নিজস্ব প্রতিবেদক : ট্যাক্স ফাঁকি দেয়ার জন্য যারা রপ্তানির আড়ালে অর্থ পাচার করে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যে কোনো মূল্যে আন্ডার ইনভয়েসিং ও ওভার ইনভয়েসিং বন্ধে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে কড়াকড়ি নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। কারণ, এর মাধ্যমে দেশ বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হয়। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক দাবি করছে, তারা আগেই অর্থ পাচার রোধে পদক্ষেপ নিয়েছে, তবু ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের ঘটনা আর না ঘটে, সে বিষয়ে নতুন করে নির্দেশনা দিয়েছেন গভর্নর।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর এবং আগের বৈঠকের প্রায় ১০ মাস পর বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের নিয়ে এই প্রথম ব্যাংকার্স সভা অনুষ্ঠিত হলো। সভায় ব্যাংক খাতকে স্থিতিশীল ও আগের চেয়ে শক্তিশালী করতে একাধিক নির্দেশনা দেন গভর্নর।
গভর্নর ড. আহসান এইচ. মনসুরের সভাপতিত্বে এ সভায় উপস্থিত ছিলেন ডেপুটি গভর্নর, সংশ্লিষ্ট বিভাগের নির্বাহী পরিচালক এবং ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকরা।
বৈঠক শেষে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান সাংবাদিকদের জানান, আমদানি দায় পরিশোধের পরও যেসব ব্যাংক গ্রাহকের নামে ফোর্স লোন সৃষ্টি করছে না, তাদের সতর্ক করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এলসি দায় পরিশোধের পর তাৎক্ষণিকভাবে গ্রাহকের নামে ফোর্স লোন তৈরি করতে হবে। পাশাপাশি আন্ডার ইনভয়েসিং ও অর্থ পাচার রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
সৈয়দ মাহবুবুর রহমান আরও জানান, জুলাই অভ্যুত্থানে শহিদ পরিবার এবং আহতদের জন্য ব্যাংকারদের একটি ফান্ড গঠন করা হবে। এতে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ অন্যান্য বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো অংশগ্রহণ করবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান জানান, ফান্ডের পরিমাণ হতে পারে প্রায় ২৫ কোটি টাকা।
এমডি জানান, সঞ্চয়পত্রের পরিবর্তে সরকার ট্রেজারি বিল ও বন্ডকে বেশি উৎসাহিত করছে। আমানতের মতোই যাতে সাধারণ মানুষ ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ করতে পারে, সে বিষয়ে উদ্যোগ নিতে ব্যাংকগুলোকে পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
প্রসঙ্গত, ঝুঁকিমুক্ত বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচিত সরকারের ঋণগ্রহণের উপকরণ ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বর্তমানে সঞ্চয়পত্র ও ব্যাংকের তুলনায় বেশি সুদ পাওয়া যাচ্ছে। এক বছর মেয়াদি ট্রেজারি বিলে সুদের হার এখন ১১ দশমিক ৬০ শতাংশ এবং দীর্ঘমেয়াদি বন্ডে ১২ দশমিক ১৭ শতাংশ পর্যন্ত। এগুলোতে বিনিয়োগের কোনো কর দিতে হয় না, বিনিয়োগের ঊর্ধ্বসীমাও নেই এবং চাইলে অন্যের কাছে বিক্রিও করা যায়। এসব কারণে বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ দ্রুত বাড়ছে। তবে সুদের হার বাড়লেও অনেক ব্যাংক প্রত্যাশিত আমানত পাচ্ছে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান জানান, ডিজিটাল ব্যাংকিংকে গুরুত্ব দেয়ার নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে ব্যাংকগুলোকে। গ্রাহকরা যাতে অনলাইনে বা মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে ব্যাংকিং সেবা গ্রহণ করতে পারেন, সে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলা হয়েছে। এতে গ্রাহকদের ব্যাংকের শাখায় সশরীরে যেতে হয় না, ফলে সময় ও অর্থ সাশ্রয় হয়। একই সঙ্গে এলসি দায় পরিশোধের সঙ্গে সঙ্গেই ফোর্স লোন সৃষ্টি করার কড়া নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কারণ এখন থেকে নন-ব্যাংকিং কার্যক্রম সহ্য করা হবে না।
এদিকে, ১ জুলাই অর্থ মন্ত্রণালয় একটি পরিপত্র জারি করে পারিবারিক সঞ্চয়পত্রসহ চারটি প্রধান সঞ্চয়পত্রের নতুন সুদহার ঘোষণা করেছে। পরিপত্র অনুযায়ী, পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রে সাড়ে সাত লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগে সুদহার হবে ১১ দশমিক ৮৩ শতাংশ, যা আগে ছিল ১২.৩৭ শতাংশ। তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রে সুদের হার হবে ১১ দশমিক ৮২ শতাংশ, যা আগে ছিল ১২ দশমিক ৩০ শতাংশ। পারিবারিক সঞ্চয়পত্রের পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্তিতে সুদহার ১২ দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১১ দশমিক ৯৩ শতাংশ করা হয়েছে। অন্যদিকে পেনশনার সঞ্চয়পত্রে সুদহার এখন ১১ দশমিক ৯৮ শতাংশ, যা আগে ছিল ১২ দশমিক ৫৫ শতাংশ।
উল্লেখ্য, অর্থনীতিতে অনিয়ম ও দুর্নীতি তদন্তে গঠিত শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ১৫ বছরে প্রতি বছর গড়ে ১৬ বিলিয়ন ডলার করে অর্থ পাচার হয়েছে। বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ৯২ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ শেখ হাসিনার ১৫ বছরে মোট পাচার হয়েছে ২৪০ বিলিয়ন ডলার, যা বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ২৮ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক চিত্র তুলে ধরতে অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে ১২ সদস্যের শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠন করা হয়।