অশোক দত্ত : বাংলাদেশি রপ্তানি পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত পাল্টা শুল্ক কমাতে আমদানির ওপর জোর দিচ্ছে সরকার। প্রায় ৬০০ কোটি ডলারের দ্বিপক্ষীয় ঘাটতি মোকাবিলায় এবার প্রথমবারের মতো সরকারিভাবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে গম আমদানির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
সেই লক্ষ্যে গত ২০ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গম রপ্তানিকারক সংগঠন ইউএস হুইট অ্যাসোসিয়েশনসের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই করে খাদ্য অধিদপ্তর।
পরে গত ২৩ জুলাই সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ টনপ্রতি ৩০২ দশমিক ৭৫ ডলার দামে দুই লাখ ২০ হাজার টন গম আমদানির অনুমোদন দেয়। অক্টোবরের মধ্যে এই চালান দেশে আসার কথা রয়েছে।
বাংলাদেশ সর্বশেষ ২০১৯-২০ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সবচেয়ে বেশি গম আমদানি করেছিল, সাড়ে চার লাখ টন। দীর্ঘ বিরতির পর এবার আবার বড় আকারে আমদানির এই পদক্ষেপকে কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে।
বাড়তি দামে গম আমদানি প্রসঙ্গে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ শেয়ার বিজকে বলেন, আমদানি মূল্য তুলনামূলকভাবে কিছুটা বেশি হলেও মানটা অনেক ভালো। আমরা ট্যারিফ অ্যাভোয়েড করতে চাচ্ছি, ঘাটতি কমাতে চাচ্ছি তাতে; কিছুটা তো বেশি লাগবেই।
শুল্ক কতটা কমতে পারেÑএমন প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা বলেন, এটা হিসাব করব পরে। তবে কিছুটা গম আনতে হবে। এর ফলে শুল্ক আরও কিছুটা কমবে।
আরেক প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা বলেন, খাদ্য পরিস্থিতি কতটা কাভার করবে, সেটা বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলতে পারবে। এতে ভোক্তাদের ওপর কোনো প্রভাব পড়বে না।
নতুন চুক্তির আওতায় আগামী পাঁচ বছরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে বছরওয়ারি প্রায় সাত লাখ টন উচ্চমানের গম আমদানি করবে সরকার।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই আমদানি শুধু খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিতে নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের ৬০০ কোটি ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি কমাতেও ভূমিকা রাখবে। পাশাপাশি তৈরি পোশাক রপ্তানির ওপর আরোপিত শুল্ক হ্রাসে ওয়াশিংটনের অবস্থান পুনর্বিবেচনার পথ খোলা রাখতে বার্তা হিসেবেও কাজ করবে।
এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ও গবেষক ড. জাহিদ হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, পত্রিকায় দেখেছি যুক্তরাষ্ট্রের গম উন্নত মানের। তাই আমদানি মূল্য বাড়তি হচ্ছে বলে আমার মনে হয় না।
শুল্ক ও বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে আমদানি কতটা সহায়ক হবেÑএমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শুধু তো গম নয়, আরও কিছু পণ্য আছে। চুক্তিটা দেখলে হয়তো ভালোভাবে বলতে পারতাম। তিনি বলেন, আমদানিতে হয়তো কিছুটা সুবিধা পাওয়া যাবে। তবে আমদানির সঙ্গে সঙ্গে রপ্তানিও বাড়াতে হবে।
বাংলাদেশে বছরে যে পরিমাণ গমের চাহিদা তৈরি হয়, তার প্রায় ৮৫ শতাংশই আমদানি করতে হয়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, গত বছর সরকারি ও বেসরকারি খাতে বিশ্বের আটটি দেশ থেকে ১৬৩ কোটি ডলার ব্যয়ে ৫৯ লাখ টন গম আমদানি হয়েছে।
এর মধ্যে বৃহত্তম উৎস ছিল রাশিয়া ও ইউক্রেন। চলমান যুদ্ধ সত্ত্বেও গত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৪৬ শতাংশ গম এসেছে রাশিয়া থেকে, ১৮ শতাংশ এসেছে ইউক্রেন থেকে। অর্থাৎ মোট আমদানির ৬৪ শতাংশই এই দুটি দেশের ওপর নির্ভরশীল ছিল।
বাংলাদেশে আমদানি হওয়া গমের প্রায় ৭০ শতাংশই সাধারণ আমিষযুক্ত সস্তা গম, যা মূলত আসে রাশিয়া, ইউক্রেন, বুলগেরিয়া, রোমানিয়া ও ব্রাজিল থেকে। এ গমের দাম টনপ্রতি ২৬৪ থেকে ২৭৫ ডলারের মধ্যে। অন্যদিকে কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া থেকে আমদানি হওয়া উচ্চ আমিষযুক্ত গমের দাম পড়ে ৩০০ থেকে ৩১৩ ডলার।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানিকৃত গম মূলত উচ্চ আমিষযুক্ত এবং এটি সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় বিতরণ করা হবে। ফলে সুবিধাভোগী দরিদ্র জনগোষ্ঠী আগের তুলনায় উন্নত মানের গম পাবে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, এই আমদানি শুধু খাদ্য নিরাপত্তার প্রয়োজনেই নয়, বরং বৃহত্তর কূটনৈতিক ও বাণিজ্য কৌশলের অংশ। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের বৃহত্তম রপ্তানি বাজার। বিশেষ করে তৈরি পোশাকই যুক্তরাষ্ট্রে সর্বাধিক রপ্তানি হয়। সাম্প্রতিক শুল্ক বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর কাছে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে আমদানির মাধ্যমে বাণিজ্য ভারসাম্য রক্ষা এবং মার্কিন শুল্কনীতি পুনর্বিবেচনার জন্য দরজা খোলা রাখাকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছে সরকার।
শুধু গমই নয়, সরকারের পরিকল্পনায় রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সয়াবিন, তেলবীজ, ডাল, চিনি ও বার্লি আমদানি। এর বাইরেও রয়েছে বোয়িংয়ের উড়োজাহাজ, এলএনজি ও সামরিক সরঞ্জাম কেনার উদ্যোগ।
চলতি বাজেটে ইতোমধ্যে ৬২৬টি পণ্যে শুল্ক ছাড় ঘোষণা করেছে সরকার, যার মধ্যে ১১০টির আমদানি শুল্ক পুরোপুরি প্রত্যাহার করা হয়েছে। এর লক্ষ্যও একইÑযুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দীর্ঘদিনের বাণিজ্য ঘাটতি কমানো।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের জন্য খাদ্য আমদানির এই উদ্যোগ যেমন খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে, তেমনি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্কে নতুন মাত্রা যোগ করবে। নীতিনির্ধারকদের আশা, এই পদক্ষেপের ফলে শুধু বাণিজ্য ঘাটতি কমবেই না, বরং তৈরি পোশাকসহ বাংলাদেশের মূল রপ্তানি খাত যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে টিকে থাকার নতুন সুযোগও তৈরি করবে।