আল শাহারিয়া : শীত আসছে। ঘন কুয়াশার চাদরে মুড়ে আছে রাজধানী ঢাকা। কিন্তু এই ধোঁয়াশা কেবল প্রাকৃতিক কুয়াশা নয়, এর সাথে মিশে আছে ভাসমান সিসা, কার্বন আর অতি সূক্ষ্ম বস্তুকণা (পিএম ২.৫)-এর এক প্রাণঘাতী মিশ্রণ। এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স বা একিউআই (AQI) মিটারের কাঁটা প্রায় প্রতিদিনই লাল থেকে বেগুনি, অর্থাৎ অস্বাস্থ্যকর থেকে বিপজ্জনক স্তরে ওঠানামা করছে। এই চিত্র এখন আর নতুন নয়। বিশ্বের দূষিততম শহরের তালিকায় রাজধানী এই শীর্ষস্থান দখল এখন এক বার্ষিক রুটিন।
এই বিষাক্ত বাতাস নিয়ে আলোচনা কম হয় না। তবে সেই আলোচনার পুরোটাই এক অদ্ভুত ব্লেম গেম বা দোষারোপের খেলায় পর্যবসিত হয়েছে। চায়ের দোকানে, অফিস কক্ষে কিংবা সামাজিক মাধ্যমে আমরা অনবরত আঙুল তুলে যাচ্ছি। সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমরা এই ভয়াবহ পরিস্থিতির জন্য সরকারকে দায়ী করছি, দায়ী করছি পরিবেশ অধিদপ্তর বা সিটি করপোরেশনের মতো সেবা সংস্থাগুলোর চূড়ান্ত ব্যর্থতাকে।
অন্যদিকে সরকার বা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো হয়তো দায়ী করছে শিল্প মালিকদের, বিশেষ করে শহরের চারপাশে গজিয়ে ওঠা হাজার হাজার অবৈধ ইটের ভাটাকে। আবার শিল্প মালিকরা হয়তো অজুহাত দিচ্ছেন আইনের শাসনের অভাব বা দুর্বল অবকাঠামোর। এই চক্রাকার দোষারোপের খেলায় আমরা সবাই ব্যস্ত। কিন্তু এই যে বিষাক্ত বাতাসের এক ককটেল আমরা প্রতিদিন সেবন করছি, সেই ককটেল তৈরিতে আমাদের নিজেদের, অর্থাৎ সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমাদের ভূমিকা ঠিক কতটুকু? সময় এসেছে সেই নির্মোহ আত্মসমালোচনার।
এই ভয়াবহ দূষণের পেছনের মূল কারণ প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতা। একে অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। পরিবেশ অধিদপ্তরের যে ধরনের কঠোর নজরদারি এবং আইন প্রয়োগের ক্ষমতা থাকা প্রয়োজন ছিল, বাস্তবে তার ২৫ শতাংশও দৃশ্যমান নয়। যে শিল্প-কারখানা দিনরাত কালো ধোঁয়া উদগীরণ করে বাতাসকে বিষাক্ত করছে, তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির উদাহরণ বিরল।
একইভাবে, দুই সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ত্রুটি এই সংকটকে তীব্রতর করেছে। উন্মুক্ত ডাম্পিং, সময়মতো বর্জ্য অপসারণ না করা এবং সবচেয়ে ভয়াবহ বর্জ্য পোড়ানো, এই সবই দূষণের মাত্রাকে বাড়িয়ে তুলছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে নিয়ন্ত্রণহীন নির্মাণযজ্ঞ। বড় বড় সরকারি-বেসরকারি প্রকল্প থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত বাড়ি নির্মাণ কোথাও নির্মাণবিধি মানার নজির নেই। ধুলা নিয়ন্ত্রণের জন্য পানি ছিটানো বা নির্মাণসামগ্রী ঢেকে রাখার মতো সামান্য নিয়মও এখানে উপেক্ষিত। এটি হলো সমস্যার সেই দিক, যা আমরা সবাই দেখি এবং যা নিয়ে আমরা সরব। কিন্তু মুদ্রার অপর পিঠটি আরও বেশি উদ্বেগজনক।
আত্মমূল্যায়ন করলে দেখা যাবে বায়ুদূষণল আরেক কারণ নাগরিক উদাসীনতা, যা প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতার চেয়ে কম দায়ী নয়। বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ব্যক্তিগত পর্যায়ে ভূমিকার কী। সিটি করপোরেশন বা পৌরসভার অব্যবস্থাপনা নিয়ে আমরা সোচ্চার। কিন্তু আমরা নিজেরা কী করছি? সামান্য অলসতা বা চূড়ান্ত অসচেতনতার কারণে আমরা অনেকেই নিজেদের বাড়ির আশপাশে, রাস্তার মোড়ে বা খোলা জায়গায় অবলীলায় প্লাস্টিক, পলিথিনসহ গৃহস্থালির যাবতীয় বর্জ্য ফেলে দিই এবং সুযোগ পেলে তাতে আগুন ধরিয়ে দিই। এই পোড়ানো আবর্জনা থেকে যে ডায়োক্সিন এবং ফিউরানের মতো মারাত্মক বিষাক্ত রাসায়নিক বাতাসে মেশে, তা সরাসরি ক্যানসারের কারণ হতে পারে। যে বাতাসকে আমরা দূষিত বলে গালি দিচ্ছি, সেই বাতাসে বিষ মেশানোর এই প্রক্রিয়ায় আমরা নিজেরাই একেকজন সক্রিয় কর্মী।
দ্বিতীয়ত, আমাদের ব্যক্তিগত গাড়ির প্রতি আসক্তি। রাজধানীর যানজট এবং বায়ু দূষণের একটি বড় অংশই আসে জীবাশ্ম জ্বালানিচালিত যানবাহন থেকে। আমরা নিত্যই দেখি, অপ্রয়োজনে ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে রাস্তায় নামলে তা যানজট এবং দূষণ দুটোই বাড়াবে। তবুও সামান্য দূরত্বে যেতে কিংবা নিছক সামাজিক মর্যাদা বা বিলাসিতা প্রদর্শনের জন্যও আমরা ব্যক্তিগত গাড়ির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি। একটি কার্যকর গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে না ওঠা অবশ্যই সরকারের ব্যর্থতা, কিন্তু সেই অজুহাতে ব্যক্তিগত বিলাসিতা কি পরিবেশের প্রতি আমাদের চূড়ান্ত দায়িত্বহীনতার পরিচায়ক নয়?
তৃতীয়ত, নির্মাণকাজে নাগরিক নিজস্ব উদাসীনতা। আমরা যখন অন্যের নির্মাণকাজের ধুলায় অতিষ্ঠ হয়ে কর্তৃপক্ষকে দোষারোপ করি, তখন আমরা কি ভেবে দেখেছি, নিজের বাড়ি বা ফ্ল্যাটটি নির্মাণের সময় আমরা কতটা আইন মেনেছি? নিজের বাড়ি তৈরির সময়ও ইট, বালু, সিমেন্ট খোলা ফেলে রাখা, পানি না ছিটানো বা ধুলা নিয়ন্ত্রণের ন্যূনতম ব্যবস্থা না নেওয়ার যে প্রবণতা, তা আমাদের দ্বৈত মানসিকতারই বহিঃপ্রকাশ। আমরা অন্যের কাছে যা আশা করি, নিজেরা তা পালন করতে বিন্দুমাত্র রাজি নই।
সবচেয়ে ভয়াবহ হলো আমাদের সম্মিলিত সামাজিক উদাসীনতা। আমাদের চোখের সামনেই হয়তো কোনো কারখানা কালো ধোঁয়া ছাড়ছে, কোনো ফিটনেসবিহীন বাস রাজপথ কাঁপিয়ে বিষাক্ত ধোঁয়া ছড়াচ্ছে, কিংবা কোনো আবাসন প্রকল্প জলাভূমি ভরাট করে পরিবেশ ধ্বংস করছে। আমরা ক’জন এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করি? আমরা ক’জন দায়িত্ব নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানাই? আমাদের এই ‘আমার কী আসে যায়’ বা ‘এসব করে কী লাভ হবে’ মনোভাবই দূষণকারীদের মূল শক্তি। আমরা প্রতিবাদ করি না, কারণ আমরা ধরে নিয়েছি কিছুই বদলাবে না।
এই প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতা এবং নাগরিক উদাসীনতা একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এটি একটি ভয়াবহ দুষ্টচক্র তৈরি করেছে। যখন একজন নাগরিক দেখেন যে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোই দুর্নীতিগ্রস্ত বা নিষ্ক্রিয়, তখন তিনিও আইন ভাঙতে উৎসাহিত হন। তিনি ভাবেন, ‘ওরা কিছুই করে না, আমি একাই বা নিয়ম মেনে কী করব?’ তার এই মনোভাব প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতাকে আরও বাড়িয়ে তোলে।
অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানগুলো যখন দেখে যে, জনগণই পরিবেশ নিয়ে সচেতন নয়, তারা নিজেরাই যত্রতত্র বর্জ্য ফেলছে, প্লাস্টিক পোড়াচ্ছে, তখন তারাও নিষ্ক্রিয় থাকার অজুহাত পেয়ে যায়। তারা ভাবে, “জনগণই তো সচেতন না, আমরা আর কী করব?” এভাবেই, প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতা নাগরিক উদাসীনতাকে উসকে দেয় এবং নাগরিক উদাসীনতা প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও অকার্যকর ও জবাবদিহিহীন করে তোলে। এই যৌথ ব্যর্থতার চক্রেই আজ রাজধানীর বাতাস আটকা পড়েছে।
বাস্তবতা হলো, রাজধানীর এই বিষবায়ু আমাদের সম্মিলিত পাপের ফসল। এই দায় এককভাবে সরকার, কোনো সংস্থা বা শিল্প মালিকদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে আমাদের আত্মপক্ষ সমর্থনের আর কোনো সুযোগ নেই। আমরা একযোগে এই বাতাসকে বিষিয়ে তুলেছি-সরকার তার নিষ্ক্রিয়তা দিয়ে, আর আমরা নাগরিকরা আমাদের দায়িত্বহীনতা দিয়ে।
কেবল একটি দামি মাস্ক পরে হয়তো আমরা সাময়িকভাবে নিজেদের ফুসফুসকে কিছুটা সুরক্ষা দিতে পারি, কিন্তু এটি কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। যদি আমরা সত্যিই একটি নির্মল বাতাসের শহরে নিঃশ্বাস নিতে চাই, তবে এই দোষারোপের খেলা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
সমাধানের শুরুটা হতে হবে ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে। প্রত্যেক নাগরিককে নিজের দায়িত্বটুকু পালন করতে হবে তা আবর্জনা নির্দিষ্ট স্থানে ফেলা হোক, অপ্রয়োজনে গাড়ি ব্যবহার না করা হোক, বা নিজের নির্মাণকাজে আইন মানা হোক। একইসঙ্গে, ব্যক্তিগত দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি আমাদের সম্মিলিতভাবে সোচ্চার হতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতার বিরুদ্ধে, আইনের প্রয়োগহীনতার বিরুদ্ধে আমাদের কথা বলতে হবে। প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের দায়িত্ব পালনে জবাবদিহি করতে বাধ্য করতে হবে।
রাজধানীর বাতাসকে পরিচ্ছন্ন করার এই লড়াই কোনো একক পক্ষের নয়। এটি একটি সমন্বিত সামাজিক আন্দোলনের বিষয়। যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা আমাদের নাগরিক দায়িত্ববোধ এবং প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহির চর্চা করতে না পারছি, ততক্ষণ এই বিষাক্ত পরিবেশ থেকে আমাদের মুক্তি নেই।
শিক্ষার্থী, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়
প্রিন্ট করুন







Discussion about this post