সুধীর বরণ মাঝি : মানুষের পূর্ণ বিকাশ কেবল বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ নয়; এটি শরীর, মন ও বুদ্ধির সমন্বিত বিকাশের মধ্য দিয়েই সম্পূর্ণতা পায়। আমরা যখন সাধারণ শিক্ষাকে জ্ঞানের একমাত্র বাহক হিসেবে ধরে নিই তখন প্রকৃত শিক্ষার মর্মকেই অস্বীকার যে সমাজ শারীরিক শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দেয়, তারা জানে মানসিক স্বাস্থ্য এবং কর্মক্ষমতার মূল ভিত্তি একটি সুস্থ দেহ। একটি শক্তিশালী শরীরই গড়ে তোলে দৃঢ় মন, আর মন তৈরি করে সৃষ্টিশীলতা, সাহস ও নেতৃত্বের গুণ। আমাদের প্রাচীন দার্শনিকরাও বলেছিলেন, ‘সুস্থ দেহেই সুস্থ মন বাস করে।’ এই সহজ সত্যটি ভুলে গিয়ে আমরা এমন এক শিক্ষা সংস্কৃতি গড়ে তুলেছি, যেখানে পরীক্ষার ফলাফলই সবকিছু নির্ধারণ করে মানুষ নয়, কেবলমাত্র ‘প্রার্থী’ তৈরি হয়। শিক্ষা কখনোই কেবল তথ্য অর্জনের প্রক্রিয়া নয়; এটি জীবনকে জানার, আত্মশক্তিকে জাগ্রত করার একটি যাত্রা। এই যাত্রায় শরীর ও মন একে অপরের পরিপূরক। যে ছাত্র প্রতিদিন নিয়মিত শরীরচর্চা করে, খেলাধুলায় অংশ নেয়, সে কেবল শারীরিকভাবে শক্তিশালী হয় না-তার মধ্যে জন্ম নেয় আত্মনিয়ন্ত্রণ, সহযোগিতা, সহনশীলতা ও নেতৃত্বগুণ। খেলাধুলার মাঠ তাকে শেখায় পরাজয় মেনে নেয়ার শিক্ষা, অন্যের সাফল্যে আনন্দিত হওয়ার উদারতা, আর নিজের সীমা ভাঙার অনুপ্রেরণা। কিন্তু আজ আমাদের পাঠ্যসূচিতে শারীরিক শিক্ষা নামমাত্র অন্তর্ভুক্ত থাকলেও বাস্তবে তা কার্যকর নয়। অধিকাংশ বিদ্যালয়ে প্রশিক্ষিত শারীরিক শিক্ষা শিক্ষক নেই, নেই পর্যাপ্ত মাঠ বা ক্রীড়া সামগ্রী। পাঠ্যপুস্তকের তত্ত্ব মুখস্থ করাতে আমরা যত উৎসাহী, খেলাধুলার সময়টুকুও একাডেমিক কোচিং বা পরীক্ষার প্রস্তুতিতে ব্যয় করতে ততটাই ব্যস্ত। ফলে আমাদের সন্তানরা অল্প বয়সেই শারীরিকভাবে দুর্বল, মানসিকভাবে চাপগ্রস্ত ও সামাজিকভাবে একাকী হয়ে পড়ছে। নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন প্রতিদিন টেনিস ও হাঁটার অভ্যাস বজায় রাখতেন। তার মতে, ‘শরীরকে সক্রিয় না রাখলে মস্তিষ্কের সৃজনশীল শক্তি স্থবির হয়ে যায়।’
আজকের সমাজে যেসব সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছি-যেমন মানসিক চাপ, হতাশা, অবসাদ, সহনশীলতার অভাব, অস্থিরতা ও অসামাজিক আচরণ-এসবের একটি বড় কারণ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় শরীর ও মনের মধ্যে ভারসাম্যের অভাব। অফিসের কাজ, মোবাইল, ইন্টারনেট, ভার্চুয়াল গেম-সবই আমাদের জীবনযাত্রাকে স্থবির করে তুলেছে। আমরা যেন দেখতে মানুষ হলেও ভেতরে ভেতরে হয়ে উঠছি যান্ত্রিক, অসুস্থ ও শূন্য। এ যেন এক গভীর ষড়যন্ত্রের ফল, যেখানে আমাদের মনকে ব্যস্ত রাখা হচ্ছে অপ্রয়োজনীয় প্রতিযোগিতা, ভোগবাদ ও কৃত্রিম সাফল্যের মায়াজালে। ফলে আমরা ভুলে যাচ্ছি মানবিকতা, সৃজনশীলতা ও চিন্তার স্বাধীনতা। সমাজের এই স্থবিরতা দূর করতে হলে প্রথমেই আমাদের ফিরতে হবে শারীরিক শিক্ষার শিকড়ে-যে শিক্ষা দেহকে শুধু শক্তিশালী করে না, আত্মাকে দেয় জাগরণের প্রেরণা।
বিশ্বের উন্নত দেশগুলো শারীরিক শিক্ষার গুরুত্ব বহু আগেই উপলব্ধি করেছে। জাপানে প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত প্রতিটি শিক্ষার্থীর জন্য প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময় ধরে শরীরচর্চা বাধ্যতামূলক। সকাল শুরু হয় ‘রেডিও টাইসো’ নামে জাতীয় ব্যায়াম কর্মসূচি দিয়ে-যেখানে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, এমনকি অভিভাবকরাও একসঙ্গে অংশ নেয়। ফলাফল হিসেবে দেখা গেছে, জাপানের শিক্ষার্থীরা শুধু শারীরিকভাবে নয়, মানসিকভাবেও অধিক মনোযোগী ও দায়িত্বশীল হয়ে উঠেছে। তাদের শিক্ষাব্যবস্থায় ‘শরীরচর্চা’ আর ‘শিক্ষা’ একে অপরের পরিপূরক হিসেবে বিবেচিত হয়। ইউরোপে স্কুলের মাঠ শুধু ক্রীড়ার স্থান নয়-সেখানে গড়ে ওঠে নেতৃত্ব, দলগত চেতনা এবং জাতিগত ঐক্যের ভিত্তি। এমনকি ফিনল্যান্ডের মতো দেশে শিক্ষার্থীদের প্রতিদিন একাধিক বিরতি দেয়া হয় যাতে তারা বাইরে গিয়ে খেলতে পারে, শরীর নড়াচড়া করতে পারে। তাদের বিশ্বাস-একজন সুস্থ ও আনন্দিত শিশু-ই প্রকৃত শিখনক্ষম।
বাংলাদেশে শিক্ষা নীতিতেও শারীরিক শিক্ষার গুরুত্বের কথা বলা আছে, কিন্তু বাস্তবায়ন খুবই সীমিত। স্কুল বা কলেজ পর্যায়ে অনেক সময় শারীরিক শিক্ষাকে ‘গৌণ’ বিষয় হিসেবে দেখা হয়। অথচ এই অবহেলাই ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ধীরে ধীরে শারীরিক ও মানসিক দুর্বলতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, নিয়মিত শারীরিক অনুশীলন মনোযোগ, স্মৃতিশক্তি ও একাডেমিক পারফরম্যান্স বৃদ্ধিতে সরাসরি ভূমিকা রাখে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জরিপে দেখা গেছে, যে শিক্ষার্থীরা সপ্তাহে অন্তত তিন দিন ৩০ মিনিট করে শারীরিক অনুশীলন করে, তাদের মানসিক একাগ্রতা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি। এমনকি চিকিৎসাবিজ্ঞানের দৃষ্টিতেও শারীরিক অনুশীলন বিষণ্নতা, উদ্বেগ এবং ক্লান্তি দূর করতে কার্যকর ভূমিকা রাখে। শরীর যখন সক্রিয় থাকে, তখন মস্তিষ্কে ‘এন্ডোরফিন’ নামে এক ধরনের হরমোন নিঃসৃত হয়, যা সুখ ও ইতিবাচক শক্তি সৃষ্টি করে। প্রাচীন ভারতের শিক্ষাকেন্দ্র নালন্দা ও তক্ষশীলায় শারীরিক অনুশীলন ছিল শিক্ষার অবিচ্ছেদ্য অংশ। ছাত্ররা সকালে যোগব্যায়াম ও মার্শাল ট্রেনিং করত, তারপর শুরু হতো পাঠ। কারণ তারা বিশ্বাস করত ‘দেহের শৃঙ্খলাই মনের শৃঙ্খলার ভিত্তি’। আজকের আধুনিক বিশ্ব সেই প্রাচীন সত্যকেই নতুন রূপে প্রতিষ্ঠা করছে।
শারীরিক শিক্ষাকে কার্যকর করতে হলে প্রথমেই দরকার নীতিগত অঙ্গীকার। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষিত শারীরিক শিক্ষা শিক্ষক নিয়োগ, পর্যাপ্ত মাঠ ও ক্রীড়া সামগ্রী নিশ্চিত করা জরুরি। পাশাপাশি পাঠ্যসূচিতে শারীরিক শিক্ষাকে ঐচ্ছিক নয়, বাধ্যতামূলক করতে হবে। অভিভাবক সমাজকেও এই দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে যে খেলাধুলা সময়ের অপচয় নয়। বরং এটি শিশুর ব্যক্তিত্ব গঠনের অপরিহার্য অনুষঙ্গ। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে স্থানীয় ক্রীড়া উদ্যোগ ও বার্ষিক ক্রীড়া উৎসব আয়োজন করলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আগ্রহ তৈরি হবে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গবেষণা ও ক্রীড়া বিজ্ঞান নিয়ে পাঠ্যক্রম সম্প্রসারণের মাধ্যমে শারীরিক শিক্ষা বিষয়ে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হতে পারে। দুঃখজনকভাবে, আমরা এখানে এক গভীর ষড়যন্ত্রের ফাঁদে বন্দি হয়ে পড়েছি-যেখানে মানুষ দেখতে মানুষ হলেও, শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্রমে অসুস্থ হয়ে বেঁচে থাকে। আমাদের সৃজনশীলতা যেন বিকশিত না হয়, চিন্তার আলো যেন আমাদের স্পর্শ না করে-এমন এক অন্ধকারচক্র আমাদের ঘিরে রেখেছে।
অতএব, সত্যিকার শিক্ষার বিকাশে শারীরিক শিক্ষাকে প্রাথমিক ও অপরিহার্য উপাদান হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে।
আমরা যদি সত্যিই একটি সৃষ্টিশীল, সুস্থ ও মানবিক সমাজ চাই, তবে শারীরিক শিক্ষাকে নতুন করে চিনতে ও গুরুত্ব দিতে হবে। আজকের শিশুরা আগামী দিনের রাষ্ট্রনেতা, চিন্তাবিদ, বিজ্ঞানী ও শিক্ষক। তাদের শরীর যদি দুর্বল হয়, মন যদি ক্লান্ত হয়, তবে তারা কখনও জাতিকে এগিয়ে নিতে পারবে না। তাই সময় এসেছে শারীরিক শিক্ষাকে শিক্ষাব্যবস্থার কেন্দ্রে স্থান দেয়ারÑকারণ শারীরিক শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতির প্রকৃত অগ্রগতি সম্ভব নয়। শারীরিক শিক্ষাও সাধারণ শিক্ষার পরিপূরক হিসেবে কাজ করে। এই সত্যটি যে জাতি উপলব্ধি করেছে, তারা শিক্ষাক্ষেত্রে, গবেষণায় এবং সভ্যতার বিকাশে এগিয়ে গেছে। তারা আজও সেই অগ্রযাত্রা অব্যাহত রেখেছে নতুন নতুন উদ্ভাবন ও জ্ঞানের বিস্তারের মাধ্যমে। একটি জাতি তখনই সত্যিকার অর্থে আলোকিত হয়, যখন তার শিক্ষা দেহ, মন ও আত্মার পূর্ণ বিকাশ ঘটায়।
শিক্ষক, হাইমচর সরকারি মহাবিদ্যালয়, চাঁদপুর
প্রিন্ট করুন







Discussion about this post