রামিসা রহমান : সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সময় ইতালি থেকে আইসক্রিম আমদানি বেড়ে যাওয়ায় এই খাতের বাণিজ্যচিত্র পুরোটাই বদলে গেছে। এ কারণে সম্প্রতি ট্রাম্প প্রশাসন আইসক্রিমপ্রেমী বাইডেনকে নিয়ে এক ঠান্ডা বিদ্রুপ করে বলেছে, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের আইসক্রিম খাতকে অর্থনৈতিকভাবে কঠিন পথে ঠেলে দিয়েছেন। খবর আল জাজিরার।
২০২৪ সালের ২০ জুলাই ‘এক্স’ প্ল্যাটফর্মে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধি অফিস লিখেছে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নেতৃত্বে ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্র আইসক্রিম বাণিজ্যে উদ্বৃত্ত ছিল, কিন্তু প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সময় সেই উদ্বৃত্ত বদলে গিয়ে ৪০ দশমিক ৬ মিলিয়ন ডলারের ঘাটতিতে পরিণত হয়েছে। এই পোস্টে একটি চার্ট ছিল যেখানে জাপান, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ব্রাজিল, কানাডা ও তুরস্কের সঙ্গে আইসক্রিম বাণিজ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাটতির চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
২০২১ সালে, যখন বাইডেন দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখনই যুক্তরাষ্ট্রের আইসক্রিম বাণিজ্যের ভারসাম্যে বড় পরিবর্তন আসে। ২০২২ সালে এই ভারসাম্য আনুষ্ঠানিকভাবে নেতিবাচক হয় অর্থাৎ, আমদানি রপ্তানিকে ছাপিয়ে যায় এবং তারপর থেকে এমনটাই চলছে।
তবে শিল্প বিশেষজ্ঞদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রে যত আইসক্রিম খাওয়া হয় তার একটি ক্ষুদ্র অংশই আমদানিকৃত, আর রপ্তানি হয় মোট উৎপাদনের খুব সামান্য অংশ। এই বাণিজ্য পরিবর্তনের মূল কারণ ছিল আমদানি হঠাৎ বেড়ে যাওয়া। ২০২০ সাল থেকে রপ্তানির পরিমাণ প্রায় একই রকম আছে।
আইসক্রিম আমদানি বেড়ে যাওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রে বাণিজ্য ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে। ১৯৯৫ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র নিয়মিতভাবে আইসক্রিম রপ্তানিতে লাভবান ছিল, লাভের পরিমাণ ছিল প্রায় ২০ মিলিয়ন থেকে ১৬০ মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত। ২০২১ সালে সেই লাভ প্রায় শূন্যে এসে দাঁড়ায়, আর ২০২২ ও ২০২৩ সালে যথাক্রমে ৯২ মিলিয়ন ও ৩৩ মিলিয়ন ডলারের ঘাটতি দেখা যায়।
ডেইরি অর্থনীতিবিদ বেটি বার্নিং বলেছেন, ঠান্ডা ও হিমায়িত পণ্য বিদেশে পাঠানো বেশ ব্যয়সাধ্য। তবে অনেক আমেরিকান ও ইউরোপীয় কোম্পানি বৈশ্বিক বাজারে প্রবেশ করেছে। হেরিক বলেন, অনেক সময় ভোক্তারা এমন কোনো বিশেষ স্বাদের আইসক্রিম চান যা অন্য দেশের ঐতিহ্যবাহী বা জনপ্রিয়।
ইতালি এখন যুক্তরাষ্ট্রে আইসক্রিম আমদানির সবচেয়ে বড় উৎস। ২০২০ সালে যা ছিল ১২ মিলিয়ন ডলার, তা ২০২১ সালে বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৬৫ মিলিয়ন ডলার। এর পেছনে রয়েছে প্রিমিয়াম বা বিশেষ স্বাদের প্যাকেটজাত আইসক্রিমের প্রতি ভোক্তাদের আগ্রহ বাড়া।
যুক্তরাষ্ট্রে যত আইসক্রিম তৈরি হয়, সেই তুলনায় আমদানি বা রপ্তানি অনেক কম। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগ জানায়, ২০২৪ সালে দেশে তৈরি হয়েছে ১ দশমিক ৩১ বিলিয়ন গ্যালন আইসক্রিম। সেই তুলনায় আমদানি হয়েছে মাত্র ২ দশমিক ৩৫ মিলিয়ন গ্যালন মোট উৎপাদনের শূন্য দশমিক ১৮ শতাংশ। রপ্তানি হয়েছে ১৬ দশমিক ৪ মিলিয়ন গ্যালন, যা মোট উৎপাদনের একটু বেশি, প্রায় ১ শতাংশ।
বাণিজ্য তথ্যের মধ্যে আইসক্রিম তৈরির মিশ্রণ থাকে না, অথচ এডিবল আইস (আইসক্রিম) ধরা হয়, যা পুরো চিত্রকে বিকৃত করে। যদি এডিবল আইস বাদ দেয়া হয় আর মিক্স ধরা হয়, তাহলে দেখা যায় ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র আসলে ১৯৩ মিলিয়ন ডলারের লাভে ছিল। দুগ্ধজাত পানীয়র রপ্তানি গত ৫ বছরে ৬২১ শতাংশ বেড়েছে। ২০২৪ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নে যুক্তরাষ্ট্র প্রায় ৩৫ মিলিয়ন ডলারের মিক্স রপ্তানি করেছে।
আমেরিকানদের সঙ্গে দুগ্ধজাত আইসক্রিমের শতাব্দী প্রাচীন প্রেম কি ধীরে ধীরে গলছে? হোয়াইট হাউসে বরাবরই আইসক্রিমপ্রেমীদের অভাব ছিল না। জর্জ ওয়াশিংটন রাজধানীতে আইসক্রিম তৈরির সরঞ্জাম মজুত করেছিলেন। থমাস জেফারসনের নাম যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম আইসক্রিম রেসিপি লিপিবদ্ধ করার কৃতিত্বে যুক্ত। রোনাল্ড রেগান ১৯৮৪ সালে জুলাই মাসকে ‘জাতীয় আইসক্রিম মাস’ হিসেবে ঘোষণা করেন। বারাক ওবামাও তরুণ বয়সে আইসক্রিম বিক্রি করতেন।
বাইডেন, যাকে প্রায়ই হাতে আইসক্রিম কোণসহ দেখা যেত, ২০১৬ সালে জেনির স্প্লেন্ডিড (বাহারি) আইসক্রিম অফিসে গিয়ে বলেছিলেন: আমার নাম জো বাইডেন এবং আমি আইসক্রিম ভালোবাসি।
তবে নিয়মিত দুগ্ধজাত আইসক্রিমের (যার মধ্যে হিমায়িত দধি, শরবত, বা কম ক্যালরিযুক্ত আইসক্রিম পড়ে না) ভোক্তা চাহিদা বছরের পর বছর ধরে কমে আসছে। ১৯৭৫ সালে একজন আমেরিকান গড়ে ১৮ দশমিক ২ পাউন্ড আইসক্রিম খেতেন প্রতি বছর, যা ২০২৩ সালে কমে ১১ দশমিক ৭ পাউন্ডে দাঁড়িয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধি অফিস গ্রীষ্মকালে এক ঠান্ডা খবর দেয়: ২০২০ সালে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অধীনে যুক্তরাষ্ট্র আইসক্রিম বাণিজ্যে লাভে ছিল, কিন্তু প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সময়ে সেই লাভ বদলে ৪০ দশমিক ৬ মিলিয়ন ডলারের ঘাটতিতে রূপ নেয়। এটা সত্য যে বাইডেন প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে যুক্তরাষ্ট্র ২৫ বছর ধরে আইসক্রিম বাণিজ্যে লাভবান ছিল, আর তার সময়েই ঘাটতিতে যায়।
তবে বাণিজ্য প্রতিনিধি অফিসের মন্তব্যটি ঘাটতিকে অতিরঞ্জিত ও নাটকীয়ভাবে তুলে ধরে। এই বিজনেস সানডে-র রয়েছে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ প্রেক্ষাপট: ১। পরিবর্তনের মূল কারণ ছিল আমদানি হঠাৎ বেড়ে যাওয়া। ২। ২০২০ থেকে রপ্তানি প্রায় অপরিবর্তিত রয়েছে। ৩। আমদানি ও রপ্তানির পরিমাণ ঘরোয়া উৎপাদনের তুলনায় প্রায় তুচ্ছ। তথ্যসেটের মধ্যে কোন পণ্যগুলো থাকবে বা থাকবে না, সে বিষয়ে মতবিরোধ রয়েছে, যা পুরো প্রবণতা বিশ্লেষণকে বিকৃত করতে পারে। যদি এডিবল আইস বাদ দিয়ে আইসক্রিম মিশ্রণ যুক্ত করা হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র আসলে লাভেই থাকে। এই মন্তব্যটি তথ্যগতভাবে সঠিক, তবে এতে কিছু ব্যাখ্যা ও প্রেক্ষাপট যোগ করা প্রয়োজন। তাই আমাদের মূল্যায়ন: এটি প্রায় সত্য।

Discussion about this post