Print Date & Time : 20 November 2025 Thursday 3:16 pm

লালদিয়া টারমিনালে ডেনমার্কের বিনিয়োগে নতুন যুগে বাংলাদেশ 

নিজস্ব প্রতিবেদক : প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, লালদিয়া টার্মিনালে ডেনমার্কের কোম্পানি এপিএম টার্মিনালসের বিনিয়োগ বাংলাদেশের বাণিজ্য ও প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নতুন যুগের সূচনা করেছে। এটি ডেনমার্ক ও ইউরোপ থেকে বৃহত্তর ও বহুমুখী বিনিয়োগের নতুন দ্বার উন্মোচন করছে। গতকাল সোমবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় মায়ের্স্ক গ্রুপ ও ডেনিশ সরকারের একটি প্রতিনিধিদল প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে তিনি এসব কথা বলেন। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানায়।

অধ্যাপক ইউনূস এপিএম টার্মিনালসকে লালদিয়া টার্মিনালের নির্মাণ দ্রুত সম্পন্ন করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশকে লাখ লাখ উৎপাদনশীল কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে এবং অবকাঠামো উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে হবে এটি হবে আমাদের অর্থনৈতিক প্রবেশদ্বার। এটি ভবিষ্যতের দ্বার উন্মোচন করবে। চট্টগ্রাম উপকূল রেখার বন্দরগকে বিশ্বমানের সুবিধায় রূপান্তর করা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও বাণিজ্য সম্ভাবনার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’

দাভোসে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের কথা স্মরণ করে মায়ের্স্ক গ্রুপের চেয়ারম্যান উগলা বলেন, ‘একটি ফাউন্ডেশনের মালিকানাধীন মায়ের্স্ক গ্রুপ অধ্যাপক ইউনূসের কাজ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছে। এই বিনিয়োগ স্থানীয় সম্প্রদায়ে বড় প্রভাব ফেলবে। কোম্পানি নারীদের সহায়তার উদ্যোগেও গুরুত্ব দেবে।’

প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী এবং পিপিপি কর্তৃপক্ষের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও বিডা নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুনও বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।

এর আগে গতকাল ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (সিপিএ) এপিএম টার্মিনালস বিইভি-এর সঙ্গে ৩০ বছরের কার্যক্রম ও কার্যসম্পাদন-ভিত্তিক বর্ধিত মেয়াদসহ একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। ডেনমার্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ-বিষয়ক স্টেট সেক্রেটারি লিনা গান্ডলোস হ্যানসেন ও ঢাকায় ডেনমার্ক দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত ক্রিশ্চিয়ান ব্রিক্স মোলার এই চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন এবং পিপিপি অথোরিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। প্রধান অতিথি ছিলেন নৌপরিবহন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত  হোসেন।

এম সাখাওয়াত  বলেন, ‘এ বিনিয়োগ দেশে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে যুব সমাজের জন্য উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি বয়ে আনবে। প্রকল্পটি সম্পন্ন হলে, দেশের অনেক তরুণ, বিশেষ করে শিক্ষিত যুবকরা চাকরির সুযোগ পাবে।’

তিনি উল্লেখ করেন যে বাংলাদেশে দক্ষ জনশক্তির অভাব নেই এবং অনেক পরিশ্রমী বাংলাদেশি ইউরোপ ও আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কাজ করছে। এই দক্ষ কর্মশক্তিকে দেশের ভেতরেই কাজে লাগানোর ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।

বিগত সময়ে বাংলাদেশে বিনিয়োগ কম ছিল উল্লেখ করে ড. এম সাখাওয়াত এই চুক্তিকে একটি ‘নতুন যাত্রা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তিনি অন্যান্য দেশকেও বাংলাদেশে বিনিয়োগ করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘আমি অন্যান্য দেশকেও বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। বাংলাদেশের পরিশ্রমী জনগোষ্ঠীর কারণে, দেশটি সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বিনিয়োগ গন্তব্যে পরিণত হয়েছে।’

সাখাওয়াত আশা প্রকাশ করেন, এই গুরুত্বপূর্ণ আন্তঃসরকারি সহযোগিতা প্রকল্পটির জাতীয় স্বার্থ নিয়ে যে কোনো সংশয় দূর করবে।

লালদিয়া টার্মিনাল চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ঢাকায় আসা মায়ের্স্ক গ্রুপ চেয়ারম্যান উগলা বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দর টার্মিনালে তার কোম্পানির বিনিয়োগ হবে বাংলাদেশে কোনো ইউরোপীয় কোম্পানির সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ। ২০৩০ সালে লালদিয়া টার্মিনাল চালু হলে এটি চট্টগ্রাম বন্দরে বড় জাহাজ আগমনের সুযোগ তৈরি করবে এবং বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের গতি সঞ্চার করবে।

তিনি আরও বলেন, ‘এটি হবে একটি টেকসই বন্দর। এটি আরও বেশি কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করবে। এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ খাতে ডেনিশ বিনিয়োগ বাংলাদেশে আরও ইউরোপীয় বিনিয়োগকারী আকৃষ্ট করতে সহায়তা করবে।’

মায়ের্স্ক গ্রুপ চেয়ারম্যান আরও জানান, বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ শিপিং লাইন মালিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে তারা বাংলাদেশের লজিস্টিকস ও সাপ্লাই চেইন খাতে আরও বিনিয়োগের সুযোগ অন্বেষণ করবে।

গত জানুয়ারিতে দাভোসে বৈঠকের পর বাংলাদেশে বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের জন্য উগলাকে ধন্যবাদ জানান প্রধান উপদেষ্টা। ডেনিশ কোম্পানির সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা আনন্দিত ও উচ্ছ্বসিত।’

এপিএম টার্মিনালস বিইভি ডেনমার্কের এপি মোলার ফাউন্ডেশন কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ইন্টিগ্রেটেড লজিস্টিকস কোম্পানি মায়ের্স্ক এ/এস (মায়ের্স্ক গ্রুপ)-এর একটি পূর্ণ মালিকানাধীন সহযোগী প্রতিষ্ঠান। এই চুক্তির মাধ্যমে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) কাঠামোর আওতায় লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল (এলসিটি) ডিজাইন, অর্থায়ন, নির্মাণ ও পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।

ডেনমার্কের রাষ্ট্রদূত ব্রিক্স মোলার বলেন, ‘বাংলাদেশ পুনর্গঠন ও শক্তিশালী হওয়ার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, যা ভবিষ্যৎ বিনিয়োগ ও টেকসই সহযোগিতার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি তৈরি করছে। ডেনমার্কের বৈশ্বিক দক্ষতা, জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও সক্ষমতাকে কাজে লাগানোর মাধ্যমে এ বিনিয়োগ প্রতিশ্রুতি বাংলাদেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।’

রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘এই নির্দিষ্ট প্রকল্পটি প্রমাণ করে যে বাংলাদেশ ও ডেনমার্ক এখন টেকসই প্রবৃদ্ধির শক্তিশালী অংশীদার।’

ঐতিহাসিকভাবে, ডেনমার্ক বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করতে গভীরভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল, যা বিশাল সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

তিনি আরও বলেন, ‘প্রকৃতপক্ষে গত ৫০ বছরে বাংলাদেশ ছিল বৈশ্বিকভাবে ডেনমার্কের দ্বিতীয় বৃহত্তম উন্নয়ন সহযোগী দেশ। আরও বেশ কিছু প্রকল্প প্রক্রিয়াধীন রয়েছে এবং উভয় দেশের চমৎকার সহযোগিতা ও অংশীদারত্ব অব্যাহত রাখার বিষয়ে তিনি অত্যন্ত আগ্রহী। এই অনুষ্ঠান দুই দেশের অঙ্গীকার, গভীর বন্ধুত্ব ও শক্তিশালী অংশীদারিত্বের উদযাপন।’

লিনা গান্ডলোস হ্যানসেন বলেন, ‘এ প্রকল্পের সফলতা সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের অটল নিষ্ঠা ও প্রতিশ্রুতির প্রমাণ।’

সিপিএ (চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ) জানায়, বন্দরের মালিকানা সিপিএর কাছেই থাকবে আর এপিএম টার্মিনালস ও তাদের স্থানীয় যৌথ উদ্যোগ (জেভি) অংশীদার কেবল নির্মাণ, পরিচালনা এবং ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করবে। ফলে বাংলাদেশ সরকারের মূলধনী ব্যয়ের চাপ কমবে বলে জানায় সিপিএ।

এপিএম টার্মিনালস বিইভি ডেনমার্ক ভিত্তিক এপি মোলারমায়ের্স্ক-এর পূর্ণ মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান। এটি বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ টার্মিনাল অপারেটর (৩৩টি দেশে ৬০টিরও বেশি টার্মিনাল) এবং বিশ্বব্যাংক ২০২৪ অনুযায়ী বিশ্বের শীর্ষ ২০টি সেরা কনটেইনার বন্দরের মধ্যে ১০টি তারা পরিচালনা করে।

এই নতুন বন্দর বিদ্যমান ক্ষমতার দ্বিগুণ বড় কনটেইনার জাহাজ গ্রহণ করতে পারবে, প্রতি ইউনিট মালবাহী খরচ কমাবে এবং বিশ্বব্যাপী সরাসরি শিপিং সংযোগ সক্ষম করবে। রাজস্ব-ভাগাভাগি রেয়াত মডেলে নির্মিত এই প্রকল্পে বাংলাদেশ স্থিতিশীল বৈদেশিক মুদ্রা আয় করবে, পাশাপাশি সরকারি মূলধনী ব্যয়ও কমবে।

এছাড়াও প্রথমবারের মতো দেশে ২৪/৭ বন্দর কার্যক্রম ও অনুমোদিত দৈর্ঘ্য ও ড্রাফটের জাহাজের জন্য রাতের নৌ-চলাচল (নাইট ন্যাভিগেশন) চালু হবে।

রেয়াত চুক্তির আওতায়, এপিএম টার্মিনালস বিইভি লালদিয়া, চট্টগ্রামে একটি সবুজফিল্ড বন্দর টার্মিনাল নির্মাণের মাধ্যমে প্রায় ৫৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) নিয়ে আসবে। এটি হবে বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত এককভাবে সবচেয়ে বড় ইউরোপীয় ইকুইটি বিনিয়োগ।