নিজস্ব প্রতিবেদক : বাংলাদেশের শিল্প খাতে নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা উৎপাদন, বিনিয়োগ এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করছে বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (ডিসিসিআই) সভাপতি তাসকীন আহমেদ। তিনি জানান, দেশের জিডিপিতে শিল্প খাতের অবদান ৩৫ শতাংশের বেশি হলেও অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয় হলো দেশের মোট গ্যাসের ১৯ শতাংশ ব্যবহারকারী এই বিশাল খাতটি বর্তমানে গভীর অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। গতকাল শনিবার ডিসিসিআই মিলনায়তনে আয়োজিত এক সেমিনারে স্বাগত বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
ডিসিসিআই ও সানেম যৌথভাবে আয়োজিত ‘বাংলাদেশের শিল্প খাতে জ্বালানি সক্ষমতা নীতিমালা: টেকসই উন্নয়নের পথনির্দেশনা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ প্রধান অতিথি ছিলেন।
ঢাকা চেম্বারের সভাপতি (ডিসিসিআই) তাসকীন আহমেদ বলেছেন বলেন, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে গ্যাসের দাম রেকর্ড ১৭৮ শতাংশ বৃদ্ধির পর সম্প্রতি শিল্প খাতে আরও ৩৩ শতাংশ বৃদ্ধির ফলে টেক্সটাইল, স্টিল ও সারের মতো খাতগুলোর উৎপাদন ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ কমে গেছে। বিশেষ করে এসএমই খাতের কার্যক্রম গুটিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছে। এমতাবস্থায় শিল্প খাতে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় জ্বালানির নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করা কেবল নীতিগত অগ্রাধিকারই নয়, বরং টেকসই শিল্পায়নের পূর্বশর্ত বলে তিনি মন্তব্য করেন। দেশের শিল্প ও অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখতে হলে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়ানো, টেকসই জ্বালানি কাঠামো তৈরি ও অপচয় রোধে জোর দেয়ার আহ্বান জানান তাসকীন আহমেদ।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিইআরসির চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ বলেন, ২০৩০ সালের পর দেশীয় গ্যাসের মজুত কমে আসার আশঙ্কা থাকলেও অফশোর-অনশোর এলাকায় গ্যাস অনুসন্ধানে তেমন উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়নি। ফলে আমরা নিজস্ব উৎপাদিত গ্যাস ব্যবহার করতে পারছি না এবং আমদানি-নির্ভর গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছি। তিনি আরও বলেন, জ্বালানি খাতে সরকার ক্রমান্বয়ে ভর্তুকি দিচ্ছে, কারণ এটি দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির সঙ্গে ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। তিনি জানান, জ্বালানি খাতে বর্তমানে দক্ষতার হার প্রায় ৩০ শতাংশ; এ হার বাড়াতে পারলে বিশেষ করে বিদ্যুৎ ঘাটতি কমে আসবে। দেশের তৈরি পোশাক শিল্পে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়াতে পারলে খাতটির অবস্থার দ্রুত উন্নতি সম্ভব বলেও তিনি মত প্রকাশ করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। তিনি জানান, জ্বালানি খাতে মাস্টারপ্ল্যান থাকলেও সহায়ক নীতিমালার অভাব শিল্প খাতকে ভোগাচ্ছে। শিল্পে জ্বালানি সক্ষমতার কোনো সুস্পষ্ট সংজ্ঞা নেই এবং খাতভেদে প্রণোদনা পাওয়ার ক্ষেত্রেও বৈষম্য রয়েছে। আলোচনায় তৈরি পোশাক, সিমেন্ট, স্টিল ও বাণিজ্যিক খাতের শিল্প উদ্যোক্তা এবং সরকারি সংস্থার প্রতিনিধিদের মতামত নেয়া হয়। সেখানে জ্বালানি দক্ষতা বিষয়ে সচেতনতা, জ্বালানি নিরীক্ষা, সাশ্রয়, অর্থায়ন, গ্রিড আধুনিকায়ন ও বাস্তবায়ন-সংক্রান্ত নানা বিষয় গুরুত্ব পায়। অংশগ্রহণকারীরা এনার্জি অডিট, লজিস্টিক সেবা সম্প্র্রসারণ, গ্যাস ও বিদ্যুতের সরবরাহ বৃদ্ধির বিষয়ে কয়েকটি সুপারিশও দেন। কাঠামোগত, সরবরাহগত এবং নীতি ও নিয়ন্ত্রণÑ এই তিন ধরনের কৌশলকে তিনি জরুরি বলে উল্লেখ করেন।
নির্ধারিত আলোচনায় অংশ নেন বাংলাদেশ এনার্জি অ্যান্ড পাওয়ার রিসার্চ কাউন্সিলের (বিইপিআরসি) সদস্য ড. মো. রফিকুল ইসলাম, পাওয়ার গ্রিড বাংলাদেশ পিএলসিÑ এর চেয়ারম্যান ড. এম রেজওয়ান খান, আনোয়ার গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান ও ডিসিসিআইর সাবেক পরিচালক মনোয়ার হোসেন, বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিসিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আমিরুল হক, বাংলাদেশ সাস্টেইনেবল অ্যান্ড রিনিউএবল এনার্জি অ্যাসোসিয়েশন (বিএসআরইএ) সভাপতি মোস্তফা আল মাহমুদ, বাংলাদেশ এলপিজি অটোগ্যাস স্টেশন ও কনভার্সন ওয়ার্কশপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার মো. সিরাজুল মাওলা, বিজিএমইএ সহসভাপতি বিদিয়া অমৃত খান এবং ইডকলের উপপ্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম মনিরুল ইসলাম।
বিইপিআরসির সদস্য ড. মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, জাতীয় নিরাপত্তা ও খাদ্য নিরাপত্তার পর জ্বালানি নিরাপত্তা এখন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমদানিনির্ভর জ্বালানি ব্যবস্থার ফলে ব্যবসায়িক ব্যয় বাড়ছে, তাই দেশীয় উৎসকে অগ্রাধিকার দেয়া জরুরি। গত অর্থবছরে জ্বালানি খাতে প্রায় ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের আমদানি হয়েছেÑ যা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখানে দেশীয় বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ বাড়ানোর ব্যাপক সুযোগ রয়েছে।
পাওয়ার গ্রিড বাংলাদেশ পিএলসির চেয়ারম্যান ড. এম রেজওয়ান খান বলেন, বিদ্যমান শুল্ক কাঠামো পরিবর্তন না হলে এ খাতের সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। পিক ও অফ-পিক সময়ে বিদ্যুতের ভিন্নমূল্য নির্ধারণও প্রয়োজন। সরকারের তেল ক্রয়ের অর্থাভাবের কারণেই প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ সরবরাহে ঘাটতি তৈরি হচ্ছে; সরবরাহ ব্যবস্থার ত্রুটি এতটা উদ্বেগজনক নয় বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
আনোয়ার গ্রুপের চেয়ারম্যান মনোয়ার হোসেন বলেন, উৎপাদিত বিদ্যুৎ শিল্পকারখানায় পৌঁছানোকে সরকারকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। প্রয়োজনীয় জ্বালানি না পাওয়ায় শিল্প খাতে প্রায়শই ৫০ শতাংশ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এ সমস্যাগুলোর দ্রুত সমাধান জরুরি বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
বিসিএমএ সভাপতি মোহাম্মদ আমিরুল হক বলেন, এলপিজি শিল্প খাতে জ্বালানি নিরাপত্তায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু খাতে কোনো আর্থিক প্রণোদনা নেই, বরং প্রায় ১০ শতাংশ কর আরোপিত। বিষয়টি সমাধানে সরকারের উদ্যোগ প্রয়োজন।
বিএসআরইএ সভাপতি মোস্তফা আল মাহমুদ বলেন, দেশে গ্যাস উত্তোলন কমলেও চাহিদা ক্রমাগত বাড়ছে এবং প্রতিবছর জ্বালানি চাহিদা প্রায় ২০ শতাংশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। জ্বালানিÑসংক্রান্ত ভালো নীতিমালা থাকলেও বাস্তবায়ন সন্তোষজনক নয়। তিনি আরও বলেন, দেশের উৎপাদিত মোট বিদ্যুতের ৫০ শতাংশ শিল্পখাতে ব্যবহƒত হয়; তাই এনার্জি অডিট বাধ্যতামূলক করা জরুরি।
বাংলাদেশ এলপিজি অটোগ্যাস স্টেশন ও কনভার্সন ওয়ার্কশপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার মো. সিরাজুল মাওলা বলেন, দেশে প্রায় ২ হাজার ৩০০ এলপিজি অটোগ্যাস ফিলিং স্টেশন রয়েছে। এখানে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের উদ্যোগ নিলে ৭০০ থেকে ৮০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। এজন্য কার্যকর নীতিমালা প্রণয়ন অপরিহার্য। তিনি আরও বলেন, জ্বালানি খাতের বিভিন্ন সরকারি সংস্থা থেকে লাইসেন্স নিতে গিয়ে হয়রানির শিকার হতে হয়Ñ এ সমস্যার সমাধানে সরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন।
বিজিএমইএ সহসভাপতি বিদিয়া অমৃত খান বলেন, জাতীয় গ্রিডে নবায়নযোগ্য জ্বালানির অবদান মাত্র ৪ শতাংশ, যদিও বৈশ্বিক ক্রেতারা বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিচ্ছেন। খাতে নীতিসহায়তা কম। ভবন স্থাপনে গ্রিন ফান্ড থাকলেও নবায়নযোগ্য জ্বালানির ক্ষেত্রে সেটি নেই। এ ছাড়া জ্বালানি খাতে অর্থায়ন অত্যন্ত কঠিন বলে তিনি উল্লেখ করেন।
ইডকলের উপ-প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম মনিরুল ইসলাম বলেন, জ্বালানি খাতের বিদ্যমান নীতিমালার কার্যকর বাস্তবায়নে গ্যাপ রয়েছে, যা শিল্পখাতের সমস্যা কে ক্রমশ প্রকট করছে। এখাতে অর্থায়ন নিশ্চিতকল্পে গ্রীণ বন্ড প্রবর্তনের উপর তিনি জোরারোপ করেন। মুক্ত অলোচনায় ঢাকা চেম্বারের প্রাক্তন ঊর্ধ্বতন সহ-সভাপতি মালিক তালহা ইসমাইল বারী, প্রাক্তন পরিচালক এম বশিরউল্ল্যাহ ভূঁইয়্যা এবং সদস্য এম এস সিদ্দিকী অংশ নেন। ডিসিসিআই সহসভাপতি মো. সালিম সোলায়মানসহ পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা এবং সরকারি-বেসরকারি খাতের প্রতিনিধিরা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
প্রিন্ট করুন









Discussion about this post