আফসানা আক্তার সাথী : ২০২০ সালে আমার অনুজ প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়ে সবে মাধ্যমিকে পা রেখেছে। মাধ্যমিকের শুরুটা আমাদের সবার জন্যই ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ, চেনা পড়াশোনা আর বিষয়কে ছাড়িয়ে ভিন্ন বিষয় আর নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে স্বপ্ন দেখার সূচনাটা এখান থেকেই।
প্রাথমিক স্তর পর্যন্ত সাধারণত শিশুদের সব পড়াশোনা মা, শিক্ষক বা অন্য কাউকে গুছিয়ে দিতে হয়, মাধ্যমিকের শুরু থেকে তারা ধীরে ধীরে নিজেকে গুছিয়ে নিতে শিখতে থাকে… কিন্তু ২০২০ সালে যারা নতুন ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছে, তাদের আর কিছু গোছানো হয়নি বরং সে সময় গোটা পৃথিবীটাই এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল।
মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা— এর মতো এসে পরে অনলাইন ক্লাস নামক সম্পূর্ণ নতুন একটি শিক্ষাব্যবস্থা, কভিডকালে আমি যেই মাত্র আমার ভাইকে নানা ধরনের বই পড়ায় আগ্রহী করে তুলছিলাম তখনই শুরু হলো তাদের অনলাইন পড়াশোনা, পড়াশোনা কতটা এগিয়েছে; আমি জানি না কিন্তু শিশুদের মধ্যে ফোন আসক্তিটা পাকাপোক্ত হয়েছে এতটুকু বলতে পারি।
ষষ্ঠ শ্রেণির অনলাইন ক্লাসের ওপর ভিত্তি করে তাদের অটো প্রমোশন দিয়ে দেয়া হলো, কোনো রকম হাফ সিলেবাসে পরীক্ষা দিয়ে তারা পর্যায়ক্রমে সপ্তম এবং অষ্টম শ্রেণিও পাস করে ফেলল অথচ তাদের মধ্যে তিনটা ক্লাসের পড়াশোনার ভয়াবহ একটা ঘাটতি রয়েই গেল, যা নিয়ে শিশুদের অভিভাবক বা শিক্ষকদের মধ্যে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না।
পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মেলাতেই তাদের এমন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে; তবে এর সঙ্গে আরও কিছু নীতিমালার অবশ্যই প্রয়োজন ছিল।
বাংলাদেশের মতো একটা দেশে যেখানে সঠিক পেরেন্টিংয়ের যথেষ্ট অভাব থাকার পাশাপাশি সব মা-বাবা ফোন সম্পর্কে অভিজ্ঞ না তাদের সন্তানদের হাতে অপরিণত বয়সে ফোন তুলে দেয়া আর হাতে বুলেটভর্তি রিভলবার তুলে দেয়া একই কথা, যে কোনো সময় চাপ লেগে বুলেট বেরিয়ে যেতে পারে, যে বুলেট কারও প্রাণ না নিলেও একটা শিশুর সুন্দর ভবিষ্যৎ নিয়ে নিচ্ছে।
কভিডকালে শিশুদের এতটা ডিভাইস-মোবাইল নির্ভর করে দেয়া হলো যে, তা থেকে তারা আজও বের হতে পারছে না, যার দরুন আজ পড়াশোনায় শিক্ষার্থীদের মনোযোগ ধরে রাখতে শ্রেণিকক্ষে স্মার্টফোন, ট্যাব, স্মার্টওয়াচ নিষিদ্ধ করছে নেদারল্যান্ডসসহ বেশ কিছু দেশের সরকার।
উন্নত দেশের অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থা দেখে আমরা সেটির অনুকরণ করেছি কিন্তু আমরা কি পরিপূর্ণ অনুকরণ করতে পেরেছি!
সমাজবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সালমা আক্তার বলেন, বাইরের দেশে তরুণ কিশোররা শিক্ষা ক্ষেত্রে ইন্টারনেটকে প্রচুর ব্যবহার করছে। যেটি বাংলাদেশে পুরোপুরি উল্টো! প্রোডাক্টটিভ কিছু না করে তরুণরা যেমনটা অ্যান্টি সোশ্যাল কার্যক্রম করছে, তেমনি পরিবারের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ছে। শেষে গিয়ে তারই বড় বড় অপরাধে জড়াচ্ছে।
কভিডের অভিঘাত থেকে পড়াশোনাকে বাঁচাতে আমরা প্রজন্মের হাতে ফোন তুলে দিয়েছিলাম, সেই ফোনই আজ তাদের পড়াশোনা কেড়ে নিয়েছে, সে খবর কি আমরা রাখছি?
রক্ষকই যদি ভক্ষক হোন, তবে আমাদের উপায় কী?
বিটিআরসির সর্বশেষ তথ্য মতে, কভিড পরবর্তী বাংলাদেশে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রায় ৩৯ শতাংশ শিক্ষার্থী মোবাইল ফোনে আসক্ত। বর্তমানে মোবাইল গেমিংয়ে প্রতি বছর ১৯ শতাংশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর জাতিসংঘের শিশু তহবিল ইউনিসেফ বলছে, বাংলাদেশে ১০ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে ৩২ শতাংশই অনলাইন বিপদে আছে। এ সংস্থার তথ্য অনুসারে বিশ্বে প্রতি তিনজন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর একজন শিশু। আর প্রতিদিন ১ লাখ ৭৫ হাজার অর্থাৎ প্রতি আধা সেকেন্ডে একজন শিশু নতুন করে ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। স্মার্টফোনের মাধ্যমেই ভার্চুয়াল জগতে খুব সহজেই প্রবেশ করে শিশুরা। বিটিআরসির তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে শিশুদের প্রায় ৩ দশমিক ৫ শতাংশ নিয়মিত ইন্টারনেট ব্যবহার করে থাকে!
বাংলাদেশে শিশুদের অনলাইন নিরাপত্তা শীর্ষক সমীক্ষার অংশ হিসেবে স্কুল, কলেজ ও মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থার ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ১০ থেকে ১৭ বছর বয়সী ১ হাজার ২৮১ শিশুর ওপর একটি জরিপ চালানো হয়। সমীক্ষার ফলাফলে দেখা যায়, প্রায় ২৫ শতাংশ শিশু তাদের বয়স ১১ বছর হওয়ার আগেই ডিজিটাল বিশ্বে প্রবেশ করতে শুরু করে, পর্যাপ্ত পরিপক্বতার আগেই ভার্চুয়াল জগতে বিচরণের কারণে শিশুরা অধিক মাত্রায় সাইবার নিপীড়নের শিকার হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে।
এ থেকে বাঁচার কি কোনোই উপায় নেই? উপায় একটাই— ইন্টারনেটের নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার।
ক্রমবর্ধমান নেট-সংযুক্ত বিশ্বে এদেশের শিশু ও কিশোর-কিশোরীরা অনলাইনে যেসব ঝুঁকি ও বিপদের মুখোমুখি হয়, তা কমিয়ে আনতে ইউনিসেফের সহায়তায় সরকারের ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের আইসিটি বিভাগ ‘শিশুদের জন্য নিরাপদ ইন্টারনেট’ নামে একটি কোর্স চালু করেছে, যা সারাদেশের শিশুদের অনলাইনে নিরাপদে থাকার জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করতে সহায়তা করবে এবং সাফল্যজনকভাবে কোর্স সমাপ্তির পর সনদ প্রদান করবে।
তথ্য ও প্রযুক্তির এই দিনে কাউকেই পিছিয়ে রাখা যাবে না, শিশুদের নিরাপদভাবে প্রযুক্তি ব্যবহারের পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে।
এর জন্য অভিভাবকদের যা করণীয়—
ক. শিশুর ডিভাইসে সর্বশেষ হালনাগাদ, সফটওয়্যার ও অ্যান্টিভাইরাস প্রোগ্রাম চালু করে দিতে হবে; খ. প্রাইভেসি সেটিংস চালু করতে হবে; ৩. শিশুদের সঙ্গে মা-বাবার সম্পর্ককে আরও সহজ করতে হবে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে তার সঙ্গে ঘটা যে কোনো ঘটনা যেন মা-বাবার সঙ্গে শেয়ার করা যায় সে পরিস্থিতি তৈরি করতে হবে; ৪. অনলাইনে বিনামূল্যের সেবা নেয়া থেকে শিশুকে বিরত থাকা শেখাতে হবে; ৫. আপনার শিশুকে ভুল তথ্য এবং বয়স-অনুপযুক্ত সামগ্রী শনাক্ত করতে ও এড়িয়ে চলতে সহায়তা করুন; ৬. অনলাইনে উৎপীড়ন বা অনুপযুক্ত অনলাইন সামগ্রী সম্পর্কে অভিযোগ জানাতে স্কুলের নীতিমালা ও হেল্পলাইনের সঙ্গে নিজেকে পরিচিত করুন।
বর্তমান যুগ মিশ্র শিক্ষার যুগ। তাই কভিড-পরবর্তী সময়ের ৪০ শতাংশ পড়াশোনা অফলাইন গতানুগতিক পন্থায় দেয়া হলেও বাকি ৬০ শতাংশ ইন্টারনেটভিত্তিক শিক্ষা হবে। কভিড-পরবর্তী পৃথিবী অনলাইন শিক্ষাকেই অগ্রাধিকার দেবে। এই পরিবর্তন নিঃসন্দেহে দীর্ঘস্থায়ী হতে চলেছে।
তাই পরিমিত ইন্টারনেট ব্যবহারে আমাদের অভস্ত্যতা গড়ে তুলতে হবে।
শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়