আরিফুর রহমান : ফিলিস্তিনের গাজায় গণহত্যা নিয়ে আমরা সোচ্চার। মানুষ হিসেবে এটি আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। ফিলিস্তিনিদের জন্য কিছু করতে না পারলেও সারাবিশ্বের বিবেকসম্পন্ন মানুষ তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল। বাংলাদেশের গা-ঘেঁষে রয়েছে এক ফিলিস্তিন, আরাকান। আরাকানের রোহিঙ্গারা দীর্ঘদিন ধরে নির্যাতিত। কিন্তু তারা ফিলিস্তিনিদের মতো সারাবিশ্বের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারেনি। তাদের মতো নেতৃত্ব আর প্রতিরোধও গড়ে তুলতে পারেনি। তারা দীর্ঘকাল ধরে গণহত্যা ও বাস্তুচ্যুতির শিকার। তারা নির্যাতিত হচ্ছে অহিংসার ধর্ম বৌদ্ধ অনুসারীদের দ্বারা। বিভিন্ন সময় বৌদ্ধ ভিক্ষুরা রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সহিংসতায় উসকানি ও নেতৃত্ব দিয়েছেন। বৌদ্ধ ভিক্ষু আশিন উইরাথু যাকে Time magazine উল্লেখ করেছে The face of Buddhist Terror হিসেবে তাকে মিয়ানমারের জান্তা সরকার তাদের স্বাধীনতা দিবসে রাষ্ট্রীয় পুরস্কারে ভূষিত করেছিল। প্রায় প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই গৃহযুদ্ধে আক্রান্ত বার্মার (পরবর্তী সময়ে নাম বদলে মিয়ানমার) কেন্দ্রীয় সরকার ও আরাকানের স্থানীয় রাখাইন জনগোষ্ঠীর মধ্যে কোনো কিছুতেই মতৈক্য নেই কেবল রোহিঙ্গাদের নির্যাতন করা ছাড়া। তারা উভয়েই রোহিঙ্গাদের অভিবাসী বাঙালি মনে করে এবং আরাকান থেকে রোহিঙ্গাদের বিতাড়নের ব্যাপারে একমত। অথচ পর্তুগিজ জলদস্যুদের সঙ্গে মিলে দক্ষিণ ও মধ্য বাংলায় ব্যাপক লুটপাট চালানোর ঘৃণ্য ইতিহাস থাকা সত্ত্বেও রাখাইনরা (মগ) বাংলাদেশে নিরাপদে ও নিশ্চিন্তে আছে। অন্যান্য জনগোষ্ঠীর মতো তারাও রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে। তাদের ঘৃণ্য ইতিহাসের দায় তাদের বর্তমান প্রজন্মের ওপর চাপানোর কোনো জনমতও বাংলাদেশে গড়ে উঠেনি। এমনটি না হোক এটিই আমাদের চাওয়া। রোহিঙ্গাদের বেলায় এমন কোনো ঐতিহাসিক দায় নেই বরং রোহিঙ্গা জাতির উৎপত্তির সঙ্গে জড়িয়ে আছে আরাকানের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের ইতিহাস। অথচ তারা নির্যাতিত হচ্ছে নৃতাত্ত্বিক, ভাষাগত ও ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্যের কারণে।
আরাকানের রাজা নরমেখলা বর্মীদের কাছে রাজ্য হারিয়ে বাংলার সুলতানের আশ্রয়ে থাকেন এবং বাংলার সুলতানের সহায়তায় রাজ্য উদ্ধার করেন। তখন রাজার সৈনিক হিসেবে যাওয়া বাঙালিরা রাজার ইচ্ছানুসারেই সেখানে থেকে যান। পরবর্তী সময়ে আরাকানের রাজারা বিভিন্ন সময় কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম অঞ্চল দখল করেন। একই দেশ হওয়ায় তখন জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে অনেকেই বর্তমান আরাকানে যান। এরপর ব্রিটিশরা বার্মা (বর্তমান মিয়ানমার) দখল করে ব্রিটিশ ভারতের সঙ্গে যুক্ত করেন। তখন পুরো ব্রিটিশ ভারত থেকেই মানুষ বার্মায় গেয়েছে। আবার বার্মা থেকেও তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতে এসেছে। বিশেষ করে আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামের অনেক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ এবং চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার অঞ্চলের রাখাইনরা। আসলে মানুষের ইতিহাস অভিবাসনের ইতিহাস। আজ যে জায়গা নিয়ে কেউ গর্ব করছে, মাতৃভূমি বলে দাবি করছে সে জায়গাটিতে তার পূর্ব পুরুষরা এসেছিল অন্য কোনো জায়গা থেকে। আবার তার উত্তরসূরিরা যে এই জায়গায় থাকবে, এই জায়গা নিয়ে গর্ব করবে এমনটি নাও হতে পারে। বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে মানুষ মাতৃভূমি ত্যাগ করে ইউরোপ-আমেরিকায় অভিবাসী হচ্ছে। তাদের পরবর্তী প্রজন্ম তাদের সংশ্লিষ্ট আবাসভূমির পরিচয়েই বেড়ে উঠছে, তাদের পিতা-মাতার জন্মভূমির পরিচয়ে নয়। যে রাখাইনরা রোহিঙ্গাদের অভিবাসী বলে অখ্যায়িত করছে তারাও যে চিরকাল আরাকানে ছিল এমনটি নয়। আবার আরাকানের রোহিঙ্গাদের ইতিহাস যে একেবারে সাম্প্র্রতিক তাও নয়, কম করে হলেও ৬০০ বছরের।
আজকাল আরাকানকে রাখাইন বলা হচ্ছে কিন্তু রাখাইন নামটির মধ্যেই নিহিত আছে বৈষম্য ও সাম্প্রদায়িকতার বীজ। এই নামকরণের মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গাসহ আরাকানের অধিবাসী অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর অস্তিত্ব অস্বীকার করা হচ্ছে। যেখানে দেশটির নাম বার্মার বদলে মিয়ানমার করা হয়েছে এই যুক্তিতে যে এটি শুধু বর্মীদের দেশ নয় বরং এতে বসবাসকারী অন্যান্য জনগোষ্ঠীরও। সেখানে এর একটি প্রদেশের ঐতিহ্যবাহী, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও প্রচলিত নাম পাল্টে একটি নির্দিষ্ট সম্প্র্রদায়ের নামে নামকরণ করা হলো রাখাইন। অথচ এটি এই সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যগত ও ঐতিহাসিক নাম নয়। ঐতিহাসিকভাবে তারা পরিচিত ছিল মগ নামে। সেই সূত্রে আরাকানকে মগের মুল্লুক (শাব্দিক অর্থে) বলা যায়। কিন্তু চতুর ও নির্যাতনকারী এই সম্প্রদায়টি নিজেদের ঘৃণ্য ইতিহাস ও লুটেরা ঐতিহ্যকে আড়াল করতে নিজেদের নাম বদলে ফেলেছে এবং পরিবর্তী সময়ে সেই নামে পুরো ভূখণ্ডটির নামকরণ করে অন্যান্য জাতি-গোষ্ঠীকে অস্বীকার করছে। আরাকানের প্রধান বন্দর আকিয়াবের নামও পাল্টে করেছে সিত্তুয়ে। নাম পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে তারা ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে আড়াল করে ফেলেছে। নামকরণের এই রাজনীতিটুকু আমাদের বুঝতে হবে।
ভৌগোলিকভাবে আরাকান বার্মার অন্যান্য অঞ্চল থেকে উঁচু পর্বতমালা দিয়ে পৃথক। প্রাচীনকাল থেকে বার্মার অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে আরাকানের যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম সমুদ্র পথ। যা বেশ ঘুর পথ। অনেকটা আগরতলা থেকে আসাম ঘুরে কলকাতা যাওয়ার মতো। বর্তমানে পাহাড়ের ফাঁক-ফোকড় দিয়ে কিছু রাস্তা তৈরি হয়েছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় যৎসমান্য। যুদ্ধ, দারিদ্র্যক্লিষ্ট ও অকার্যকর রাষ্ট্র মিয়ানমারের পক্ষে এর চেয়ে বেশি সম্ভবও নয়। সেই তুলনায় বাংলার সঙ্গে স্থল ও সমুদ্রপথে আরাকানের যোগাযোগ অনেক সহজ। সে কারণেই আরাকানের ইতিহাস যতটা বার্মামুখী তার চেয়ে অনেক বেশি বাংলামুখী।
সমস্যার শুরুটা হয় ব্রিটিশরা ভারত থেকে বার্মাকে আলাদা করার সময়। তারা আরাকান দখলের সময় এটি বার্মার অধীনে ছিল। তাই আরাকানকে তারা বার্মার সঙ্গে যুক্ত করা যুক্তিযুক্ত মনে করে। অথচ আরাকানের সুদীর্ঘ ইতিহাসে বার্মীদের অধীনে তারা অল্প সময়ই ছিল এবং এই সময়টাকে আরাকানীরা পরাধীনতা মনে করে। ব্রিটিশরা আরেকটা সমস্যা তৈরি করে বাংলা (ব্রিটিশ ভারত) ও আরাকানের (বার্মা) সীমানা নির্ধারণে। যেটি হওয়া উচিত ছিল আকিয়াবের উপকণ্ঠে কালাদান নদী বরাবর, এটি করা হয় নাফ নদী বরাবর। আর এতেই কপাল পুড়ে রোহিঙ্গাদের। তারা আবদ্ধ হয়ে যায় তাদের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত এক রাষ্ট্রে। বিপদ তারা বুঝতে পেরেছিল ঠিকই কিন্তু বুঝতে পারেনি বা চায়নি দখলদার ব্রিটিশরা এবং ব্রিটিশ ভারতের দুটি প্রধান রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস। ভারত-পাকিস্তান ভাগ হওয়ার সময়ও রোহিঙ্গারা আরাকানকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করার দাবি তুলেছিল। মুসলিম লীগ সেদিকে কর্ণপাত করেনি অন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ মনে করে। অথচ মুসলিম লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী কংগ্রেস ভারতে সেই ভুল করেনি। তারা ঠিকই জন্মের পর পরই আগ্রাসন চালিয়ে হায়দ্রাবাদ, গোয়া ও জুনাগড় এবং রাজাকে কব্জা করে কাশ্মীরের অর্ধেকটা ভারতভুক্ত করে নেয়। তাদের একজন বল্লভ ভাই পাতিল ছিলেন। মুসলিম লীগে এই ভূমিকাটা কেউ পালন করেনি। আমাদের পূর্বসূরিদের সেই ভুলের দায় আমাদের মেটাতে হচ্ছে দীর্ঘকাল ধরে লাখ লাখ শরণার্থীর বোঝা টেনে। দরিদ্র ও বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল (সিঙ্গাপুর, মোনাকোর মতো নগর রাষ্ট্রগুলো বাদে) রাষ্ট্রকে সামলাতে হচ্ছে তার চেয়েও দরিদ্র, রাষ্ট্রহীন এক বিশাল জনগোষ্ঠীকে। এখন প্রশ্ন হলো, আর কতকাল আমরা এই অসহনীয় বোঝা টানব? আমরা কি পূর্বসূরিদের মতো ভুলই করে যাব?
বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির প্রতিষ্ঠার পর এখনই আন্তর্জাতিকভাবে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য একজন নেতা এটি পরিচালনা করছেন। ড. মুহাম্মদ ইউনুসের কাছে এ দেশের জনগণের মতো সারা বিশ্বের মানুষেরও অনেক প্রত্যাশা। রাষ্ট্রহারা রোহিঙ্গারা তার দিকে তাকিয়ে। জাতিসংঘও তার ওপর ভরসা রাখছে। বাংলাদেশের জনগণ পূর্বসূরিদের ভুল সংশোধন ও বোঝা লাঘবের জন্য তাকেই বিশ্বাস করছে। তিনি রোহিঙ্গাদের মধ্যে বিশ্বাস জাগিয়েছেন ঘরে ফেরার, পূর্ব পুরুষদের কবর জিয়ারতের।
আরাকানের অধিবাসীদের কাছে সাহায্য পৌঁছানোর জন্য করিডোর নিয়ে কথা হচ্ছে। মানবিক কারণে এবং দুর্ভিক্ষকবলিত রোহিঙ্গা ও অন্যান্য জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশে আগমন ঠেকাতে এটি প্রয়োজন। কিন্তু এর চেয়েও বেশি প্রয়োজন রোহিঙ্গাদের নিজ ভূমিতে ফিরিয়ে দেয়া। আগে বাংলাদেশ সীমান্তসংলগ্ন আরাকানে, সুনির্দিষ্টভাবে বললে নাফ নদী থেকে কালাদান নদী পর্যন্ত নিরস্ত্র অঞ্চল (No war zone) প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। যেখানে রোহিঙ্গা ও অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর লোকজন নিরাপদে থাকতে পারবে। এরপর বাংলাদেশের ভেতর দিয়েই হোক আর আরাকানের আকিয়াব বন্দর দিয়েই হোক সেখানকার দুর্গত মানুষের কাছে সাহায্য পৌঁছানো যাবে। প্রশ্ন হলো এই কাজ করবে কে? অন্য কোথাও যাওয়ার প্রয়োজন নেই। জাতিসংঘের অধীনে নিরস্ত্র অঞ্চল প্রতিষ্ঠা এবং দুর্গত মানুষের কাছে জরুরি সহায্য পৌঁছানো এই দুটো কাজেই বিশ্বের সেরা বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী। জাতিসংঘের বিভিন্ন মিশনে এসব কাজে অংশগ্রহণের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ও সুনাম রয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর। আসল কাজ হলো আরাকান আর্মি ও মিয়ানমারের জান্তা সরকারকে রাজি করানো। এখানেই দরকার শান্তির দূত ড. মুহাম্মদ ইউনূসের। তার দূরদর্শী ও প্রজ্ঞাবান নেতৃত্বের ওপর আমরা ভরসা রাখতে চাই। মিয়ানমারে উল্লিখিত অভ্যন্তরীণ দুই শক্তি ছাড়াও সক্রিয় তিন বিদেশি শক্তি— চীন, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র। তাদের বুঝাতে হবে মিয়ানমারে যেমন তাদের স্বার্থ আছে তেমনি বাংলাদেশেও তাদের স্বার্থ আছে। বাজার ও ভূরাজনৈতিক অবস্থানের হিসাবে মিয়ানমারের চেয়ে বাংলাদেশ বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশের পূর্ববর্তী সরকারগুলোর নতজানু কূটনীতির কারণে আমরা তিন পরাশক্তির কাছ থেকে নিজেদের প্রাপ্যটা বুঝে নিতে ব্যর্থ হয়েছি। আমরা বিশ্বাস করি, এই ব্যর্থতার গ্লানি থেকে ড. মুহাম্মদ ইউনূস আমাদের মুক্ত করবেন। চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের যে কেউই আমাদের দাবি, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন অস্বীকার কিংবা বিলম্বিত করলে তাদের আমাদের গুরুত্ব সেভাবেই বুঝিয়ে দিতে হবে যেভাবে তিনি আমাদের বৃহৎ প্রতিবেশীকে আমাদের গুরুত্ব বুঝিয়ে দিচ্ছেন। চীন ও ভারত উভয়কেই বুঝিয়ে দিতে হবে রোহিঙ্গাদের অশান্তিতে রেখে আকিয়াব (বর্তমানে সিত্তুয়ে) বন্দর ও কালাদান নদী ব্যবহার করে নিজ দেশে পণ্য পরিবহনের স্বপ্ন বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।
সারা বিশ্বে রোহিঙ্গাদের আত্মরক্ষার ও নিজ ভূমিতে ফেরার অধিকারের স্বীকৃতি আদায়ে আমাদের কাজ করতে হবে। বাংলাদেশ থেকে অধিক আপন তাদের কেউ নেই, তাদেরকে নিয়ে বাংলাদেশের থেকে বেশি ভোগান্তিতেও কেউ নেই। বছরের পর বছর তাদের আশ্রয় দিয়ে আমাদের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়নি বরং, একটি কর্মঠ জনগোষ্ঠীকে আমরা পরনির্ভরশীল করে তুলেছি। আমাদের উচিত তাদেরকে অধিকার আদায়ের লড়াইয়ের উপযুক্ত করে তোলা এবং এই লড়াইয়ে তাদের সহযোগী হওয়া। নিজেদের আকার ও সামর্থ্যের সীমাবদ্ধতা বিবেচনা করে এই কাজ থেকে বিরত থাকা যাবে না, সামর্থ্য অর্জন করতে হবে। মনে রাখতে হবে, পিতৃহীন পুত্রের ওপর সংসারের দায় যখন চাপে তখন বয়সের বিবেচনায় সে অব্যাহতি পায় না। রোহিঙ্গাদের বোঝা আমাদের মাথায় চেপেছে। আমাদের হয় এই বোঝা নামাতে হবে না হয় এর তলায় পিষ্ট হতে হবে। রোহিঙ্গাদের নিজ ভূমির অধিকার ফিরে পেতে মিয়ানমারের বর্তমান মানচিত্রে যদি পরিবর্তনের প্রয়োজন হয় তবে তা-ই করতে হবে। মিয়ানমার নামক বর্তমান রাষ্ট্রটি চিরকাল এই আকারে ছিল না, রোহিঙ্গাদের ভূমির অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে হয়তো ভবিষ্যতেও এমন থাকবে না। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই গৃহযুদ্ধে বিদ্ধস্ত, অকার্যকর রাষ্ট্র মিয়ানমারের সরকার ও রাখাইনদের গভীরভাবে বুঝিয়ে দিতে হবে তারা শান্তিতে থাকতে চাইলে রোহিঙ্গাদেরকেও আরাকানে শান্তিতে থাকতে দিতে হবে; আর না হলে ভূমি হারানোর জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। অথচ আমরা দেখছি আরাকান আর্মি বাংলাদেশের নৌযান ও নাগরিকদের আটকে রাখছে, নির্যাতন করছে, মুক্তিপণ আদায় করছে। প্রতিবেশী বৃহৎ শক্তির সঙ্গে পাল্লা দিতে না পারলেও মিয়ানমার কিংবা এর অংশবিশেষের সঙ্গেও যদি আমরা পেরে না উঠি তবে এর চেয়ে লজ্জার আর কী হতে পারে! বলা হচ্ছে Non state actor দের সঙ্গে সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করা যায় না। আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক স্থাপনই একমাত্র উপায় নয়। যে যে ভাষা বুঝে তাকে সেই ভাষাতেই বুঝিয়ে দিতে হবে। মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় কিংবা আঞ্চলিক কোনো শক্তিই চীনের স্বার্থবিরোধী কাজ করে না। চীন তাদের সঠিক ভাষায় বুঝিয়ে দিয়েছে। আমাদেরও সেই পথ ধরতে হবে। আবারও বলি, সামর্থ্যের দোহাই দিয়ে বসে থাকা যাবে না, সামর্থ্য অর্জন করতে হবে। এতটুকু সামর্থ্য অর্জন করতে হবে যেন মিয়ানমার আমাদের জন্য কখনও দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে না দাঁড়ায়। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের শাসনকাল হোক আমাদের সামর্থ্য অর্জনের সময়কাল, যা ইতিহাসের পাতায় সোনালি অক্ষরে লেখা থাকবে।
লেখক: সরকারি কলেজের সহকারী অধ্যাপক
arif.ju@gmail.com