নূর হামজা পিয়াস : বাংলাদেশের মোট রপ্তানির প্রায় ৮০ শতাংশ আসে এই এক খাত থেকে, আর এতে সরাসরি যুক্ত প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক, যাদের অধিকাংশই নারী। এই বিশাল শিল্প শুধু রপ্তানির ওপর নির্ভরশীল নয়, বরং গ্রামীণ অর্থনীতিতে স্থায়ী আয়ের ক্ষেত্র তৈরি করে কোটি মানুষের জীবনযাত্রাকে স্থিতিশীল রাখে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে একের পর এক ধাক্কায় এই খাত যেন অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে লিপ্ত। রপ্তানি কমছে, নতুন অর্ডার আসার হার কমে গেছে, বাতিল হচ্ছে আগের অর্ডারও। অনেক কারখানা উৎপাদন সংকোচন করছে, অনেকগুলো আবার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এর এই ধস নামা পরিস্থিতির ছায়া শুধু শিল্পেই নয়, বরং পুরো জাতীয় অর্থনীতিতে অস্বস্তির ঢেউ তুলছে।
সংকটের প্রথম বড় আঘাত এসেছে বৈশ্বিক বাজারের অনিশ্চয়তা থেকে। যুক্তরাষ্ট্রে নতুন প্রশাসনের অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ ও অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতার নীতির কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে বড় পরিবর্তন দেখা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে শুল্কবাধা বাড়ায় চীন ইউরোপীয় বাজারে প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা করছে, আর তার সরাসরি চাপ পড়ছে বাংলাদেশের ঐতিহ্যগত বাজারে। ফলে আন্তর্জাতিক ক্রেতারা এখন আরও কম দামে পণ্য চাইছেন, অথচ উৎপাদন খরচ বাড়ছে শ্রমমূল্য, গ্যাস-বিদ্যুতের দাম ও কাঁচামালের ব্যয় বৃদ্ধির কারণে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অস্থিরতার আশঙ্কা, যা অনেক ক্রেতাকে অর্ডার কমিয়ে আনতে বাধ্য করেছে। এই দ্বিমুখী চাপ বাংলাদেশের পোশাকশিল্পকে আরও দুর্বল অবস্থায় ঠেলে দিচ্ছে।
সংকটের আরও গভীরে আছে অবকাঠামোগত ত্রুটি। সম্প্রতি হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে শতকোটি টাকার কাঁচামাল, পোশাকপণ্য ও রপ্তানির চালান পুড়ে গেছে। এতে প্রায় ২৫০ কারখানার অর্ডার ঝুঁকিতে পড়েছে এবং আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের মাঝে অনাস্থা তৈরি হয়েছে।
ব্যাংক খাতের অস্থিরতা এখন তৈরি পোশাকশিল্পের প্রধান অন্তরায়। বিভিন্ন ব্যাংক রপ্তানিকারকরা এলসি খুলতে পারছে না, ডলারের সংকট এতটাই তীব্র যে কাঁচামাল আমদানিতে অনেক প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন স্থবির হয়ে পড়েছে। শ্রমিকদের বেতন দেয়ার টাকা আটকে যাচ্ছে এবং কিছু ব্যাংক কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে এক্সিম ব্যাংক ও এসআইবিএলসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান তারল্য সংকটে টালমাটাল। ব্যাংক খাতের এই দুরবস্থা মূলত গত এক দশকে গঠিত লুটপাট-নির্ভর দুর্বল শাসনব্যবস্থার ফল, যার প্রতিক্রিয়া এখন বুমেরাং হয়ে উৎপাদনমুখী শিল্পে আঘাত হানছে।
আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের পক্ষ থেকে পরিবেশগত, সামাজিক ও শাসনব্যবস্থা-সংক্রান্ত মানদণ্ড মেনে চলার চাপ বর্তমানে শিল্প খাতে মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। বিশেষ করে ইউরোপীয় ক্রেতারা এখন আরও বেশি সবুজ কারখানা (লিড সার্টিফায়েড), শূন্য নির্গমন সনদ এবং নৈতিক শ্রম অনুশীলন দাবি করছেন। যদিও বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বে সর্বোচ্চ সংখ্যক সবুজ কারখানার অধিকারী, কিন্তু এই কমপ্লায়েন্স বজায় রাখার খরচ ছোট ও মাঝারি উদ্যোগগুলোর জন্য অত্যন্ত বেশি। ক্রেতারা দাম কমালেও এই কমপ্লায়েন্স খরচ কমাতে পারে না। বাংলাদেশের পোশাকশিল্প নারীর কর্মসংস্থানের সবচেয়ে বড় ক্ষেত্র। লাখ লাখ নারী শ্রমিকের আয়ের ওপর দাঁড়িয়ে আছে তাদের পরিবার, সন্তানদের শিক্ষা, চিকিৎসা ও খাবারের নিশ্চয়তা। কারখানা বন্ধ হওয়া বা উৎপাদন সংকোচনের কারণে যেসব নারী চাকরি হারাচ্ছেন, তাদের জীবনে ফিরে আসছে অনিশ্চয়তা। নারীশক্তির অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তিতে এই ধস ভবিষ্যতে সামাজিক স্থিতিশীলতাকেও বিপর্যস্ত করতে পারে। গবেষণা বলছে, নারী শ্রমিকের আয় কমলে পারিবারিক সহিংসতা ও দারিদ্র্যের হার বেড়ে যায়। তাই এ সংকট কেবল শিল্পের নয়, সমাজেরও।
সম্প্রতি সরকার কর্তৃক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধি একটি মানবিক ও প্রশংসনীয় পদক্ষেপ হলেও শিল্পের ওপর এর অর্থনৈতিক চাপ বিরাট। মালিকদের উৎপাদন ব্যয় রাতারাতি বহুলাংশে বেড়ে গেছে। আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে এই বর্ধিত ব্যয়কে মেটাতে হবে উচ্চতর উৎপাদনশীলতা এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়নের মাধ্যমে। দুঃখের বিষয় হলো, শ্রমিকের দক্ষতা উন্নয়ন ও প্রশিক্ষণে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ না হওয়ায় মজুরি বাড়লেও উৎপাদনশীলতার হার সেভাবে বাড়েনি। ফলে এককপ্রতি উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় ক্রেতারা অন্য দেশে ঝুঁকছেন।
তৈরি পোশাক রপ্তানি কমলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বর্তমানে বাংলাদেশের রিজার্ভ বহু বছরের নিম্নস্তরে নেমে এসেছে এবং এতে আমদানি খরচ, শিল্প কাঁচামাল, খাদ্যসামগ্রী ও জ্বালানি আমদানিতে চাপ বাড়ছে। যদি আগামী ছয় মাস রপ্তানি পুনরুদ্ধার না হয়, তবে বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি আরও বাড়বে। এতে ব্যাংকগুলোয় ডলারের লেনদেন আরও জটিল হবে, আর তা পুরো আর্থিক খাতকে আরও দুর্বল করবে। অর্থনীতির এই শৃঙ্খল প্রতিক্রিয়া থামাতে হলে দ্রুত রপ্তানি পুনরুদ্ধারই মূল চাবিকাঠি।
তৈরি পোশাক খাতে দীর্ঘদিনের মানবশ্রম-নির্ভরতার কারণে প্রযুক্তির ব্যবহার ও স্বয়ংক্রিয়তা এখনও দুর্বল অবস্থায় রয়েছে। উন্নত বিশ্বে যেখানে রোবোটিক্স ও আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) ব্যবহার করে দ্রুত উৎপাদন ও নির্ভুল মান নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশের অধিকাংশ কারখানায় এখনও পুরোনো যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয়। এই প্রযুক্তিগত পশ্চাৎপদতার ফলে পণ্যের গুণগত মান, উৎপাদনশীলতা এবং দ্রুত বাজারের চাহিদা মেটানোর সক্ষমতা কমে যাচ্ছে। এই খাতে নতুন করে প্রযুক্তিগত বিনিয়োগ করার জন্য মালিকদের কাছে ডলারের অভাব এবং ব্যাংকঋণের উচ্চ সুদহার একটি বড় বাধা।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের মূল সমস্যা হলো এখনও তুলনামূলকভাবে কম দামের (Low-value) সুতির পোশাকের, যেমন টি-শার্ট ও সাধারণ জিন্সের ওপর অতিনির্ভরশীলতা। অথচ বিশ্ববাজারে এখন ফ্যাশন ট্রেন্ড পরিবর্তিত হচ্ছে; কৃত্রিম তন্তু বা ম্যান-মেড ফাইবার (MMF) ভিত্তিক, জটিল ডিজাইনের এবং টেকনিক্যাল পোশাকের চাহিদা বাড়ছে। MMF পোশাকের বাজার তুলার পোশাকের বাজারের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি। কিন্তু বাংলাদেশে MMF উৎপাদনে সক্ষমতার অভাব এবং দক্ষ ডিজাইনারের ঘাটতি থাকায় আমরা উচ্চমূল্যের এই বাজারে প্রবেশ করতে পারছি না। এর ফলে প্রতি ইউনিটে আমাদের গড় রপ্তানি মূল্য তুলনামূলকভাবে কম থাকে, যা বর্তমান সংকটে মুনাফার মার্জিনকে আরও সংকুচিত করছে এবং দীর্ঘ মেয়াদে শিল্পকে দুর্বল করে রাখছে।
আন্তর্জাতিক ক্রেতারা এখন আগের মতো আত্মবিশ্বাস নিয়ে বাংলাদেশে বিনিয়োগ বা অর্ডার দিচ্ছেন না। প্রথমত, সরবরাহব্যবস্থার দুর্বলতা; দ্বিতীয়ত, ব্যাংক খাতের তারল্য সংকট; এবং তৃতীয়ত, রাজনৈতিক অস্থিরতার সম্ভাবনা তাদের অর্ডার দেয়ার সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলছে। এর ফলে অনেক ক্রেতা ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, ভারত বা তুরস্কের দিকে ঝুঁকছেন। এই আস্থা ফিরিয়ে আনা এখন সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ, কারণ একবার বাজার হারালে তা পুনরুদ্ধার করা কঠিন হয়ে যায়।
এ পরিস্থিতি থেকে বের হতে হলে নীতিনির্ধারকদের দ্রুত বাস্তবভিত্তিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। প্রথমত, রপ্তানিমুখী শিল্পের জন্য বিশেষ ডলার উইন্ডো চালু করে কাঁচামাল আমদানি নিশ্চিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, সংকটে থাকা ব্যাংকগুলোর জন্য পুনঃঅর্থায়ন সুবিধা বাড়াতে হবে, যাতে শ্রমিকদের বেতন ও উৎপাদন ব্যয় নির্বিঘ্নে প্রদান করা যায়। তৃতীয়ত, পণ্য পরিবহন ও কার্গো ব্যবস্থাপনায় আধুনিকায়ন অপরিহার্য আগুন, ক্ষতি বা বিলম্ব যেন আর কোনোভাবে রপ্তানিকে ব্যাহত না করে।
পোশাকশিল্প এমন একটি খাত, যেখানে মালিক, শ্রমিক ও সরকারের ত্রিপক্ষীয় বোঝাপড়া অপরিহার্য। মজুরি কাঠামো, উৎপাদন ব্যয়, আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা—এসব বিষয়ে পারস্পরিক সহযোগিতা ছাড়া কোনো সমাধান কার্যকর হবে না। বর্তমানে শ্রমিকদের দাবি, মালিকদের সংকট ও সরকারের নীতিগত চাপে একটি অস্থির পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এখনই প্রয়োজন আস্থাভাজন সংলাপ ও বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ, যাতে সবাই সমানভাবে লাভবান হয় এবং শিল্প আবার ঘুরে দাঁড়ায়।
বাংলাদেশের পোশাক খাত বহু বছর ধরে বৈশ্বিক বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে আছে মূলত সাশ্রয়ী খরচ, দক্ষ শ্রমশক্তি ও সময়মতো সরবরাহের ওপর ভর করে। কিন্তু অবকাঠামো উন্নয়ন, ব্যাংক খাত সংস্কার, দক্ষতা বৃদ্ধি ও প্রযুক্তিনির্ভর উৎপাদনে যথাযথ বিনিয়োগ না হলে এই প্রতিযোগিতা ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। বিশ্ববাজারে এখন মূল্য নয়, গুণগত মান, স্থায়িত্ব ও সবুজ উৎপাদনই মূল বিষয়। এই বাস্তবতায় বাংলাদেশকে দ্রুত নতুন রূপে এগোতে হবে।
বাংলাদেশের পোশাকশিল্প এক দিনে তৈরি হয়নি, এটি চার দশকের সংগ্রাম ও শ্রমিকের ঘামের ফসল। এর পতন মানে কেবল অর্ডার হারানো নয়, হারাতে হবে লাখো নারীর আয়, দেশের বৈদেশিক মুদ্রা, ব্যাংকিং ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা ও অর্থনীতির সবচেয়ে শক্তিশালী ভিত্তি। তাই এখনই সময় সরকার, মালিক, শ্রমিক এবং নীতিনির্ধারকদের একসঙ্গে বসে সামনে এগোনোর রূপরেখা তৈরি করার। সময় নষ্ট হলে শুধু কারখানা নয়, হারিয়ে যাবে ভবিষ্যতের উন্নয়নের স্বপ্নও।
শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ
ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ
