শেখ শাফায়াত হোসেন ও নুরুন্নাহার চৌধুরী কলি : বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ দিকে লুটেরারে হাতে পড়ে ভঙ্গুর হয়ে পড়েছিল দ্বিতীয় প্রজম্নের অন্যতম শক্তিশালী ব্যাংক ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি) পিএলসি। তবে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ব্যাংকটি পুনর্গঠন করে এর পর্ষে কয়েকজন দক্ষ পরিচালক নিয়োগ দেয় সরকার। তাদের হাত ধরে অল্প সময়ের মধ্যে ব্যাংকটিতে দক্ষ ব্যবস্থাপনা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং দ্রুত ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। আমানত সংগ্রহ, ঋণ আদায়, ব্যবসা বৃদ্ধিসহ ব্যাংকটির সব সূচক এখন ঊর্ধ্বমুখী। বাংলাদেশ ব্যাংক ও ইউসিবি সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, চলতি ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে (জানুয়ারি-জুন) ইউসিবির নিট আমানত বেড়েছে ৭ হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা, যা ব্যাংকটির নির্ধারিত বাজেট (৫১০০ কোটি টাকা) ও লক্ষ্য (৬০০০ কোটি টাকা) উভয়কেই ছাড়িয়ে গেছে। এই প্রবৃদ্ধি বার্ষিক হিসাবে ২৮ শতাংশ হারে বৃদ্ধির সমতুল্য, যা পুরো শিল্প খাতের গড় প্রবৃদ্ধির তিন গুণেরও বেশি।
কেবল ২০২৫ সালের জুন মাসেই ইউসিবি ২ হাজার ৫৩৮ কোটি টাকা নিট আমানত বেড়েছে, যা ব্যাংকটির ইতিহাসে সর্বোচ্চ। ইউসিবির মোট আমানতের পরিমাণ এখন ৬৩ হাজার ২০৪ কোটি টাকা, যা গ্রাহক আস্থা ও কার্যকর ব্যবস্থাপনার প্রমাণ।
২০২৪ সালের পুরো বছরের তুলনায় ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে যে পরিমাণ আমানত বেড়েছে, সেটা ২০২৪ সালের পুরো বছরে মোট যে বৃদ্ধি হয়েছিল, তার প্রায় চার গুণ (৩৮১ শতাংশ)। অর্থাৎ মাত্র ছয় মাসেই গত বছরের পুরো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি আমানত জমা হয়েছে ব্যাংকটিতে।
২০২৩ সালের পুরো সময়ের তুলনায়ও এই বৃদ্ধি প্রায় দ্বিগুণ (১৭৮ শতাংশ)। ২০২২ সালের পুরো সময়ের মোট প্রবৃদ্ধির চেয়েও এটি চার গুণের বেশি (৪৩১ শতাংশ)। ২০২১ সালের পুরো সময়ের মোট আমানত প্রবৃদ্ধির চেয়েও চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে আমানত প্রবৃদ্ধি ঘটেছে চার গুণের বেশি (৪৩৫ শতাংশ)।
ইউসিবির আমানত বৃদ্ধির খাতওয়ারি বিশ্লেষণে দেখা যায়, ৫৬ শতাংশ এসেছে রিটেইল (খুচরা) গ্রাহকদের কাছ থেকে, যা সাধারণ মানুষের আস্থার প্রতিফলন বলে মনে করে ব্যাংকটির কর্তৃপক্ষ। ৩২ শতাংশ করপোরেট গ্রাহকদের থেকে, যা প্রাতিষ্ঠানিক আস্থা বৃদ্ধির ফলে ঘটেছে; ১২ শতাংশ এসেছে এসএমই (ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা) খাত থেকে, যা উদ্যোক্তাকে উৎসাহিত করার জাতীয় কৌশলের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
আমানতের এই বহুমাত্রিক উৎস ইউসিবির স্থিতিশীলতা ও ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনাকে শক্তিশালী করেছে। ইউসিবির ঋণ-আমানত অনুপাত (এডিআর) বর্তমানে ৮৭ দশমিক ৫ শতাংশ, যা ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরের ৯২ দশমিক ৫ শতাংশ এবং ডিসেম্বরের ৯১ দশমিক ৩ শতাংশ থেকে অনেক স্বস্তিদায়ক। দেশের অনেক ব্যাংক যেখানে অতিরিক্ত ঋণ বিতরণের কারণে তারল্য ঝুঁকিতে পড়েছে, সেখানে ইউসিবি এই অনুপাত কমিয়ে একটি দৃঢ় আর্কি ভিত্তি গড়ে তুলেছে।\
এ বিষয়ে ব্যাংকটির বর্তমান চেয়ারম্যান শরীফ জহীর শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আমাকে গত বছরের সেপ্টেম্বরে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেয়ার পর থেকে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করতে চেষ্টা করি। এক্ষেত্রে আমরা আমানত প্রবৃদ্ধি ও ঋণের গুণগত মান নিশ্চিতে জোর দেই। পাশাপাশি বিগত সময়ের মন্দঋণ আদায়েও তৎপর হয় ব্যাংকটি। ক্ষ মানবসম্প দিয়ে ব্যাংকটি পরিচালনার ক্ষেত্রেও আমরা নজর দিয়েছি।’
এর উপকারিতা দেখতে পাচ্ছেন বলে মন্তব্য করেন ইউসিবি চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, ’আমরা ঋণঝুঁকি নির্ণয়, অডিট কমিটিসহ সবগুলো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় যোগ্য লোকজনদের দায়িত্ব দিয়েছি। তারা সবাই সম্মিলিতভাবে ব্যাংকটির আর্থিক স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য কাজ করছে বলেই আমরা দ্রুত সময়ে দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখতে পাচ্ছি।’
শরীফ জহীর ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের স্পন্সর শেয়ারহোল্ডার প্রয়াত হুমায়ুন জহিরের বড় ছেলে। তিনি তৈরি পোশাক খাতের বড় প্রতিষ্ঠান অন্তত গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা। এছাড়াও তার অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট, রিয়েল এস্টেট এবং পর্যটন খাতসহ একাধিক খাতে বিনিয়োগ রয়েছে। এর আগেও তিনি দীর্ঘ সময় ধরে ইউসিবি বোর্ডে ছিলেন। শরীফ জহীর ২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ব্যাংকটির ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
জানা গেছে, ১৯৮৪ সালে চট্টগ্রাম ভিত্তিক ব্যবসায়ীরে একটি গ্রুপের হাতে ইউসিবি ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। শুরুতে সুনামের সঙ্গে গ্রাহক সেবা দিলেও সাইফুজ্জামান চৌধুরীর পরিবার দখলে নেয়ার পর পরিস্থিতির অবনতি হতে শুরু করে। একের পর এক ঋণ কেলেঙ্কারিতে যুক্ত হতে থাকে ব্যাংকটির নাম।
২০১৬ সালে ইউসিবির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৭৯২ কোটি টাকা। ২০২৩ সালে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে আড়াই হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। তবে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হলে খেলাপি ঋণের তথ্য আরও বেশি হবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
এর মধ্যেই সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদ যুক্তরাজ্যে প্রায় ২০ কোটি পাউন্ড মূল্যের ৩৫০টিরও বেশি সম্পত্তি নিয়ে গড়ে তুলেছেন বলে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। তিনবারের এই সংসদ সদস্যের সম্পত্তির মধ্যে রয়েছে সেন্ট্রাল লন্ডনের বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট থেকে শুরু করে টাওয়ার হ্যামলেটসে আবাসন, যেখানে ইংল্যান্ডের বৃহত্তম বাংলাদেশি কমিউনিটির আবাসস্থল এবং লিভারপুলে শির্ক্ষাীদের জন্য আবাসিক ভবন। বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) তথ্য অনুযায়ী সাইফুজ্জামান ও তার স্ত্রী রুখমিলা জামান যুক্তরাষ্ট্র ও দুবাইতেও বিপুল সম্প গড়ে তুলেছেন।
তবে গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে সরকার পতনের পরপরই ইউসিবির নেতৃত্বেও পরিবর্তন ঘটে। একই সময়ে আরও বেশ কয়েকটি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষে পরিবর্তন আনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপর একে একে বের হতে থাকে বিভিন্ন ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পাহাড়। সামগ্রিকভাবে ব্যাংক খাতের আমানতকারীরে মধ্যে অস্থিরতা কাজ করতে শুরু করে। ঋণ বিতরণেও নেমে আসে স্থবিরতা। সারাদেশে ব্যাংকিং খাতে নিট আমানত প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশে নেমে এসেছে, যা আগের তুলনায় অনেক কম। অনেক ব্যাংক নিট অর্থপ্রবাহে ঋণাত্মক প্রবণতা দেখা দেয়।
তবে একই সময়ে কিছু ব্যাংকে আমানত প্রবাহ বেড়েছে। এই ব্যাংকগুলোর মধ্যে ইউসিবি একটি। এই অসাধারণ সাফল্যের পেছনে রয়েছে সুশাসন, দূরদর্শী কৌশল নির্ধারণ এবং কঠোর বাস্তবায়নের সক্ষমতা। ইউসিবির ভবিষ্যৎমুখী পরিকল্পনা, ডিজিটাল ব্যাংকিং অবকাঠামোতে বিনিয়োগ, অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ শক্তিশালীকরণ এবং গ্রাহক-কেন্দি ক পণ্য উন্নয়নের মাধ্যমে দ্রুত ক্ষতি কাটিয়ে আর্থিক উন্নতির দিকে ধাবিত হচ্ছে।