নুরুন্নাহার চৌধুরী কলি : শীতের শুরুতে দেশের বিভিন্ন এলাকায় বাড়ছে ঠান্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা। রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে বিশেষ করে শিশু ও বয়স্ক রোগীদের ভিড় বেড়েছে। ডায়রিয়া, সর্দিজ্বর, নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্ট ও অ্যাজমাজনিত জটিলতা নিয়ে রোগীরা বেশি আসছেন বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা।
জানা গেছে, গত কয়েক দিনে শীতের তাপমাত্রা দ্রুত কমে যাওয়ায় হঠাৎই বেড়েছে এসব রোগের উপসর্গ। রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালেও জরুরি বিভাগে রোগীর চাপ আগের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। চিকিৎসকদের মতে, দিনে রোদ থাকলেও ভোর ও রাতের দিকে তাপমাত্রা নিচে নামছে, যা শিশু ও বয়স্কদের জন্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।
চিকিৎসকরা জানান, শীতকালে বিভিন্ন ধরনের ভাইরাস, যেমন-ইনফ্লুয়েঞ্জা, অ্যাডিনোভাইরাস, রাইনোভাইরাস ইত্যাদি ভাইরাস জ্বর শিশুদের রোগের জন্য দায়ী। শীতে অ্যাজমা বেড়ে যায়। বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ কমে, বাড়ে ধুলার পরিমাণ। এতে শ্বাসকষ্ট বাড়ে। চিকিৎসকেরা পরামর্শ দিয়েছেন-গরম কাপড় ব্যবহার, গরম পানি পান, ধুলাবালু ও কুয়াশায় বাইরে বের হলে মাস্ক ব্যবহার, এবং সর্দিজ্বর দেখা দিলে দেরি না করে চিকিৎসা নেয়ার জন্য।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শীতের শুরুতে সতর্কতা অবলম্বন না করলে এসব রোগ আরও ছড়াতে পারে। বিশেষ করে শিশু, বয়স্ক, হাঁপানি রোগী এবং দুর্বল ইমিউনিটির মানুষদের অতিরিক্ত সাবধানতার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
রাজধানীর মুগদা জেনারেল হাসপাতালের এক রোগী শেয়ার বিজকে বলেন, ‘গত দুই দিন ধরে জ্বর আর কাশি বাড়ছে। মুগদায় এসেছি, কিন্তু এখানে এত ভিড় যে ডাক্তারের দেখা পেতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হচ্ছে।’
শিশু হাসপাতালে জরুরি বিভাগের এক চিকিৎসক বলেন, ‘ভোরবেলা ঠান্ডা আবহাওয়ার কারণে অনেক শিশু শ্বাসকষ্ট ও কাশি নিয়ে ভর্তি হচ্ছে। অনেকে সময়মতো যথেষ্ট গরম কাপড় ব্যবহার না করায় জটিলতা বাড়ছে।’ একই অবস্থা দেশের উত্তরাঞ্চলেও দেখা গেছে। রংপুর, দিনাজপুর ও কুড়িগ্রাম থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, সেখানে ঠান্ডা ও ঘন কুয়াশার কারণে শ্বাসতন্ত্রের রোগ বাড়ছে।
এদিকে দেশে ডেঙ্গু সংক্রমণও ভয়াবহ আকার ধারণ। চলতি বছরের এ পর্যন্ত ৩৬৬ জনের প্রাণ গেল এইডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গুতে। এছাড়া হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯০ হাজার ৯৬৯ জনে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি নভেম্বর মাসের এ পর্যন্ত মশাবাহিত রোগটিতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন ৮৮ জন, যা এ বছরের কোনো মাসে সর্বোচ্চ। আর চলতি মাসের এ পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২১ হাজার ১০৭ জন। এর আগে সবচেয়ে বেশি ৮০ জনের মৃত্যু হয়েছে অক্টোবর মাসে। আর ৭৬ জনের মৃত্যু হয়েছে সেপ্টেম্বর মাসে।
ডেঙ্গুতে আক্রান্তদের মধ্যে জুলাই মাসে ৪১ জনের মৃত্যু হয়েছিল। এ ছাড়া জানুয়ারিতে ১০ জন, ফেব্রুয়ারিতে তিনজন, এপ্রিলে সাতজন, মে মাসে তিনজন, জুনে ১৯ জন, অগাস্টে ৩৯ জন মারা যান। মার্চ মাসে কোনো রোগীর মৃত্যু হয়নি।
জানুয়ারিতে ১১৬১ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩৭৪ জন, মার্চে ৩৩৬ জন, এপ্রিলে ৭০১ জন, মে মাসে ১৭৭৩ জন, এ ছাড়া জুন মাসে ৫৯৫১ জন, অগাস্টে ১০ হাজার ৪৯৬ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন। সেপ্টেম্বরে ১৫ হাজার ৮৬৬ জন এবং অক্টোবরে ২২ হাজার ৫২০ জন হাসপাতালে ভর্তি হন।
দেশের খ্যাতিমান মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, ‘একসময় ডেঙ্গুকে বর্ষার রোগ ভাবা হলেও এখন সারা বছরই রোগী পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু এ রোগ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর কোনো বড় উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। শহর থেকে গ্রামে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে ডেঙ্গু, মৃত্যুও বাড়ছে। প্রশাসনের উদাসীনতা যেমন আছে, তেমনি জনগণের মধ্যেও সচেতনতার ঘাটতি রয়েছে। ঘর থেকেই সচেতনতা শুরু করতে হবে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে গণটিকা প্রয়োজন ছিল, কিন্তু তা এখনও আসেনি।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, ‘এবার নভেম্বরেও ডেঙ্গুর দাপট চলছে। গত বছরের তুলনায় এ বছর মশার ঘনত্ব বেশি, রোগীও বেশি।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ও মৃত্যুর তথ্য রাখে ২০০০ সাল থেকে। এর মধ্যে ২০২৩ সালে এ রোগ নিয়ে সবচেয়ে বেশি ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সবচেয়ে বেশি ১ হাজার ৭০৫ জনের মৃত্যুও হয় ওই বছর।
প্রিন্ট করুন





Discussion about this post