মীর আনিস : ই-কমার্সের আড়ালে মাল্টিলেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) ব্যবসা করা ‘আমার বাজার লিমিটেড’ গ্রাহকের জমা করা কয়েক কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
বর্তমানে প্রায় পাঁচ লাখ গ্রাহকের অর্থ লুটে প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ করে দিয়েছেন এর উদ্যোক্তা আশরাফুল আমিন। রাজধানীর পল্টনের কাশফিয়া প্লাজায় ছিল আমার বাজার লিমিটেডের আলিশান অফিস।
বর্তমানে রামপুরার একটি বাসায় দুই রুমের অফিস নিয়ে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে আশরাফুল আমিন।
আর্থিক খাতের গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) প্রতিষ্ঠানটির সন্দেহজনক লেনদেন এবং প্রতারণার প্রমাণ পেয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চালাচ্ছে প্রশাসন। এর আগে আওয়ামী সরকারের দোসর ও হাইকোর্ট মনোনীত পর্ষ চেয়ারম্যান প্রশান্ত বড়ুয়া তদবির করে বিষয়টি ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করেন।
ভুক্তভোগী গ্রাহক ও পুলিশ জানিয়েছে, আমার বাজার লিমিটেড একটি এমএলএম ঘরানার ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনার মূল দায়িত্বে রয়েছেন ডেসটিনি-২০০০ লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ডেসটিনি ট্রেনিং সেন্টারের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আশরাফুল আমিন।
অভিযোগ রয়েছে, প্রায় পাঁচ লাখ গ্রাহকের কাছ থেকে বিনিয়োগের নামে টাকা তোলে এই প্রতিষ্ঠান; যা দেশের প্রচলিত আইনে বৈধ কার্যক্রম নয়। জানা গেছে, গ্রাহকরে কাছ থেকে এক হাজার টাকা থেকে শুরু করে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত টাকা তোলে প্রতিষ্ঠানটি। বেশির ভাগ গ্রাহকের টাকা ফেরত না েিয় প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ করে দেয়া হয়। এতে গ্রাহকের টাকা ফেরত পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা খোদিয়েছে।
বিএফআইইউয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আমার বাজারে চারটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে টাকা জমা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি থেকে ৫ কোটি ১২ লাখ টাকা রাজীব হাসানসহ কয়েকজন ব্যক্তি নগদ উত্তোলন করেছেন। ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান থেকে অধিকাংশ নগদ উত্তোলন অস্বাভাবিক হিসেবে প্রতীয়মান হয়। এভাবে নগদ অর্থ উত্তোলন ও উৎস গোপন করে আত্মসাৎ করা হয়েছে কি নাÑসেটির গভীর অনুসন্ধান প্রয়োজন। আমার বাজারে নগদ মার্চেন্ট হিসাব থেকে ১৫ হাজার ১০৬টি এমএফএস হিসাবে ৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা পাঠানো হয়েছে। বিষয়টি সন্দেহজনক হওয়ায় অনুসন্ধান প্রয়োজন বলে সংস্থাটি মনে করে।
বিভিন্ন গ্রাহককে প্রতারণার বিষয়টি উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, পণ্য সরবরাহের প্রলোভন দেখিয়ে গ্রাহকদের কাছ থেকে অগ্রিম র্অ নিয়ে পণ্য না দেয়া প্রতারণার শামিল। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন অনুযায়ী এটা একটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
উল্লেখ্য, ২০১৭ সালে মো. আশরাফুল আমিন গ্রাহকের টাকায় ‘আমার বাজার লিমিটেড’ নামের প্রতিষ্ঠানটি চালু করেন। এমএলএমের আদলে প্রতিষ্ঠানটি ই-কমার্সের মাধ্যমে পণ্য বিক্রি করত।
তবে এমএলএম ব্যবসার মডেলে ই-কমার্স ব্যবসা করায় ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব) তাদের সদস্যপদ স্থগিত করতে চেষ্টা করে। তবে প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে আবেদন করা ওই দফায় তাদের সদস্য পদ বহাল থাকে।
জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারহোল্ডার ৫২ জন। চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন মো. মামুনুর রশিদ। ম্যানেজিং ডিরেক্টর (এমডি) হিসেবে নাম রয়েছে মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের। তারা ওই গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকলেও পরিচালনার মূল দায়িত্বে ছিলেন আশরাফুল আমিন। প্রতিষ্ঠানটিতে তার পদবি ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর। মূলত ডেসটিনির আদলে গড়ে তোলা এ প্রতিষ্ঠানটি আশরাফুল আমিনই পরিচালনা করেন।
গ্রাহকরা অভিযোগ করেন, ডেসটিনির আদলে গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠানটিতে গ্রাহকের কাছ থেকে নগদ টাকাই নিতেন। পণ্য কেনার কিছু টাকা ব্যাংক ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে নেয়া হতো। ফলে অধিকাংশ টাকার ব্যাংকিং লেনদেনের তথ্য নেই। গ্রাহকের পাশাপাশি শেয়ারহোল্ডার ও পণ্য বিক্রি করা প্রতিষ্ঠানগুলোর শতকোটি টাকারও বেশি পাওনা রয়েছে আমার বাজার লিমিটেডের কাছে। পাওনাদাররে পাওনা না দিয়ে পল্টনের অফিস বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এখন রামপুরার একটি বাসায় লুকিয়ে প্রতিষ্ঠানের প্রতারণার কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।
গ্রাহকরা জানিয়েছে, মাত্র এক হাজার ১০০ টাকা দিয়েই আমার বাজার লিমিটেডের সদস্য করা হতো। পণ্যসহ সদস্য হতে জমা দিতে হতো এক হাজার ৫০০ টাকা। এভাবে পণ্য য়োর কথা বলে নিবন্ধিত গ্রাহকের মাধ্যমে সারাদেশে প্রায় পাঁচ লাখ সদস্য থেকে টাকা সংগ্রহ করে আমার বাজার লিমিটেড। এ কাজে নানা চমকপ্রদ বিজ্ঞাপন ও লোভনীয় অফার ঘোষণা দেয়া হতো। এছাড়া মাঝেমধ্যেই বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানির সঙ্গে নানা ধরনের চটকদার খবর বিজ্ঞাপন আকারে প্রচার করে গ্রাহকদের প্রলুব্ধ করা হতো। গ্রাহকরা আশরাফুল আমিনকে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন।
এ বিষয়ে আশরাফুল আমিনের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘আমার একটা ই-কমার্স কোম্পানি ছিল। তখন ই-কমার্স সংক্রান্ত আইন হয়নি। ২০২১ সালে যখন আইন হলো আমরা দেখলাম ই-কমার্স আইনের বিধিবিধান আমাদের সঙ্গে যায় না। তখন আমরা এ ব্যবসা বন্ধ করে দিই।’
তিনি আরও বলেন, ‘তখন আমরা ই-ক্যাবকে জানিয়েছি, ই-কমার্সের বাইরে কিছু করব না আমরা। এর পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের সদস্যপদটি বহাল রাখে ই-ক্যাব।’