ইমদাদ ইসলাম : দ্রুত নগরায়ণের কারণে ঢাকা শহরের আয়তন যে হারে বাড়ছে জনসংখ্যা তারচেয়েও অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে বেড়ে চলছে। এ শহরে মানুষেরে আগমন কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। প্রতিদিন গড়ে এ শহরের জনসংখ্যার সঙ্গে কম-বেশি পনের হাজার মানুষ নতুন করে যুক্ত হচ্ছে। এদের মধ্যে নানা পেশার মানুষ রয়েছে। জলবায়ু উদ্বাস্তু ও ছিন্নমূল মানুষ যেমন আসছে তেমনি কর্মসংস্থানের জন্য শিক্ষিত-অশিক্ষিত মানুষও আসছে। ঢাকা শহরের জনসংখ্যা দুই কোটির বেশি। প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করে চার লাখেরও বেশি মানুষ। এ শহরের নাগরিক সুবিধা ও জনঘনত্বের ভারসাম্য রক্ষা করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ছে। ঢাকার অবাসযোগ্যতা ও অস্থায়িত্বশীল উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সারা দেশের জন্যই বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই শহরে কম-বেশি এক তৃতীয়াংশ মানুষ বস্তিতে বসবাস করে। তাদের স্বাস্থ্য, স্যানিটেশন ব্যবস্থা খুবই খারাপ ।
কোনো শহরের জনসংখ্যা ১০ মিলিয়ন ক্রস করলেই সেটা মেগাসিটিতে পরিণত হয়। সেই হিসাবে ঢাকা অনেক আগেই মেগাসিটিতে পরিণত হয়েছে। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নাগরিকদের প্রায় সব সেবা দিতেই হিমশিম খাচ্ছে। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে আছে নানারকম চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। এমনিতেই সারা পৃথিবীতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি বিষয়, বিশেষ করে ঢাকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ শহরগুলোর জন্য তা আরও বেশি চ্যালেঞ্জের। আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় প্রতিনিয়ত ব্যবহূত প্রতিটি বস্তু থেকেই কিছু অপ্রয়োজনীয় উচ্ছিষ্ট অংশের উদ্ভব হয় যা ব্যবহারের অনুপযোগী, মূল্যহীন ও ত্রুটিপূর্ণ। এগুলোকে আমরা বর্জ্য পদার্থ কিংবা ময়লা নামেই আখ্যায়িত করে থাকি। বর্জ্য বিভিন্ন রকমের হতে পারে, যেমন- গৃহস্থালি বর্জ্য, বাণিজ্যিক বর্জ্য এবং শিল্পবর্জ্য। বর্জ্য পদার্থ সাধারণত মানবস্বাস্থ্য, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। রাজধানীর উচ্চবিত্ত পরিবারে সদস্যপ্রতি গড়ে দৈনিক কঠিন বর্জ্য উৎপাদনের পরিমাণ কম-বেশি ৪৯৬ গ্রাম। মধ্যবিত্ত পরিবারে তা ৪৮৩ গ্রাম এবং নিম্নবিত্ত পরিবারে ১৯৩ গ্রাম। এই বর্জ্যের একটা বড়ো অংশ খাদ্যবর্জ্য। বর্তমানে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় দৈনিক সাড়ে ৭ হাজার টনের বেশি কঠিন বর্জ্য উৎপন্ন হচ্ছে। এই বাইরে আরেকটি শিল্পবর্জ্য, বিভিন্ন কারখানা ও উৎপাদনশীল কার্যক্রম থেকে আসে।
গত তিন দশকে বর্জ্য উৎপাদন দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে আমাদের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে যে পরিমাণ সচেতন এবং কর্ম পরিকল্পনা করে বাস্থবায়ন করা দরকার ছিল, আমরা তার কাছাকাছিও পৌঁছতে পারিনি। এর প্রধান কারণ হলো, বিশেষত ঢাকায় প্রতিদিন যে বিপুল পরিমাণ বর্জ্য পদার্থ তৈরি হচ্ছে, সেগুলো যথাযথভাবে সংগ্রহ করা সম্ভব হচ্ছে না। নাগরিক সচেতনতার অভাব খুবই প্রকট। যত্রতত্র উন্মুক্তভাবে ময়লা ফেলা হচ্ছে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ। জনসচেতনতার অভাবে পলিথিন এবং প্লাস্টিকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না বরং প্রতিনিয়ত এর ব্যবহার বাড়ছে, যা পরিবেশের জন্য আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। রাজধানী ঢাকার বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সাধারণত দক্ষিণ ও উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মাধ্যমে পরিচালিত হয়। ডিএনসিসির অধীনে পরিচালিত ল্যান্ডফিল হলো আমিনবাজারে এবং দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) অধীনে পরিচালিত ল্যান্ডফিল হলো মাতুয়াইলে। এ দুই ল্যান্ডফিলের আয়তন প্রায় সমান, ১০০ একরের কাছাকাছি। ল্যান্ডফিলে আসার আগে বর্জ্য পদার্থগুলো প্রথমে বেসরকারি উদ্ধগে বাড়ি থেকে ছোটো ভ্যানে করে সংগ্রহ করা হয়। পরবর্তী সময়ে সেগুলো সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশনে এনে বিক্রয়মূল্য আছে এমন বর্জ্যগুলোকে আলাদা করা হয়। সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন (এসটিএস) বর্জ্য সংগৃহীত এলাকার আশপাশে প্রতিটি এলাকাতেই রয়েছে। স্থায়ী এই অবকাঠামো আকারে যথেষ্ট বড়ো। এর ভেতরে একাধিক কনটেইনার ডাস্টবিন রাখা যায়। তাই এলাকার রাস্তাঘাটে সেভাবে আর রাখতে হচ্ছে না কনটেইনার ডাস্টবিন। এভাবে বাসার আবর্জনা রাস্তায় পড়ে থাকার বিষয়টি কমে আসছে। এরপর সিটি করপোরেশনের ডাম্পিং গাড়ি বর্জ্যগুলো ল্যান্ডফিলে রেখে আসে। বর্জ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রেও আরও সমস্যা রয়েছে। আমাদের দেশে সব ধরনের বর্জ্য একত্রে সংগ্রহ করা হয়। অথচ উন্নত দেশগুলোয় প্লাস্টিক, ধাতু, খাদ্য ইত্যাদি আলাদা সংগ্রহ করা হয় ।
একটা ঘনবসতিপূর্ণ দেশে মানুষ জীবীকার জন্য শহরমুখী হচ্ছে। জীবিকা যেহেতু প্রধান উদ্দেশ্য তাই তারা রাজধানীমুখী হচ্ছে। কারণে এখানে অন্য জায়গা থেকে জীবীকারে সুযোগ বেশি। দুই কোটিরও বেশি মানুষ এখন ঢাকায় বসবাস করছে এবং প্রতিদিনই বসবাসের জন্য মানুষ আসছে। তাদের নাগরিক সেবা নিশ্চিত করার মতো অবকাঠামো এত দ্রুত তৈরি করা সম্ভব হয় না। ফলে কাঙ্ক্ষিত অনেক নাগরিক সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে মানুষ। উন্নত দেশের মতো আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আমাদের দেশে এখনও গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। এক্ষেত্রে নাগরিক সচেতনতারও অভাব রয়েছে। যত্রতত্র ময়লা ফেলা আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। বর্জ্য উৎপাদন দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়ায় এর ব্যবস্থাপনাও দিন দিন কঠিন করে তুলছে। আরেকটি বড়ো সমস্যা হলো, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সংশ্লিষ্টরা কোনো ধরনের সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা ছাড়াই বর্জ্য সংগ্রহ ও বাছাইকরণের কাজ করছে। তারা প্রতিদিন উন্মুক্ত পরিবেশে কাজ করে যা তাদের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। ঢাকা মহানগরীতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার প্রধান সমস্যাগুলো হলো দ্রুত বর্জ্য উৎপাদন বৃদ্ধি, পর্যাপ্ত অবকাঠামোর অভাব, বর্জ্য সংগ্রহ, বাছাইকরণ, পরিবহন এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব সম্পর্কে নাগরিক সচেতনতার অভাব। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য সিটি করপোরেশনের প্রশিক্ষিত জনবলের সংকট সব সময়ই রয়েছে। বর্জ্য থেকে সম্পদ আহরণের জন্য পুনর্ব্যবহার এবং রিসাইক্লিং কার্যক্রম এখনও সীমিত। বর্জ্য ফেলার স্থান এবং ব্যবস্থাপনার অভাবে পরিবেশ দূষণ হচ্ছে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। এছাড়াও চাঁদাবাজদের কারণেও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজে সমস্যা হচ্ছে। ঢাকা শহরের বিপুল পরিমাণ মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করাও একটি বড়ো সমস্যা।
বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে করা না হলে বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর পদার্থ যেমন মিথেন গ্যাস, কার্বন এবং ভারি ধাতু পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে। বর্জ্য থেকে নির্গত বিভিন্ন ক্ষতিকর ধাতু যেমন সিসা (লেড), পারদ (মার্কারি), ডায়োক্সিন এবং বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর উপাদান বর্জ্য থেকে বের হয়ে পানিতে এবং মাটিতে ছড়িয়ে পড়ে যা মানব স্বাস্থ্যসহ জীববৈচিত্র্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। ফলে জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায় এবং এর সঙ্গে চিকিৎসা ও প্রতিদিনের খরচও বেড়ে যায়। এজন্য বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সঠিক পদ্ধতি গ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উন্নত বিশ্বে স্যানিটারি ল্যান্ডফিলের মাধ্যমে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করা হয়। ইঞ্জিনিয়ার্ড পদ্ধতির মাধ্যমে পরিচালিত ল্যান্ডফিলকে স্যানিটারি ল্যান্ডফিল বলা হয়। এর অন্যতম উদ্দেশ্য হলো, বর্জ্য পদার্থ থেকে ক্ষতিকর পদার্থ যেন পরিবেশে ছড়াতে না পারে। স্যানিটারি ল্যান্ডফিল সাধারণত নদী বা উন্মুক্ত জলাশয় থেকে কমপক্ষে ১৬০ মিটার দূরে এবং ভূগর্ভস্থ পানির কূপ থেকে কমপক্ষে ৩০ মিটার দূরে স্থাপন করা হয়, যাতে বর্জ্য থেকে নির্গত ক্ষতিকর পদার্থ জলাধার বা পানির উৎসকে দূষিত করতে না পারে। স্যানিটারি ল্যান্ডফিলে অভেদ্য স্তর নির্মাণ করা হয়। অভেদ্য স্তরটি বর্জ্যের সংস্পর্শ থেকে মাটি ও ভূগর্ভস্থ পানিকে রক্ষা করে, যাতে কোনো ক্ষতিকর পদার্থ পরিবেশে মিশে না যায়। অভেদ্য স্তরের ওপর লিচেট কালেক্টর স্থাপন করা হয়, যা লিচেট সংগ্রহ করে ট্রিটমেন্ট প্লান্টে সরবরাহ করে পরিশোধনের মাধ্যমে দূষণ রোধ করে। এছাড়া গ্যাস কালেক্টর সিস্টেম ব্যবহার করা হয়, যা ল্যান্ডফিলে উৎপন্ন গ্যাসগুলো সংগ্রহ করে, যেন এ গ্যাসগুলো পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে পরিবেশ দূষণ না করতে পারে। সঠিক প্রক্রিয়ায় ময়লার স্তূপগুলো কভার দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়, যাতে ক্ষতিকর গ্যাস ও দুর্গন্ধ ছড়ানোর সুযোগ না থাকে এবং পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি কমানো যায়।
বর্জ্যকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পরিকল্পিতভাবে এর ব্যবস্থাপনা করতে হবে। সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আপাতদৃষ্টিতে অনেক ব্যয়বহুল মনে হলেও দীর্ঘমেয়াদে এটি দেশের জন্য লাভজনক। সঠিকভাবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করা হলে প্রথমত, মানুষের স্বাস্থ্যসংক্রান্ত ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাবে। পরিবেশ দূষণ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে যাবে। এ শহরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি পাবে এবং আরও বাসযোগ্য হয়ে উঠবে। পাশাপাশি জনসাধারণের জীবনমানও উন্নত হবে। এজন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন নাগরিক সচেতনতা এবং জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণ।
পিআইডি নিবন্ধ