক্রেতাদের অভিযোগÑস্বাভাবিক বাজারমূল্যের চেয়ে মাছের দাম কয়েকগুণ বেশি। তবুও আনন্দ আর ঐতিহ্যের টানে এ মেলায় মানুষের ভিড় কমে না।
প্রথা অনুযায়ী, স্থানীয় জামাইরা শ্বশুরবাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রতিযোগিতার মধ্যেই কিনে নেন এসব মাছ। সকাল থেকেই বাজারে ভিড় জমতে থাকে জামাইদের। কেউ কিনলেন সাড়ে ১২ কেজির কাতলা, কেউ বা সাড়ে আট কেজির রুই। শুধু মাছ নয়, সঙ্গে থাকে মুড়ি-মুড়কি, জিলাপি আর মুখরোচক খাবারও। শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে তা নিয়েই চলে মিলনমেলা ও ভোজ। ঢাকুরিয়ার প্রদীপ কুমার বাইন জানালেন, ‘প্রতি বছর বিজয়া দশমীতে শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার সময় এখান থেকে বড় মাছ কিনে নিয়ে যাই। মাছের সঙ্গে মিষ্টি-মুড়িও থাকে। শ্বশুরবাড়ির সবাই মিলে আনন্দ করে খাওয়া-দাওয়া করি।’
জামাই মেলা শুধু হিন্দু সম্প্রদায়ের নয়, মুসলিমসহ সব ধর্ম-বর্ণের মানুষ এখানে সমানভাবে অংশ নেন। অভয়নগর, সদরসহ আশপাশের বিভিন্ন উপজেলা থেকে ভিড় করেন ক্রেতা-বিক্রেতারা। স্থানীয়দের মতে, এ মেলা হয়ে উঠেছে এ অঞ্চলের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও লোকসংস্কৃতির প্রতীক।
৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এ মেলায় মাছ বিক্রি করছেন শংকর বিশ্বাস। তিনি বলেন, ‘আমার ঘের থেকে আজ ভোরে ৬৫টি বড় মাছ ধরেছি। রুই আর কাতলাই বেশি বিক্রি হয়। এ বছর সবচেয়ে বড় মাছ ছিল সাড়ে ১২ কেজি ওজনের। দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আসে শুধু এই মেলার জন্য।’
ঢাকুরিয়া প্রতাপকাটি বাজার বণিক সমিতির সভাপতি আব্দুল হান্নান গাজী বলেন, ‘১৯৫০ সাল থেকে চলে আসছে জামাই মেলা। এ অঞ্চলের ঐতিহ্য ও উৎসবের অংশ হয়ে উঠেছে এটি। জামাইদের প্রতিযোগিতামূলক মাছ কেনার আনন্দই এ মেলার মূল আকর্ষণ। আমরা এ ঐতিহ্য ধরে রাখতে নানা উদ্যোগ নিচ্ছি।’
মেলা ঘিরে আশপাশের গ্রামগুলোয় জমে ওঠে উৎসবের আমেজ। মেয়ে, জামাই আর নাতি-নাতনিদের আনাগোনায় সরগরম হয়ে ওঠে ঘরবাড়ি। মাছের সঙ্গে থাকে হরেক রকম পিঠা ও মিষ্টির আয়োজন। এক দিনের এ মেলায় স্থানীয় সংস্কৃতির রঙে রঙিন হয়ে ওঠে পুরো এলাকা।
ঐতিহ্যের সঙ্গে উৎসবের আবহ মিলে এখন জামাই মেলা শুধু মাছের বাজার নয়, হয়ে উঠেছে লোকসংস্কৃতির মহোৎসব।
প্রিন্ট করুন







Discussion about this post