শেয়ার বিজ ডেস্ক : মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ৫০ শতাংশ শুল্কের চাপে দিশাহারা হয়ে পড়েছেন ভারতীয় ব্যবসায়ীরা। যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করা ভারতীয় পণ্যে মোট ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে। ট্রাম্পের ঘোষিত মোট ৫০ শতাংশ শুল্ক ২৭ আগস্ট থেকে কার্যকর হচ্ছে। এতে ভারতের অর্থনীতির বড় একটা অংশ ভয়াবহ এক পরিস্থিতিতে পড়েছে। গতকাল মঙ্গলবার এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি।
মূলত শুল্কের চাপে ভারতীয় শিল্পকারখানাগুলো কার্যত ধুঁকছে এবং শ্রমিকদের বেতন দেয়া নিয়েও সংশয়ের মুখে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা।
সংবাদমাধ্যমটি বলছে, তামিলনাডুর তিরুপ্পুরের একটি তৈরি পোশাক কারখানায় অস্বাভাবিক নীরবতা। ভারতের অন্যতম বৃহৎ টেক্সটাইল রপ্তানি কেন্দ্র এই শহরে একসময় গমগম করত সেলাই মেশিনের শব্দ। কিন্তু কৃষ্ণমূর্তির কারখানায় এখন ২০০টির মধ্যে সামান্য কিছু মেশিনই চালু আছে। মার্কিন বাজারে শিশুদের পোশাকের শেষ অর্ডারগুলো সম্পন্ন করছেন শ্রমিকরা।
কোনায় পড়ে থাকা নতুন ডিজাইনের কাপড়ের নমুনাগুলোয় জমেছে ধুলো। কারণ আজ বুধবার থেকে কার্যকর হতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আরোপিত ৫০ শতাংশ শুল্ক, যা ভারতের রপ্তানির জন্য বড় ধাক্কা।
ভারত যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক, চিংড়ি, রতœ ও গয়নার বড় রপ্তানিকারক। বাণিজ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুল্কের এই মাত্রা কার্যত ভারতীয় পণ্যের ওপর এক ধরনের নিষেধাজ্ঞার মতো। এর সঙ্গে রাশিয়ার তেল ও অস্ত্র কেনায় আরও ২৫ শতাংশ শাস্তিমূলক শুল্ক যুক্ত হয়েছে। তিরুপ্পুর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ালমার্ট, টার্গেট, গ্যাপ ও জারার মতো ব্র্যান্ডে বছরে প্রায় ১৬ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়, যা ভারতের মোট রপ্তানির এক-তৃতীয়াংশ। সেখানে এখন গভীর উদ্বেগ।
বিবিসিকে কৃষ্ণমূর্তি নামে এক ব্যক্তি বললেন, ‘সেপ্টেম্বরের পর থেকে হয়তো করার মতো কিছুই থাকবে না।’ অর্ডার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তিনি সম্প্রসারণ পরিকল্পনা বাতিল করতে বাধ্য হয়েছেন এবং স¤প্রতি নিয়োগ দেয়া ২৫০ শ্রমিককে বসিয়ে রাখতে হয়েছে।
শুল্ক ঘোষণার সময়টিও রপ্তানিকারকদের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর হয়েছে। কারণ বছরের প্রায় অর্ধেক বিক্রিই হয় বড়দিনকে ঘিরে এই মৌসুমে। এখন তারা ভরসা করছেন স্থানীয় বাজার ও আসন্ন দীপাবলি মৌসুমের ওপর। অন্য এক অন্তর্বাস প্রস্তুতকারকের কারখানায় প্রায় ১০ লাখ ডলারের পণ্য মজুত পড়ে আছে, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে নেয়ার মতো ক্রেতা নেই। রাফট গার্মেন্টসের মালিক শিব সুব্রামানিয়াম বললেন, ‘আমরা আশা করেছিলাম, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যচুক্তি হবে। গত মাস থেকে পুরো উৎপাদন বন্ধ হয়ে আছে। এভাবে চলতে থাকলে শ্রমিকদের বেতন দেব কীভাবে?’
৫০ শতাংশ শুল্কের কারণে যুক্তরাষ্ট্রে ১০ ডলারের ভারতীয় শার্ট এখন বিক্রি হবে ১৬ দশমিক ৪ ডলারে। অথচ একই পণ্য চীন থেকে পাওয়া যায় ১৪ দশমিক ২, বাংলাদেশ থেকে ১৩ দশমিক ২ আর ভিয়েতনাম থেকে ১২ ডলারে। এমনকি শুল্ক ২৫ শতাংশে নেমে এলেও ভারত প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে থাকবে।
ক্ষতি কিছুটা সামলাতে ভারত সরকার কাঁচামালের আমদানি শুল্ক প্রত্যাহারসহ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। বিকল্প বাজার খুঁজতে অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাণিজ্য আলোচনাও জোরদার হয়েছে। তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, পদক্ষেপগুলো অনেক দেরিতে এসেছে। গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভের অজয় শ্রীবাস্তব বললেন, ‘আমরা বাণিজ্য মোড় ঘুরতে দেখব। মার্কিন ক্রেতারা চলে যাবে মেক্সিকো, ভিয়েতনাম কিংবা বাংলাদেশে।’
এদিকে মুম্বাইয়ের রপ্তানি অঞ্চলে শত শত শ্রমিক হীরার পাথর মসৃণ ও প্যাকেজিং করছেন। ভারতের ১০ বিলিয়ন ডলারের রতœ ও গয়না রপ্তানির বড় অংশই যুক্তরাষ্ট্রে যায়। সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে তিন-চার বিলিয়ন ডলারের গয়না সেখানে পাঠানো হয়। কিন্তু শুল্ক আরোপের জেরে বিক্রি কমে যাওয়ার শঙ্কায় রয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
ক্রিয়েশন জুয়েলারির আদিল কোটওয়াল, যার ৯০ শতাংশ হীরা জড়ানো গয়না মার্কিন বাজারে বিক্রি হয়, তিনি বললেন, ‘আমাদের লাভের হার মাত্র তিন-চার শতাংশ। ১০ শতাংশ বাড়তি শুল্কও আমরা বহন করতে পারব না। এমনকি মার্কিন খুচরা বিক্রেতারাও তা টিকিয়ে রাখতে পারবে না।’
হীরা আসে গুজরাটের সুরাট থেকে। কিন্তু সেখানকার কারখানাগুলো আগেই সংকটে ছিল চাহিদা কমে যাওয়া আর ল্যাব-গ্রো করা হীরার প্রতিযোগিতায়। এবার শুল্ক পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে।
প্রায় ৫০ লাখ মানুষের জীবিকা নির্ভরশীল এই শিল্পে এখন মাসে গড়ে মাত্র ১৫ দিন কাজ হচ্ছে। অনেক চুক্তিভিত্তিক শ্রমিককে অনির্দিষ্টকালের ছুটিতে পাঠানো হয়েছে। সুরাটের এক কারখানা মালিক শৈলেশ মাঙ্গুকিয়া বললেন, আগে ৩০০ শ্রমিক ছিল, এখন মাত্র ৭০ জন। মাসে যেখানে দুই হাজার হীরা মসৃণ করা হতো, এখন নেমে এসেছে ৩০০টিতে।
স্থানীয় ট্রেড ইউনিয়ন নেতা ভবেশ ট্যাঙ্ক বললেন, ‘শ্রমিকদের আয় কমছে, অনিচ্ছাকৃত ছুটি বাড়ছে, মাসিক বেতন ক্রমেই কমছে।’
ভারতের চিংড়ি খামারিরাও বড় ক্ষতির মুখে। বিশ্বের অন্যতম বড় চিংড়ি রপ্তানিকারক দেশ ভারত। যুক্তরাষ্ট্র এর প্রধান বাজার। নতুন শুল্কের কারণে এ খাতে মোট শুল্ক ৬০ শতাংশের বেশি হবে। দামও কমেছে কেজিতে ৬০-৭২ সেন্ট। আরও কমতে পারে।
দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য অন্ধ্র প্রদেশের এক রপ্তানিকারক ঠোটা জগদীশ বললেন, ‘এটা আমাদের মৌসুম। মার্কিন ক্রেতারা বড়দিন ও নববর্ষের প্রস্তুতি নেয় এ সময়ে। কিন্তু শুল্কের কারণে আমরা কিছুই সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না।’
অনেক হ্যাচারি উৎপাদনও কমিয়ে দিয়েছে। ভীরাবাসারামের এমএস বর্মা বললেন, ‘আগে আমরা বছরে ১০ কোটি লার্ভা উৎপাদন করতাম। এখন ৬-৭ কোটি ছুঁতেও পারছি না।’
এমন অবস্থায় এ খাতে সরাসরি পাঁচ লাখ ও পরোক্ষভাবে ২৫ লাখ মানুষের জীবিকা হুমকিতে পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। সেটিও আবার এমন সময়ে যখন ভারতে কর্মসংস্থানের সংকট গভীর। আর তাই এই পরিস্থিতি উদ্বেগ আরও বাড়িয়েছে।
মূলত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের অচলাবস্থা এখনও কাটেনি। বরং সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোয় আলোচনার পরিবেশ আরও খারাপ হয়েছে। দিল্লিতে নির্ধারিত নতুন বাণিজ্য আলোচনা বাতিল হয়েছে। মার্কিন কর্মকর্তারা ভারতকে ‘চীনের ঘনিষ্ঠ’ ও ‘রাশিয়ার মানি লন্ডারিংয়ের জায়গা’ বলে কটাক্ষ করেছেন।
এশিয়া গ্রুপ অ্যাডভাইজরির গোপাল নাদ্দুর বললেন, ‘ভারত-যুক্তরাষ্ট্র আলোচনার ভবিষ্যৎ এখন অনেকটাই নির্ভর করছে ট্রাম্প প্রশাসনের অগ্রাধিকারের ওপর, যার মধ্যে ঘরোয়া রাজনীতি ছাড়াও রাশিয়া ও চীনের সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ।’
তিনি আরও বলছেন, ‘ভারতের নীতিনির্ধারক ও ব্যবসায়ীদের জন্য এখন মন্ত্র একটাইÑআত্মনির্ভরতা বাড়াও, বাজার বৈচিত্র্য করো এবং কোনো সুযোগ হাতছাড়া করো না।’
এদেকে যুক্তরাষ্ট্র জানিয়েছে, এখনো রাশিয়া থেকে ভারতের তেল আমদানি করে যাওয়ার বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য উদ্বেগজনক। ট্রাম্প প্রশাসনের দাবি, যেসব দেশ রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক রেখেছে, তাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করাটাই হলো এই সিদ্ধান্তের মূল লক্ষ্য।
চলতি বছরের আগস্টের শুরুতে ট্রাম্প ভারতীয় পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক হার আরোপ করেছিলেন, পরে তা আরও বাড়ানো হয়। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপকে অনুপযুক্ত, উসকানিমূলক ও অযৌক্তিক বলেছে।

Discussion about this post