আরশী আক্তার সানী : ঢাকা বা বড় শহরের যে কোনো রাস্তা ঘুরলেই চোখে পড়ে অসংখ্য ছোট দোকান, ফুটপাথের হকার, রাস্তায় খাবারের স্টল এবং স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। এরা শহরের অর্থনীতির একটি অদৃশ্য কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ছোট ব্যবসার সংখ্যা অনিশ্চিত হলেও এরা শহরের দৈনন্দিন জীবনকে ধরে রাখে। মানুষ প্রতিদিন এদের ওপর নির্ভর করে।
অন্যদিকে শহরে বড় বড় করপোরেট দোকান, সুপারশপ, মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি এবং ব্র্যান্ডিং প্রতিষ্ঠান বাজারে আধিপত্য বিস্তার করছে। তারা শক্তিশালী বিপণন কৌশল, ব্র্যান্ডিং, প্রযুক্তি ও বড় মুনাফার মাধ্যমে গ্রাহক আকর্ষণ করে। ফলে ছোট ব্যবসাগুলো টিকে থাকতে নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে।
এই দুই ধরনের ব্যবসার লড়াই শুধু অর্থনৈতিক নয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। শহরের অর্থনীতির ভারসাম্য, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা এবং স্থানীয় ব্যবসার টিকে থাকার সক্ষমতা— সবই এই লড়াইয়ের ওপর নির্ভর করছে।
ছোট ব্যবসার শক্তি ও গুরুত্ব: ছোট ব্যবসার সবচেয়ে বড় শক্তি হলো মানবিক সম্পর্ক। দোকানিরা প্রায়শই নিজের গ্রাহকের নাম জানে, কোন পণ্যটি বেশি প্রয়োজন তা জানে এবং কখনও কখনও ধারও দেয়। এটি একটি ব্যক্তিগত সম্পর্ক, যা করপোরেট জায়ান্ট দিতে পারে না।
ছোট ব্যবসা স্থানীয় অর্থনীতিকে সচল রাখে। গ্রাহকরা যদি সরাসরি দোকানির কাছে ক্রয় করেন, তবে অর্থ স্থানীয় পর্যায়ে ঘুরে ফিরে আসে। এতে শহরের অর্থনীতিতে আরও সমৃদ্ধি আসে।
ছোট ব্যবসার আরেকটি শক্তি হলো নতুনত্ব ও উদ্ভাবন। ছোট আকারের ব্যবসা হওয়ায় তারা দ্রুত পরিবর্তন আনতে পারে। নতুন পণ্য, সেবা বা অফার সহজেই গ্রাহকের সামনে উপস্থাপন করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, কোনো ফুটপাথের দোকানি হঠাৎ নতুন ধরনের খাবার বা সস্তা বিকল্প আনতে পারেন, যা বড় সুপারশপ করতে সময় লাগে।
ছোট ব্যবসার চ্যালেঞ্জ: ছোট ব্যবসার জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো প্রতিযোগিতা ও খরচ। শহরের কেন্দ্রস্থলে দোকান ভাড়া বা ফ্ল্যাট ভাড়া দিন দিন বেড়ে চলেছে। অনেক ছোট ব্যবসায়ী তা সামলাতে পারে না। এছাড়া করপোরেট ব্র্যান্ডের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার জন্য বড় বিনিয়োগের প্রয়োজন।
সরবরাহ শৃঙ্খলা ছোট ব্যবসায়ীদের জন্য একটি বড় সমস্যা। বড় প্রতিষ্ঠান নিয়মিত সরবরাহের ব্যবস্থা করে, স্টক ও ডেলিভারির ক্ষেত্রে সুবিধা থাকে। কিন্তু ছোট ব্যবসায়ীরা প্রায়শই সময়মতো পণ্য সংগ্রহ করতে পারে না, যা তাদের বাজারে টিকে থাকার ক্ষমতা কমিয়ে দেয়।
বাজার প্রতিযোগিতা ও গ্রাহক আকর্ষণ— এখানেও সমস্যা আছে। করপোরেট জায়ান্টরা বিজ্ঞাপন, ডিসকাউন্ট, অফার এবং loyalty program চালু করে গ্রাহক ধরে রাখে। ছোট ব্যবসা প্রায়শই এই ধরনের প্রচারণা চালাতে পারে না। ফলে গ্রাহক ধীরে ধীরে বড় দোকানের দিকে চলে যায়।
করপোরেট জায়ান্টের প্রভাব: শহরের বড় কোম্পানি ও মাল্টিন্যাশনাল ব্র্যান্ডগুলো স্থানীয় ব্যবসার ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। তারা স্বল্পমূল্যে পণ্য বিক্রি করে গ্রাহককে আকৃষ্ট করে। বড় কোম্পানির বিপণন কৌশল সাধারণ মানুষের কাছে বেশি বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়।
তবে করপোরেট জায়ান্টের উপস্থিতি শুধুই নেতিবাচক নয়। তারা শহরের অর্থনীতিকে আধুনিকীকরণ করছে। নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করছে, প্রযুক্তি ব্যবহার করছে এবং শহরের মানুষের ক্রয় অভ্যাসে বৈচিত্র্য আনছে।
কিন্তু যদি ছোট ব্যবসা টিকে না থাকে, তাহলে বাজারে কিছু কিছু বড় প্রতিষ্ঠান আধিপত্য বিস্তার করবে। এতে অর্থনৈতিক ভারসাম্য নষ্ট হবে এবং সাধারণ মানুষের জন্য পছন্দ ও সুযোগ সীমিত হবে।
ছোট ব্যবসা টিকে থাকার জন্য কিছু কৌশল অবলম্বন করা যায়।
ডিজিটালাইজেশন: অনলাইন মার্কেটপ্লেস, সোশ্যাল মিডিয়া ও মোবাইল অ্যাপ ব্যবহার করে তারা পণ্য ও সেবা গ্রাহকের কাছে সহজে পৌঁছে দিতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ফেসবুক মার্কেটপ্লেস বা শপিফাই ব্যবহার করে তারা অনলাইনে বিক্রির সুযোগ তৈরি করতে পারে।
সহযোগিতা: ছোট ব্যবসাগুলো গ্রুপ বা অ্যাসোসিয়েশন গঠন করে একসঙ্গে বড় ক্রয় বা প্রচারণা চালাতে পারে। এতে খরচ কমে এবং বাজারে প্রতিযোগিতা করা সহজ হয়।
স্থানীয় অভিজ্ঞতা: দোকানিরা গ্রাহককে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা দিতে পারে। গ্রাহকের নাম মনে রাখা, নির্দিষ্ট পছন্দ অনুযায়ী সেবা দেয়া— এগুলো বড় প্রতিষ্ঠান দিতে পারে না।
সৃজনশীলতা ও বৈচিত্র্য: বিশেষ পণ্য, স্থানীয় হস্তশিল্প বা অনন্য সেবা প্রদান করে তারা বাজারে আলাদা অবস্থান তৈরি করতে পারে।
প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন: স্থানীয় প্রশাসন বা সরকারি উদ্যোগের মাধ্যমে ব্যবসায়ীদের প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সহায়তা দেয়া গেলে তারা আরও কার্যকরভাবে প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারবে।
নৈতিক ও সামাজিক দিক: শহরের অর্থনীতিতে ছোট ব্যবসা ও করপোরেট জায়ান্টের মধ্যে ভারসাম্য থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শুধু বড় প্রতিষ্ঠান থাকলে অর্থনৈতিক শক্তি কয়েকটি হাতের মধ্যে চলে যাবে। এতে দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
সরকার ও স্থানীয় প্রশাসনও এই ভারসাম্য রক্ষায় ভূমিকা রাখতে পারে। করপোরেট জায়ান্টদের জন্য কর, লাইসেন্স ও নীতিমালা নির্ধারণ করা এবং ছোট ব্যবসায়ীদের জন্য ঋণ সুবিধা, প্রশিক্ষণ, ডিজিটাল মার্কেটিং সাপোর্ট ইত্যাদি প্রয়োজন।
ভবিষ্যতের প্রেক্ষাপট: বর্তমান সময়ে শহরের অর্থনীতি ক্রমেই ডিজিটাল ও করপোরেট প্রভাবিত হচ্ছে। তবুও ছোট ব্যবসা টিকে থাকার ক্ষেত্রে গঠনমূলক পরিবর্তন এবং সৃজনশীলতা প্রয়োগ করলে তারা এই লড়াইয়ে জয়ী হতে পারে।
গ্রাহকরা যদি স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সমর্থন দেন, তারা নিজস্ব অর্থনীতি শক্তিশালী করতে সহায়তা করে। ছোট ব্যবসা বনাম করপোরেট জায়ান্টের লড়াই কেবল অর্থনৈতিক নয়, এটি আমাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনকেও প্রভাবিত করে।
শহরের ছোট ব্যবসা শুধু অর্থ উপার্জনের মাধ্যম নয়; এটি মানুষের জীবনের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। করপোরেট জায়ান্টদের সঙ্গে তাদের টিকে থাকার লড়াই হলো আর্থিক স্বাধীনতা, সামাজিক সংযোগ এবং শহরের প্রাণের জন্য লড়াই।
শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়