Print Date & Time : 20 November 2025 Thursday 5:04 am

শীতের পিঠা: মানবিক সম্পর্কের পুনর্নির্মাণ ও সাংস্কৃতিক পুঁজির আবর্তন

ড. মতিউর রহমান : খাদ্য কেবল বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টির উৎস নয়। এর চেয়েও বহুগুণ বেশি গভীর ও বিস্তৃত এর ভূমিকা। সমাজবিজ্ঞানীদের চোখে, খাদ্য একটি ‘বস্তুগত প্রতীক’ (Material Symbol), যা একটি জাতির সাংস্কৃতিক পরিচয়, আবেগগত স্মৃতি এবং সমাজের জটিল কাঠামোর একটি জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। এটি আমাদের মূল্যবোধ, শ্রেণিবিন্যাস এবং গোষ্ঠীর সংহতিকে সংজ্ঞায়িত করে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, এই খাদ্য-সংস্কৃতির সবচেয়ে নান্দনিক ও গভীর সমাজতাত্ত্বিক প্রকাশ ঘটে শীতকালে পিঠার মাধ্যমে।

পিঠা নিছক মিষ্টি বা নোনতা খাবার নয়; এটি আমাদের সামাজিক জীবনের এক অপরিহার্য কালপঞ্জি-আবদ্ধ আচার (Chronologically Bounded Ritual)। প্রতি বছর শীতের আগমনে এই খাদ্য-আয়োজন পারিবারিক বন্ধন, সম্প্রদায়গত সংহতি এবং আন্তঃপ্রজন্মীয় স্মৃতিকে সচেতনভাবে পুনর্নির্মাণ করে। পিঠার এই গভীর সমাজতত্ত্ব বুঝতে হলে আমাদের দেখতে হবে কীভাবে এটি খাদ্য, সময়, শ্রম এবং সামাজিক পুঁজির মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে এবং কীভাবে আধুনিকতার চাপেও এই ঐতিহ্য তার গুরুত্ব ধরে রেখেছে।

ঋতুচক্র ও প্রাচুর্যের অর্থনীতি: কালচক্রের ধারণা ও সমষ্টিগত উদ্দীপনা

পিঠা তৈরির আয়োজন বাংলাদেশের শীতকালের আগমনীর প্রতীক, যা দেশের কৃষিভিত্তিক সমাজের নবান্নের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। নবান্ন মানে নতুন ধান কাটা— ফসলের প্রাচুর্য। এই প্রাচুর্য কেবল অর্থনৈতিক নয়, এটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিকও। নতুন ধানের চালের গুঁড়ো, টাটকা খেজুর গুড় এবং দুধ এই মৌলিক উপাদানগুলো সেই ঋতুভিত্তিক প্রাচুর্য এবং প্রকৃতির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। পিঠা তৈরির মাধ্যমে মানুষ প্রকৃতির আশীর্বাদকে উদযাপন করে এবং একাধারে নিজেদের শ্রমের সফলতাকেও স্বীকৃতি দেয়।

১.১. চক্রাকার সময় ও ঐতিহ্যের পুনর্জাগরণ

সমাজতাত্ত্বিকভাবে, পিঠা তৈরি আমাদের আধুনিক জীবনের রৈখিক সময় (Linear Time) ধারণা থেকে মুক্তি দিয়ে চক্রাকার ধারণায় (Cyclical Time) ফিরিয়ে নিয়ে আসে। আধুনিক জীবন যেখানে কঠোরভাবে কাজের চাপে বিভক্ত এবং প্রতিটি মুহূর্তকে উৎপাদনের নিরিখে মাপা হয়, সেখানে পিঠার প্রস্তুতি আমাদের ঐতিহ্যবাহী সময়ের ছন্দে ফিরিয়ে আনে। এই প্রক্রিয়াটি একটি সাংস্কৃতিক আচার (Cultural Ritual) হিসেবে কাজ করে, যখন পরিবারের সদস্যরা একত্রিত হয় এবং সময়ের হিসাব না করে ধীরগতিতে কাজ করে।

এই আচারের মধ্যে রয়েছে চাল ভেজানো, ঢেঁকিতে বা মেশিনে চাল গুঁড়ো করার শব্দ, আর গুড়ের মিষ্টি গন্ধে ম-ম করা রান্নাঘরের উষ্ণ পরিবেশ। এই ধ্বনি ও গন্ধগুলো বছরের পর বছর ধরে স্মৃতি বহন করে এবং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সেই স্মৃতি সঞ্চারিত করে। একটি বিশেষ ধরনের পিঠার স্বাদ সেই পুরোনো সম্পর্কের স্মৃতিকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারে, যা গভীর স্মৃতি  কাতরতা (Nostalgia) এবং তীব্র আবেগগত সংযোগ তৈরি করে।

১.২. ডুর্খেইমের সমষ্টিগত উদ্দীপনা

পিঠা তৈরির এই আচারগুলি সমাজবিজ্ঞানী এমিল ডুর্খেইমের ‘সমষ্টিগত উদ্দীপনা’ (Collective Effervescence)-এর জন্ম দেয়। শীতের শীতল রাতে যখন পরিবারের সদস্যরা চুলা বা উনুনের উষ্ণতাকে কেন্দ্র করে দলবদ্ধভাবে পিঠা তৈরির কাজে লিপ্ত থাকে, তখন তারা এক ধরনের সম্মিলিত আবেগিক উদ্দীপনা অনুভব করে। এই উদ্দীপনা তাদের ব্যক্তিগত পরিচয়কে ছাপিয়ে একটি বৃহত্তর গোষ্ঠীগত পরিচয়ে মিশে যেতে সাহায্য করে, যা তাদের সামাজিক বন্ধনকে দৃঢ় করে। ভাপা বা চিতই পিঠা সেঁকার সময় অপেক্ষা করা বা একসঙ্গে বসে নকশি পিঠা তৈরি করার দৃশ্যগুলোই সামাজিক সংহতির ভিত্তি রচনা করে। এই মুহূর্তগুলোতেই ব্যক্তিগত স্মৃতি সমষ্টিগত অভিজ্ঞতায় পরিণত হয়।

রান্নাঘরের সমাজবিজ্ঞান: লিঙ্গভিত্তিক শ্রম, যত্ন ও সাংস্কৃতিক পুঁজির আবর্তন

পিঠা তৈরির প্রক্রিয়াটি একটি সুস্পষ্ট সামাজিক ও লিঙ্গভিত্তিক শ্রম বিভাজন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এই শ্রম বিভাজন কেবল কার্যকারিতাই নিশ্চিত করে না, বরং পারিবারিক কাঠামোর মধ্যে ক্ষমতা, মর্যাদা এবং সাংস্কৃতিক পুঁজি কীভাবে আবর্তিত হয়, তা তুলে ধরে।

নারীর সাংস্কৃতিক পুঁজি: রেসিপির জীবন্ত গ্রন্থাগার ঐতিহ্যগতভাবে, পিঠা তৈরির প্রস্তুতি ও চূড়ান্ত রূপদানের দায়িত্ব বর্তায় বাড়ির নারী সদস্যদের ওপর। এই নারীরা হলেন পারিবারিক জ্ঞান ও ঐতিহ্যের জীবন্ত গ্রন্থাগার (Living Library of Family Knowledge)। তাদের দক্ষতা কেবল রান্নার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; তারা হলেন রেসিপির ধারক, যার মূল্য অর্থনৈতিক পুঁজির চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।

পিঠার সাংস্কৃতিক পুঁজি বলতে বোঝায় পিঠার জটিল রেসিপি (যেমন, পাটিসাপটার ক্ষীর তৈরি বা নকশি পিঠার সূক্ষ্ম কারুকার্য), সঠিক উপাদানের মান ও পরিমাণ এবং নিখুঁতভাবে পিঠা তৈরি করার কৌশল (যেমন- চিতই পিঠা ফোলানোর জন্য নির্দিষ্ট তাপ ও সময়ের জ্ঞান)। নারীরা এই সাংস্কৃতিক পুঁজি উত্তরাধিকার সূত্রে পান এবং তা পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে সঞ্চারিত করেন। এই জ্ঞান তাদের পারিবারিক কাঠামোর মধ্যে এক বিশেষ মর্যাদা ও গুরুত্ব প্রদান করে।

আবেগের সমাজতত্ত্ব: পিঠা এবং যত্নের শ্রম

পিঠা তৈরির এই প্রক্রিয়াটি আমেরিকান সমাজবিজ্ঞানী আর্লি হকশিল্ডের যত্নের সমাজবিজ্ঞান (Sociology of Care) তত্ত্বের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা যায়। পিঠা প্রস্তুত করা নারীদের জন্য কেবল একটি কাজ নয়, এটি আবেগগত শ্রম (Emotional Labor)-এর একটি প্রকাশ। এই খাদ্যের মাধ্যমে মহিলারা তাদের পরিবারকে যত্ন করার এবং তাদের মঙ্গল কামনা করার প্রতীকী ভাষা প্রকাশ করেন। একজন নারীর তৈরি করা সুস্বাদু ও নিপুণ পিঠা তার যত্নশীল সম্পর্ক, দক্ষতা এবং পারিবারিক প্রতিশ্রুতির পরিচায়ক। এই আবেগের আদান-প্রদান পারিবারিক মর্যাদা ও সম্পর্কের উষ্ণতার এক গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।

সম্মিলিত শ্রম ও পারিবারিক সংহতি

পুরুষ সদস্যদের কাজ হলো এই পিঠা তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় কাঠামোগত উপাদান (Structural Supplies) নিশ্চিত করা। এর মধ্যে রয়েছে জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ, নতুন গুড় বা টাটকা দুধ নিয়ে আসা এবং অনেক ক্ষেত্রে ঢেঁকি ছাঁটা চালের জোগান দেয়া। এই সম্মিলিত শ্রম বিভাজন কেবল কার্যকারিতাই নিশ্চিত করে না, বরং পুরো পরিবারের মধ্যে পারিবারিক সংহতি (Family Solidarity) নিশ্চিত করে। রান্নাঘরের অভ্যন্তরেই পারিবারিক সম্পর্ক এবং ভূমিকাগুলো পুনর্নির্ধারিত হয়। এই পারস্পরিক নির্ভরতা পারিবারিক বন্ধনকে আরও গভীর ও মজবুত করে তোলে।

সম্পর্কের অর্থনীতি: পিঠা, সামাজিক পুঁজি ও সামাজিক ঋণের আবর্তন

পিঠা কেবল পারিবারিক উৎসব নয়, এটি বৃহত্তর সামাজিক অঙ্গনে সামাজিক পুঁজি বিনির্মাণ এবং গোষ্ঠীর সংহতি বজায় রাখার একটি শক্তিশালী মাধ্যম।

পারস্পরিকতার নীতি ও সামাজিক ঋণ

পিঠা তৈরির পর তা আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের বাড়িতে বিতরণ করা হয়। এই বিতরণ প্রক্রিয়াটি নৃতত্ত্ববিদ মার্সেল মস (Marcel Mauss)-এর পারস্পরিকতা (Reciprocit) নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত। এই আদান-প্রদান এক ধরনের সামাজিক ঋণ (Social Debt) তৈরি করে। এই ঋণ অলিখিত এবং অনানুষ্ঠানিক, কিন্তু এর মূল্য অত্যন্ত গভীর। আজ পিঠা পাঠানোর মাধ্যমে যে ঋণ তৈরি হলো, ভবিষ্যতে তা হয়তো অন্য কোনো উপহার, খাবার, কিংবা বিপদের সময় সাহায্যের মাধ্যমে পরিশোধ করা হবে। এই বিনিময় একটি অদৃশ্য বন্ধন তৈরি করে যা সামাজিক নেটওয়ার্ককে দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা দেয়।

পিয়েরে বুর্দিউর ধারণায়, এই ধরনের উপহার বিনিময় সামাজিক পুঁজির সঞ্চয় ও বিনিয়োগ। এটি এমন একটি অ-আর্থিক সঞ্চয়, যা ভবিষ্যতে সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি বা অর্থনৈতিক সুবিধা লাভে (যেমন, চাকরির সুপারিশ বা সামাজিক সমর্থন) সহায়ক হতে পারে।

গোষ্ঠীর সীমানা ও সামাজিক পুঁজির প্রকারভেদ

পিঠা উৎসব বা পিঠা পার্টির আয়োজনের মাধ্যমে মানুষ সচেতনভাবে তাদের সামাজিক সীমানা নির্ধারণ করে। কাদের আমন্ত্রণ জানানো হলো, বা কাদের বাড়িতে বিশেষ যত্ন সহকারে পিঠা পাঠানো হলো, তার মাধ্যমে গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তির মানদ্ল (Criteria for Group Inclusion) এবং সামাজিক সম্পর্কের গুরুত্ব প্রকাশিত হয়। এই প্রক্রিয়ায় দুই ধরনের সামাজিক পুঁজি তৈরি হয়:

আবদ্ধকারী সামাজিক পুঁজি (Bonding Social Capital): এটি পরিবার, ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ও একই গোষ্ঠীর সদস্যদের মধ্যে বিশ্বাস ও সংহতি বাড়ায়। এটি গোষ্ঠীর অভ্যন্তরের সম্পর্ককে আরও গভীর করে।

সেতুবন্ধনকারী সামাজিক পুঁজি (Bridging Social Capital): এটি ভিন্ন পরিবার, পাড়ার মানুষজন বা কর্মক্ষেত্রের সহকর্মীদের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করে এবং সামাজিক নেটওয়ার্ককে প্রসারিত করে। পিঠা এইভাবে গোষ্ঠীর পরিচয়ের এক শক্তিশালী প্রতীক হয়ে ওঠে।

আধুনিকতা, বাণিজ্যিকীকরণ এবং সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের সংগ্রাম

আধুনিক শহুরে জীবনে পিঠা তার ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ ভূমিকা থেকে খানিকটা বিচ্যুত হয়েছে। নগরায়ণ, অর্থনৈতিক পুঁজির প্রভাব এবং দ্রুত পরিবর্তনশীল জীবনধারা পিঠার সমাজতত্ত্বে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

শহুরে পিঠা: নস্টালজিয়ার বাজার ও অর্থনৈতিক পুঁজির প্রভাব

একসময় যা ছিল গ্রামীণ নবান্নের ফসল, তা এখন শহুরে মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্তের কাছে সাংস্কৃতিক বিলাসিতা বা নস্টালজিক পণ্য। অর্থনৈতিক পুঁজির (Economic Capital) প্রভাবে পিঠা এখন আর কেবল বাড়ির ভেতরে তৈরি হয় না; এটি রেস্তোরাঁ, কফি শপ এবং অনলাইন প্ল্যাটফর্মে বিক্রি হয়। এই বাণিজ্যিকীকরণ (Commercialisation) পিঠাকে অর্থনৈতিক পণ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে। ফলে পিঠা প্রস্তুতকারক নারীদের শ্রমের আর্থিক স্বীকৃতি বেড়েছে, যা নারীদের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা (Entrepreneurs) হওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ তৈরি করেছে।

অপচয়মূলক ভোগ ও শ্রেণি বিভাজন

তবে এই আধুনিকতা চ্যালেঞ্জও তৈরি করেছে। শ্রমসাধ্য ঐতিহ্যবাহী প্রক্রিয়া আধুনিকতার চাপে হারিয়ে যাচ্ছে, যা ‘ফাস্ট ফুড’ (Fast Food) সংস্কৃতির বিপরীতে সময়ের প্রতীকী লড়াই। একইসঙ্গে, পিঠা বিতরণ বা উৎসব এখন প্রায়শই অর্থনৈতিক পুঁজি প্রদর্শনের মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। থর্স্টেন ভেবলেনের তত্ত্ব অনুসারে, জাঁকজমকপূর্ণ পিঠা পার্টি ‘অপচয়মূলক ভোগ’ (Conspicuous Consumption)-এর একটি রূপ হতে পারে। এখানে কার আয়োজন কতটা জাঁকজমকপূর্ণ বা কতটা বিরল ও ব্যয়বহুল গুড় ব্যবহার করা হলো, তা দিয়ে সামাজিক মর্যাদা পরিমাপ করা হয়। এই প্রবণতা পিঠার মূল উদ্দেশ্যকে কিছুটা ম্লান করে, যা ছিল সংহতি ও সরল বিনিময়।

আঞ্চলিক বৈচিত্র্য ও সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ

এই পরিবর্তন সত্ত্বেও, পিঠার মূল উদ্দেশ্য মানুষকে একত্রিত করা এবং সম্পর্ককে উষ্ণতা দেয়া এখনও বজায় আছে। বিভিন্ন অঞ্চলে পিঠার ভিন্নতা (যেমন- চিতই, ভাপা, পাটিসাপটা, নকশি পিঠা, পুলি) বাংলাদেশের আঞ্চলিক বৈচিত্র্য এবং সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদকে উদযাপন করে। একেক অঞ্চলের পিঠা তৈরির পদ্ধতি, উপাদান এবং পরিবেশন সেই অঞ্চলের সাংস্কৃতিক ইতিহাস এবং ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যকে তুলে ধরে।

যখন কোনো সমাজে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন বা দ্রুত আধুনিকায়ন ঐতিহ্যবাহী জীবনধারাকে হুমকি দেয়, তখন পিঠার মতো ঐতিহ্যবাহী খাবার আঁকড়ে ধরে মানুষ তাদের সাংস্কৃতিক স্বতন্ত্রতা (Cultural Distinctiveness) বজায় রাখে। এই চর্চাগুলো জাতীয় পরিচয়ের পুনর্নির্মাণে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পিঠা এই সংগ্রাম, স্মৃতি এবং সংহতির নীরব কিন্তু শক্তিশালী ঘোষণা।

পিঠার সমাজতত্ত্ব আমাদের শেখায় যে খাদ্য কেবল পুষ্টির উৎস নয়, এটি মানবিক সংযোগের এক জটিল এবং উষ্ণ মাধ্যম। শীতকালে যখন প্রকৃতি শীতল ও নির্জীব থাকে, তখন পিঠার আয়োজন সামাজিক সম্পর্কগুলোকে উষ্ণতা দেয়, পারিবারিক স্মৃতিগুলোকে জাগিয়ে তোলে এবং সম্প্রদায়কে পুনরায় সংহত করে।

পিঠা হলো সেই প্রতীক যা ঐতিহ্যবাহী সমাজের বাস্তব সংহতি (Mechanical Solidarity) (ঐক্য ও অভিন্নতাভিত্তিক সমাজ) এবং আধুনিক সমাজের জৈব সংহতি (Organic Solidarity) (পারস্পরিক নির্ভরশীলতাভিত্তিক সমাজ)-এর মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করে। আধুনিক জীবনের বিচ্ছিন্নতা এবং দ্রুতগতির মধ্যেও পিঠার এই আয়োজন আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, আমাদের মানবিকতা, পরিচয় এবং সংহতি ঐতিহ্যবাহী আচার-অনুষ্ঠানের গভীরে প্রোথিত।

পিঠার আয়োজন হলো বছরের সেই সময়, যখন সমাজ সচেতনভাবে তার নিজের দিকে ফিরে তাকায় এবং আগুন ও উষ্ণতার চারপাশে পুনরায় সংহত হয়। এই ক্ষুদ্র খাদ্যবস্তুটির মাধ্যমে একটি জাতি তার অতীতের প্রতি শ্রদ্ধা এবং ভবিষ্যতের প্রতি আশার বার্তা বহন করে। পিঠা এভাবে খাদ্য-সংস্কৃতির মাধ্যমে বাংলাদেশের মানবিকতা, পরিচয় এবং সংহতিকে রক্ষা করে চলেছে।

গবেষক ও উন্নয়নকর্মী