আয়েশা চিশতী ফুল : রেমিট্যান্স বা প্রবাসীদের আয় এর মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে কঠোর সংগ্রাম। প্রবাসীদের জীবন সংকট, আশা-নিরাশা, সফলতা-ব্যর্থতা, আবেগ-উচ্ছ্বাস এর একটি ফল রেমিট্যান্স; যা দেশের জাতীয় আয় কে করেছে সচল ও সাবলীল।”রেমিট্যান্স যোদ্ধা মোহাম্মদ মুসার এই সম্পাদিত বইটিতে প্রবাসীদের সংগ্রামী জীবনের একটি প্রতিফলন ঘটেছে। দেশীয় জীবনকে সহজ করতে প্রবাসীদের প্রত্যেকটি সংগ্রাম যেন এটি একটি ইতিহাস। দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধি রাখার জন্য প্রবাসীদের এই পরিশ্রমকে দিতে হবে এর যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা। বাংলাদেশের অর্থনীতির এক বড় অংশে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় বড় ভূমিকা পালন করে আসছে। দেশের জাতীয় আয়ের প্রায় ৫ শতাংশ আসে রেমিট্যান্স থেকে; যা দেশের বৈদেশিক মুদ্রার অন্যতম প্রধান উৎস এবং অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি। হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রবাসী বাংলাদেশীরা দেশে প্রেরণ করেছে ২৩.৯১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সূত্র বাংলাদেশ ব্যাংক। ঠিক সেই সময়ের সর্বমোট জিডিপি ছিল আনুমানিক ৪৬৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সে অনুযায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জাতীয় আয় রেমিট্যান্সের অবদান দাঁড়ায় ৫.১% প্রায়। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে জিডিপি বৃদ্ধি পেলেও রেমিট্যান্সের হার কিছুটা কমেছে শতাংশ হিসেবে, কিন্তু তা বেড়েছে পরিমাণ। উদাহরণ হিসেবে ধরা যায় গত ২০০৯-১০ অর্থবছরের রেমিট্যান্স যার অবদান ছিল জাতীয় আয়ের ১০.১১ শতাংশ। প্রায় সেই বছর বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের ১০ শতাংশ রেমিট্যান্স থেকে এসেছে। ২০২৪ অর্থবছরে রেমিট্যান্স দেশের মোট জিডিপির ৫.২১ পারসেন্ট অবদান রেখেছে, যা দেশের মোট রপ্তানি আয়ের অর্ধেকের বেশি।
জাতীয় অর্থনীতি ও বৈদেশিক অর্থনীতিতেও রেমিট্যান্সের অবদান অনস্বীকার্য। রেমিট্যান্সে প্রবাহ বৈদেশিক মুদ্রার সংকট মোকাবিলায় এক গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। মুদ্রার বিনিময় হার স্থির রাখা হবে এই অঙ্কুরের। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৫ বিলিয়ন ইউএসডি রেমিট্যান্স রিজার্ভ সমৃদ্ধ হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন, জিডিপি বৃদ্ধিতে অংশ, মুদ্রা ও রিজার্ভ স্থিতিশীলতা, দারিদ্র্য বিমোচনে, জীবনমান উন্নয়ন, শিক্ষাবর্ষ ও স্বাস্থ্য খরচ বৃদ্ধি, নারী ক্ষমতায়ন, গৃহ বিনিয়োগ, গ্রামীণ উদ্যোক্তা সৃষ্টি, স্থায়ী কর্মসংস্থানের উন্নয়নের তীব্র ভূমিকা পালন করে আসছে প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রেরণ করা বৈদেশিক আয় বা রেমিট্যান্স থেকে। তবে উৎপাদনশীল খাতে রেমিট্যান্স বা প্রবাসীদের আয় সংকল্প পরিমাণে বিনিয়োগ করা হয় না।
রেমিট্যান্স অর্থনীতির দেহে রক্ত সঞ্চারের মতো। উন্নয়নের চাকা সচল রাখে। কিন্তু এক গবেষণায় ও প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশের প্রায় ৩৫-৭৫ শতাংশ রেমিট্যান্স এখনও হুন্ডির মাধ্যমে অবৈধ বা অনিয়ন্ত্রিত রুটে প্রবাহিত হয়। হুন্ডি হলো একটি অবৈধ উপায়ে টাকা আদান-প্রদানের পদ্ধতি, যা কোনো নিয়মভিত্তিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার বাইরে পরিচালিত হয়। এটি প্রথাগতভাবে একটি ‘বিশ্বাসভিত্তিক’ চুক্তি যেখানে প্রেরক এবং প্রাপক উভয়েই দালালের মাধ্যমে অর্থ লেনদেন করে থাকেন। হুন্ডির মাধ্যমে টাকা এলে রেমিট্যান্স হিসেবে তা রেজিস্ট্রার হয় না। ফলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যায়। বৈধ চ্যানেলে অর্থ প্রবাহ কমে গেলে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বিঘ্নিত হয়। যেহেতু কোনো প্রকার লিখিত চুক্তি থাকে না, সেহেতু প্রেরিত অর্থ চুরি বা আত্মসাৎ হওয়ার অনেকটুকুই সম্ভাবনা থাকে। দালাল নিখোঁজ হলে অর্থ ফেরত পাওয়ার কোনো উপায় থাকে না। হুন্ডি অবৈধ হওয়ায় এটি মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসী অর্থায়নের আওতায় পড়ে। দালাল বা প্রেরক ধরা পড়লে কারাদণ্ড ও জরিমানার মুখোমুখি হতে পারে। জানা যায়, কম দক্ষ সম্পূর্ণ কাজ করা মাইগ্রেন্টদের আয়ের ওপরে ১ শতাংশ বৈধ ও অবৈধ রেট ব্যবধান আনুমানিক ৩.৬ শতাংশ রেমিট্যান্স চলে যায় হুন্ডিতে; যার কারণে অর্থনীতির এক বিরাট অংশ ক্ষতির মুখোমুখি হয়।
বাড়ছে শহুরে জনসংখ্যা, যানজট, ট্রাফিক, জলাবদ্ধতা ও দূষণ। স্মার্ট সিটি পদক্ষেপ—যেমন উন্নত যান ব্যবস্থাপনা, সঠিক পানি প্রবাহের ব্যবস্থা, ড্রেনেজ সিস্টেম ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, স্মার্ট গ্রিড ও দৃঢ় নীতি কাঠামো প্রয়োগের মাধ্যমে জীবনমানের উন্নত করবে এবং শহর পরিচালনা সহজতর হবে। কৃষিক্ষেত্রে টেকসই প্রযুক্তি প্রয়োগ এর কিছু ও সমাধান রয়েছে। কনসার্ভেশন অ্যাগ্রিকালচার হলো এমন একটি প্রাকৃতিকভাবে টেকসই কৃষি পদ্ধতি; যা ফসল বৈচিত্র্যতা, ন্যূনতম মাটির বিঘ্ন ও স্থায়ী মাটির ঢাকনের ক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষা করে। এছাড়া উপকূলীয় ও সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য, মৎস্য সম্পদ বজায় রাখা, বন পুনরুদ্ধার ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও ক্ষুদ্র উদ্যোগে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি গ্রহণে সহায়তা করে টেকসই উন্নয়ন। বাংলাদেশে SHAFAL প্রোগ্রাম চালু হয়েছে, যা ইউনিসিডিএফ ও সুইস দূতাবাসের সহায়তায় প্রবাসী ও তাদের পরিবারদের মধ্যে ডিজিটাল আর্থিক সাক্ষরতা ও উদ্যোগশীলতা বৃদ্ধি করায়। এতে করে রেমিট্যান্স দীর্ঘমেয়াদি আয়ের উৎসেরূপে পরিণত হতে পারে। দুর্যোগ, গৃহনির্মাণ বা সম্প্রদায় ভিত্তিক দান-দানিকা মন্থনে রেমিট্যান্স কাজ করে।
গবেষণায় দেখা গেছে, অদক্ষ শ্রমিকরা রেমিট্যান্সের প্রবাহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তবে দীর্ঘমেয়াদি সময় ধরে, অতিরিক্ত রেমিট্যান্সের ওপরে নির্ভরতা আর্থিক খাতগুলোয় ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দেন, রেমিট্যান্সের অর্থ কি অর্থনৈতিক খাতকে আরও শক্তিশালী করতে পারবে যদি তা উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ করা হয়। রেমিট্যান্সের অর্থ বাংলাদেশ অর্থনীতিকে করেছে যেমন সচল, তেমনি অতিরিক্ত দীর্ঘমেয়াদির ওপর নির্ভরশীলতা ও দিকে আনতে পারে ঝুঁকি। অতএব, রেমিট্যান্স অর্থ কি উৎপাদনশীল খাতে ব্যবহার করতে পারলে তা আরও অর্থনীতিকে টেকসই করতে পারে।
রেমিট্যান্স এবং টেকসই উন্নয়ন জাতীয় অর্থনীতিকে যেমন করেছে সচল তেমনি করেছে সমৃদ্ধি। রেমিট্যান্সের মাত্রা অতিরিক্ত ব্যবহার কোন কোন খাতে অধিক হচ্ছে এবং কোন কোন খাতে হচ্ছে না তার দিকে সরকারে সঠিক দৃষ্টি প্রতিস্থাপন করা। টেকসই উন্নয়ন মানব উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জন করে, সেই সঙ্গে প্রাকৃতিক ব্যবস্থার সক্ষমতাকে প্রভাবিত করে। যথাযথ ব্যবহার এবং এর খাতগুলোকে উন্নতির দিকে ধাবিত করতে হবে। একটি দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে পারে সেই দেশের সঠিক অর্থ ব্যবস্থা।
শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

Discussion about this post