জিয়াউল হক রুদ্র : সারাদেশে একের পর এক কোচিং সেন্টার গজিয়ে উঠছে। স্কুল-কলেজে যেখানে নিয়মিত পড়াশোনা হওয়ার কথা, সেখানে শিক্ষকরা ক্লাসে গুরুত্ব না দিয়ে শিক্ষার্থীদের ঠেলে দিচ্ছেন কোচিং সেন্টারের দিকে। ফলে শ্রেণিকক্ষের শিক্ষা আজ প্রায় বিলীন। শিক্ষার্থীরা জ্ঞানার্জনের বদলে শর্ট কোর্স, সাজেশন আর নোটের ফাঁদে আটকে যাচ্ছে। অথচ শিক্ষা হওয়ার কথা ছিল সৃজনশীলতার চর্চা, নৈতিকতা ও মূল্যবোধ শেখার জায়গা। কিন্তু কোচিং-নির্ভর এই ব্যবস্থায় সবকিছু হারিয়ে গিয়ে শিক্ষা এখন কেবল ব্যবসায় পরিণত হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এক দশক আগেও কোচিং সেন্টারের সংখ্যা এত বেশি ছিল না। কিন্তু এখন রাজধানী ঢাকাসহ দেশের আনাচে-কানাচে অসংখ্য কোচিং সেন্টার ব্যাঙের ছাতার মতো ছড়িয়ে পড়েছে। শিক্ষা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে মাত্র এক হাজারের মতো নিবন্ধিত কোচিং থাকলেও শুধু ঢাকাতেই প্রায় ১০ হাজারেরও বেশি কোচিং চলছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, বাস্তবে এই সংখ্যা ১৫ থেকে ২০ হাজারেরও বেশি, যার ৯০ শতাংশেরও বেশি অনুমোদনহীন। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) ২০২৪ সালের এক জরিপ বলছে, দেশের মোট শিক্ষার্থীর অন্তত ৭৩ শতাংশ কোনো না কোনো কোচিং সেন্টারের ওপর নির্ভরশীল।
শিক্ষার নামে চলছে আসলে সাজেশন বাণিজ্য। অনেক কোচিং সেন্টার বিভিন্ন স্কুল-কলেজের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশ করে পরীক্ষার আগে প্রশ্নপত্র সংগ্রহ করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছড়িয়ে দিচ্ছে। ফলে শিক্ষার্থীরা ভালো নম্বর পেলেও তাদের জ্ঞানের পরিধি বাড়ছে না। ঢাকা কলেজের এক শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আজকাল শিক্ষার্থীরা বই পড়ে শিখতে চায় না, তারা শুধু সাজেশন আর শর্টকাটের পেছনে ছুটছে। কোচিং সেন্টারগুলো তাদের সেই পথ দেখাচ্ছে, যা ভবিষ্যতের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।’ এর প্রমাণ হিসেবে ২০২৫ সালের এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলে পাসের হার ও জিপিএ ফাইভের সংখ্যা কমে যাওয়াকে উদাহরণ হিসেবে টানা যায়।
অর্থ উপার্জনের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে কোচিংগুলো মডেল টেস্টের নামে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিচ্ছে। বছরে দুই থেকে তিনটি মডেল টেস্টের জন্য শিক্ষার্থীপ্রতি ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত নেয়া হচ্ছে। আবার অনেক কোচিং সেন্টার নিজেদের ‘অভিজ্ঞ শিক্ষক’ দাবি করলেও বাস্তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বা দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের দিয়ে ক্লাস করাচ্ছে। ফলে শিক্ষার মান প্রতিনিয়ত প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। এই বাণিজ্য নি¤œবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের ওপর বিশাল আর্থিক বোঝা তৈরি করেছে।
শুধু ঢাকাতেই একজন শিক্ষার্থীকে কোচিং সেন্টারে পড়ানোর জন্য অভিভাবকদের মাসে গড়ে প্রায় ৫ হাজার টাকা খরচ করতে হচ্ছে। এই অঙ্কটি অনেক নি¤œবিত্ত পরিবারের জন্য ভয়াবহ চাপ, কারণ তাদের মাসিক আয়ের প্রায় এক-চতুর্থাংশই চলে যাচ্ছে শুধু কোচিং ফি মেটাতে।
এসএসসি পরীক্ষার্থীর অভিভাবক সেলিম উদ্দিন অভিযোগ করে বলেন, ‘আমার ছেলের এসএসসি পরীক্ষার কোচিংয়ে প্রায় ৫০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। এটা এক ধরনের চাঁদাবাজি ছাড়া আর কিছু নয়।’
অন্যদিকে অষ্টম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর মা লায়লা বেগম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমার স্বামী একজন গার্মেন্টস শ্রমিক। মাসে ১৫ হাজার টাকার আয় দিয়ে সংসার চালানোই কষ্টকর। তার ভেতরে ছেলের কোচিং ফি দিতে গিয়ে আমাদের সংসার চালানোই দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবুও কোচিং না করালে ছেলে পরীক্ষায় পিছিয়ে পড়বে, এই ভয়ে আমরা বাধ্য হচ্ছি।’
রাজধানীর ফার্মগেট, মিরপুর, শনিরআখড়া ও মোহাম্মদপুর এলাকায় অনুমোদনহীন কোচিং ব্যবসা সবচেয়ে বেশি বিস্তৃত। এগুলোর মধ্যে রয়েছে- এইম কোচিং, মাস্টারমাইন্ড কোচিং, ই-হক কোচিং, বেস্ট কোচিং সেন্টার, আমাতুল টিচিং, পিটিএইচ কোচিং সেন্টার, নলেজ পয়েন্ট এবং স্টুডেন্টস একাডেমি কোচিং ইত্যাদি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ফার্মগেটের মাস্টারমাইন্ড কোচিংয়ের এক কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা এখন স্কুলে ঠিকমতো পড়াশোনা শিখতে পারে না। তাই তারা আমাদের কাছে আসে। আমরা যদি ফি না নেই, তাহলে মানসম্মত সেবা দেয়া সম্ভব নয়।’
শিক্ষাবিদরা বলেন, মানুষের পাঁচটি মৌলিক অধিকারের একটি হলো শিক্ষা। মধ্যবিত্ত ও নি¤œবিত্ত পরিবারের মা-বাবাদের কাছে এই মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার জন্য একটি বিকল্প পথ হয়ে উঠেছে কোচিং সেন্টার। কিন্তু এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে এখন দেশজুড়ে কোচিং বাণিজ্যের রমরমা ব্যবসা চলছে, যা শিক্ষার মানকে দিন দিন নি¤œমুখী করছে এবং হাজারও শিক্ষার্থীর মেধা ধ্বংস করছে।
মিরপুরের এইম কোচিংয়ের একজন পরিচালক ফখরুল ইসলাম শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আমরা শুধু সাজেশন দিই না, পরীক্ষার আগে সম্ভাব্য প্রশ্নও দিই। এতে শিক্ষার্থীরা বেশি নম্বর পায়। তাই অভিভাবকরাও খুশি।’
শনির আখড়ার নলেজ পয়েন্টের পরিচালক মোহাম্মদ আহাদ শেয়ার বিজকে কোচিংয়ের এক দায়িত্বশীল বলেন, ‘আমরা যদি পড়ানো বন্ধ করি, তাহলে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হবে। আমরা স্কুলের ফাঁক-ফোকর পূরণ করি।’
মোহাম্মদপুরের স্টুডেন্টস একাডেমি কোচিংয়ের এক শিক্ষক স্বর্ণা ইসলাম খোলাখুলি স্বীকার করেন, ‘শিক্ষা এখন ব্যবসা এটা অস্বীকার করলে হবে না। আমাদেরও ভাড়া, বেতন, খরচ আছে। তাই ফি বেশি নেয়া স্বাভাবিক।’ তাদের এসব বক্তব্য প্রমাণ করে, তারা শিক্ষাকে মৌলিক অধিকার হিসেবে নয় বরং সরাসরি ব্যবসা হিসেবেই দেখছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, শহরের ৬২ শতাংশ মাধ্যমিক শিক্ষার্থী দিনে অন্তত ছয় ঘণ্টা কোচিংয়ে কাটায়। এতে তাদের খেলার ও বিশ্রামের কোনো সুযোগ থাকছে না।
এ বিষয়ে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীর অভিভাবক হাসিনা খাতুন বলেন, ‘আমার মেয়ে সব সময় ক্লান্ত থাকে। ভোরে স্কুল, বিকালে কোচিং, একটু বিশ্রাম নিতেও পারে না। এ রকম চাপের মধ্যে থেকে ওর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’ সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী রাকিব হোসেন জানান, ‘আমাদের সকাল থেকে রাত পর্যন্ত শুধু পড়াশোনা করতে হয়। বন্ধুবান্ধব নিয়ে বাইরে যাওয়ার বা খেলাধুলা করার সময় পাই না। অনেক সময় মনে হয়, আমি যেন রোবটের মতো হয়ে যাচ্ছি।’
জানা গেছে, বর্তমানে স্কুলগুলোও কোচিং ব্যবসা থেকে পিছিয়ে নেই। বাংলাদেশের স্বনামধন্য কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম এই কোচিং ব্যবসার সঙ্গে ওঠে এসেছে। তাদের বিরুদ্ধে এমন? অভিযোগ পাওয়া যায় যে কোচিং না করলে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষায় কম নম্বর দেয়া এমনকি ফেল পর্যন্ত করাতে তারা? পিছপা হন না।
কিছুদিন আগে মাইলস্টোন ট্র্যাজেডির মাধ্যমে কোচিং বাণিজ্যের নির্মমতা প্রকাশ পেয়েছে। নিহত শিক্ষার্থী মারিয়াম উম্মে আফিয়ার মা তামিমা আক্তার বলেন, ‘আমার বাচ্চাটাকে দেড় মাস হলো কোচিংয়ে দিছি। বাসায় এসে বলে, আম্মু আমি যদি কোচিং না করি, মিসরা আমাকে আদর করে না।’ এদিকে অধিকাংশ কোচিং সেন্টার আবাসিক ভবনে চললেও কোথাও অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নেই, কোথাও জরুরি সিঁড়ি নেই। ২০১৯ সালে মিরপুরের এক কোচিং সেন্টারে অগ্নিকাণ্ডে কয়েকজন আহত হওয়ার পরও কার্যকর নিয়ন্ত্রণ হয়নি।
এছাড়া ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের একজন শিক্ষার্থী সাম্যনাথ বলেন, আমাদের কলেজের পক্ষ থেকে কোচিং করার জন্য চাপ দেয়া হয় এবং প্রতি মাসে এর জন্য দুই হাজার টাকার বেশি নেয়া হয়। যারা এই কোচিং করে, শুধু তাদেরকেই পরীক্ষার প্রশ্নের সাজেশন দেয়া হয়, যা অন্য শিক্ষার্থীদের দেয়া হয় না। ফলে ভালো নম্বরের আশায় অনেকেই কোচিং করতে বাধ্য হচ্ছে। এই বৈষম্যের অবসান চাই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, ‘শিগগিরই একটি জাতীয় নীতি প্রণয়ন করা হচ্ছে যেখানে নিবন্ধন ছাড়া কোনো কোচিং চালানো যাবে না এবং অতিরিক্ত ফি নেয়া বন্ধ হবে। শিক্ষা ব্যবসা নয়, এটি একটি মৌলিক অধিকার এটা সবার মনে রাখা দরকার।’
শিক্ষাবিদদের মতে, এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রথমেই স্কুল ও কলেজে পাঠদানের মান বাড়াতে হবে। প্রতিটি শিক্ষকের উপস্থিতি ও ক্লাসের মান যাচাই করতে হবে। পাশাপাশি কোচিং সেন্টারগুলোকে নিবন্ধনের আওতায় এনে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে হবে। অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদেরও সচেতন হতে হবে ভুয়া প্রতিশ্রুতির ফাঁদে না পড়ে।
বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্যমতে, দেশে কোচিং সেন্টার ব্যবসার বার্ষিক আকার প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ সরকারি বাজেটের একটি বড় অংশ ব্যয় হলেও সমান্তরাল একটি বিশাল বাণিজ্যিক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, যার প্রায় ৮০ শতাংশই নিয়ন্ত্রণহীন।
শিক্ষা শুধুমাত্র অর্থনৈতিক পণ্য নয়- এটি জাতীয় উন্নয়নের ভিত্তি। নিয়ন্ত্রণহীন কোচিং ব্যবসা বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে প্রতিদিন লাখো শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ নিয়ে খেলবে এই কালোবাজারি, যা এক সময় গোটা জাতির জন্যই বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
আরআর/