শেয়ার বিজ ডেস্ক : যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারতের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করার পর কার্পেট রপ্তানিকারক সূর্যমণি তিওয়ারির ঘুম হারাম হয়ে গেছে। ৭৮ বছর বয়সী এই ব্যবসায়ী উত্তর প্রদেশের ভাদোহি থেকে প্রতিবছর যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ১০০ কোটি রুপির (প্রায় এক কোটি ১৪ লাখ ডলার) কার্পেট রপ্তানি করতেন। কিন্তু সর্বোচ্চ পর্যায়ের এই শুল্ক আরোপের পর ব্যবসা কার্যত থেমে গেছে। খবর- আল-জাজিরা।
তিওয়ারি আল-জাজিরাকে বলেন, ‘আমাদের ব্যবসা পুরোপুরি যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল। অন্য কোনো বাজার নেই। গত এক মাসে কোনো চালানই যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো যায়নি। এটা আমার ৫০ বছরের কার্পেট ব্যবসায় সবচেয়ে খারাপ সময়। আগামী দুই মাসে পরিস্থিতি না বদলালে শিল্পটার ভয়ানক মৃত্যু হবে।’
ভাদোহিকে ভারতের ‘কার্পেট সিটি’ বলা হয়। ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষিত শুল্কের কারণে এখানকার কয়েকশ’ রপ্তানিকারক ব্যবসা নিয়ে চরম আশঙ্কায় আছেন। প্রথমে গত ৭ আগস্ট ২৫ শতাংশ, পরে ২৭ আগস্ট রাশিয়ার তেল আমদানির কারণে বাড়তি আরও ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়। ট্রাম্প অভিযোগ করেছিলেন, রাশিয়া থেকে তেল কেনার মাধ্যমে ইউক্রেন যুদ্ধকে উসকে দিচ্ছে ভারত।
ভারতের কার্পেটশিল্প মূলত রপ্তানিনির্ভর। হাতে বোনা, হস্তশিল্প, পারস্য ধাঁচের নকশাÑ বিভিন্ন ধরনের কার্পেট যুক্তরাষ্ট্রে অত্যন্ত জনপ্রিয়। পুরো শিল্পের বার্ষিক আয় প্রায় ১৬ হাজার কোটি রুপি (১৮৩ কোটি ডলার)। এতে প্রায় ২৫ লাখ মানুষ কর্মরত, যাদের বেশির ভাগই তাঁতি।
এই শিল্পের ৮০ শতাংশই নিয়ন্ত্রণ করে ভাদোহি। এখানে প্রায় এক হাজার ২০০ কার্পেট রপ্তানিকারক ও প্রস্তুতকারক আছেন। প্রায় ১৪ লাখ মানুষের জীবিকা এই ব্যবসার ওপর নির্ভর করে, যাদের মধ্যে ৫ থেকে ৬ শতাংশ নারী।
কার্পেট রপ্তানি উন্নয়ন কাউন্সিলের পরিচালক পিয়ুষ বারনওয়াল বলেন, ‘এত বেশি শুল্ক আমাদের ধ্বংস করে দিয়েছে। পুরো শিল্পটাই রপ্তানিনির্ভর। দেশীয় বাজার খুবই সীমিত। যুক্তরাষ্ট্রই আমাদের প্রধান ক্রেতা, যা মোট রপ্তানির প্রায় ৬০ শতাংশ।’
পিয়ুষ আরও বলেন, ‘আলোচনা হবে, সমাধান বের হবেÑ এমন আশা ছিল; কিন্তু কিছুই হয়নি। এত বেশি শুল্ক দেয়া সম্ভব নয়। পাইকারি ব্যবসায়ীদের মুনাফা যেখানে ৮ থেকে ১০ শতাংশ, সেখানে ৫০ শতাংশ শুল্কের অর্থ শিল্পকে ‘মৃত্যুর মুখে’ ঠেলে দেয়া।’
কার্পেট রপ্তানিকারক সঞ্জয় গুপ্তা বলেন, এই শিল্প ছোট আকারের হলেও বিপুল কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে। এটি একধরনের কুটিরশিল্প, যেখানে তাঁতিরা বাড়ি থেকে কাজ করেন। তিনি বলেন, ‘এই শিল্পে তাঁতিরাই আসল শক্তি। হঠাৎ শুল্ক বৃদ্ধি করায় অনেক মানুষ বেকার হয়ে অন্য রাজ্যে চলে যেতে বাধ্য হবেন। পরে তাদের ফিরিয়ে আনা কঠিন হবে।’ গত এপ্রিল মাস থেকে তিনি তার ব্যবসার ৪০ শতাংশ হারিয়েছেন। ফলে তাঁতিদের কমিশনও কমাতে হয়েছে।
রপ্তানিকারকদের ভয়, তুরস্ক (১৫ শতাংশ শুল্ক) ও পাকিস্তান (১৯ শতাংশ শুল্ক) যুক্তরাষ্ট্রের কার্পেটের বাজার দখল করে নেবে। মোহাম্মদ জাকির হোসেন বলেন, ‘আমরা মার্কিন বাজারের বড় অংশ হারাতে পারি। দ্রুত সমাধান না হলে আমাদের ভাগ কমে যাবে।’
কার্পেট রপ্তানির সঙ্গে জড়িত মধ্যস্বত্বভোগীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। যেমন মোহাম্মদ জামির আহমেদ তুলা ও সুতা সরবরাহ করতেন। তিনি বলেন, এখন সেই সামান্য বাজারও শেষ হয়ে গেছে। অতিরিক্ত মার্কিন শুল্ক ঘোষণার পর থেকে কার্পেটশিল্পে ছাঁটাই শুরু হয়েছে। দিনমজুর তাঁতিরা প্রায় বেকার হয়ে গেছেন এবং অন্য রাজ্যে চলে যাচ্ছেন।অল ইন্ডিয়া কার্পেট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি রাজা খান বলেন, ইতোমধ্যে প্রায় এক লাখ মানুষ বেকার হয়ে গেছেন। দুই মাসের মধ্যে সংখ্যা সাত লাখে পৌঁছাতে পারে।
কার্পেটের কিনারা সেলাই করে যিনি প্রতিঘণ্টায় ৬০ রুপি পান, সেই ফাতিমা সামিরের আয় কমে গেছে। তিন কন্যার মা ফাতিমা বাধ্য হয়ে ছোট মেয়েকে স্কুল থেকে বিরত রাখছেন। তার স্বামীও কাজের অভাবে এপ্রিল মাসে অন্য শহরে গিয়ে কোমল পানীয় কারখানায় কাজ নিয়েছেন।
্যদিকে কার্পেট প্রস্তুতকারক ইমতিয়াজ আনসারি জানান, তারা কর্মীদের কাজ কমিয়ে সপ্তাহে তিন দিনে নামিয়ে এনেছেন। চার হাজার তাঁতি একমাস ধরে কাজ পাচ্ছেন না। ৯০ শতাংশ ক্রয়াদেশ বন্ধ। শুধু পুরোনো যেসব ক্রয়াদেশ সরবরাহ বাকি ছিল, সেগুলোর কাজ শেষ করা হচ্ছে।
স্থানীয় সাংবাদিক ওবায়দুল্লা আসরি বলেন, ‘কারখানাগুলো ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে কার্পেট তৈরি করে। কিন্তু কার্পেট বিক্রির অর্থ ফেরত পাওয়া যায় দু-তিন মাস পর। ক্রয়াদেশ কমে যাওয়ায় শুধু শিল্পই নয়, শহরের পুরো অর্থনীতিই ধসে পড়বে। বিদেশি আয় কমে যাওয়ায় মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। দোকানপাট খালি হয়ে যাচ্ছে।’

Discussion about this post