নিজস্ব প্রতিবেদক : চব্বিশের জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। একইসঙ্গে দোষ স্বীকার করে রাজসাক্ষী হয়ে সাক্ষ্য দেয়া সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। গতকাল সোমবার বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এই রায় ঘোষণা করেন। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারপতি মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
আনুষ্ঠানিক অভিযোগ-১ তথা উসকানি, মারণাস্ত্র, ড্রোন, হেলিকপ্টার ব্যবহারের নির্দেশসহ আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ডের দায়ে শেখ হাসিনাকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয়া হয়। একইসঙ্গে চানখারপুলে ছয় হত্যা ও আশুলিয়ায় ছয় লাশ পোড়ানোর দায়ে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ-২ এ শেখ হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল।
এছাড়া আনুষ্ঠানিক অভিযোগ-২ বা চানখারপুলে ছয় হত্যা ও আশুলিয়ায় ছয় লাশ পোড়ানোর দায়ে আসাদুজ্জামান খাঁন কামালকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। আর রাজসাক্ষী হয়ে জবানবন্দি দেয়ায় মামুনের পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। রায়ে বলা হয়, তিনিও (মামুন) একই অপরাধে অপরাধী। তবে স্বেচ্ছায় ও সত্য বলায় তার প্রতি নমনীয় হন ট্রাইব্যুনাল। এছাড়া শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের সব সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। এ মামলায় পলাতক রয়েছেন শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামাল। আর গ্রেপ্তার হয়ে প্রায় বছরখানেক ধরে কারাগারে রয়েছেন সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। তিনি ট্রাইব্যুনালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন। ফলে সাবেক এই আইজিপির শাস্তির বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের ওপর ছেড়ে দেন প্রসিকিউশন।
তিন আসামির বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচটি অভিযোগ আনে প্রসিকিউশন। এর মধ্যে রয়েছে উসকানি, মারণাস্ত্র ব্যবহার, আবু সাঈদ হত্যা, চানখাঁরপুলে হত্যা ও আশুলিয়ায় লাশ পোড়ানো। আনুষ্ঠানিক অভিযোগ মোট ৮ হাজার ৭৪৭ পৃষ্ঠার। এর মধ্যে তথ্যসূত্র ২ হাজার ১৮ পৃষ্ঠার, জব্দ তালিকা ও দালিলিক প্রমাণাদি চার হাজার পাঁচ পৃষ্ঠার ও শহিদদের তালিকার বিবরণ দুই হাজার ৭২৪ পৃষ্ঠার। সাক্ষী করা হয়েছে ৮৪ জনকে। গত ১২ মে চিফ প্রসিকিউটরের কাছে এ মামলার প্রতিবেদন জমা দেয় ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা।
গতকাল সকাল ৯টা ১০ মিনিটের দিকে কড়া নিরাপত্তায় কারাগার থেকে প্রিজনভ্যানে সাবেক আইজিপি মামুনকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করে পুলিশ।
গত ১৩ নভেম্বর এ মামলার রায় ঘোষণার জন্য গতকালের দিন ধার্য করা হয়। ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল এ দিন নির্ধারণ করেন।
এ মামলায় মোট ২৮ কার্যদিবসে ৫৪ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য-জেরা শেষ হয়। আর ৯ কার্যদিবস চলে প্রসিকিউশন-স্টেট ডিফেন্সের যুক্তিতর্ক পাল্টা যুক্তিখণ্ডন। ২৩ অক্টোবর রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামানের সমাপনী বক্তব্য এবং চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম ও রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেনের যুক্তিখণ্ডন শেষে রায়ের তারিখ নির্ধারণে সময় দেয়া হয়।
এদিকে শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের রায়ের প্রতিক্রিয়ায় আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেছেন, আমি মনে করি, আজ জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের আরেকটি বিজয়ের দিন। আজকের দিনে মনে পড়ছে যারা জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকালে প্রাণ হারিয়েছিলেন তাদের। গতকাল দুপুরে সচিবালয়ে এ প্রতিক্রিয়া জানান আইন উপদেষ্টা।
আইন উপদেষ্টা বলেন, আজকে বাংলাদেশের জন্য একটা ঐতিহাসিক দিন, আজকে বাংলাদেশের মাটিতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার শ্রেষ্ঠ ঘটনা ঘটেছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকালে শত শত মানুষের মৃত্যু, হাজার হাজার মানুষের গুরুতর আহত হওয়ার ঘটনা, অঙ্গহানির ঘটনা, বিকলাঙ্গ হওয়ার ঘটনার জন্য যে নৃশংস খুনি দায়ী ছিল, আজকে সেই শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের আদেশ হয়েছে। উপদেষ্টা বলেন, ব্যক্তিগতভাবে আমি এই রায়ে সন্তুষ্ট, কিন্তু আমি বিস্মিত না। কারণ শেখ হাসিনা এবং তার সহযোগীদের মানবতাবিরোধী অপরাধের যে জোরালো বিস্তৃত প্রমাণ রয়েছে, তাতে পৃথিবীর যে-কোনো আদালতে বিচার হলেই তার সর্বোচ্চ শাস্তি হওয়ার কথা।
আইন উপদেষ্টা এই বিচারের জন্য বিচার সংশ্লিষ্ট সবাইকে বিশেষ করে চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ও তার সহযোগীদের অভিনন্দন জানান।
অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান তার প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, এই রায়ে শহিদরা ন্যায়বিচার পেয়েছে, রাষ্ট্র ন্যায়বিচার পেয়েছে, প্রসিকিউশন ন্যায়বিচার পেয়েছে। শহিদদের প্রতি, দেশের প্রতি, এ দেশের মানুষের প্রতি, সংবিধানের প্রতি, আইনের শাসনের প্রতি এবং আগামী প্রজšে§র প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে এ রায় যুগান্তকারী। গতকাল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি এসব কথা বলেন।
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, শেখ হাসিনার মামলার রায়ে শহিদরা ন্যায়বিচার পেয়েছে, রাষ্ট্র ন্যায়বিচার পেয়েছে। প্রসিকিউশন পক্ষ ন্যায়বিচার পেয়েছে। সেই ন্যায়বিচারের মানদণ্ড হলো- এই মামলার দুজন আসামিকে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। একজন আসামি, যিনি রাজসাক্ষী হিসেবে নিজেকে আদালতের সামনে উপস্থাপন করেছেন, সার্বিক বিবেচনায় আদালত তাকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড প্রদান করেছেন।
অন্য দিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম রায়ের প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশ সাফল্যের সঙ্গে বিচার কাজ করেছে বলে উল্লেখ করেছেন। তাজুল ইসলাম বলেন, ‘বাংলাদেশ সব আন্তর্জাতিক নর্মস, আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড মেইনটেইন করে ক্রাইমস অ্যাগেইনস্ট হিউম্যানিটির মতো কমপ্লেক্স অপরাধের বিচার করতে সক্ষম এবং বাংলাদেশ সাফল্যের সঙ্গে সেটা করেছে।’
রায়ের বিষয়ে তিনি বলেন, যে ধরনের সাক্ষ্যপ্রমাণ এই আদালতে উপস্থাপিত হয়েছে, বিশ্বের যেকোনো আদালতের স্ট্যান্ডার্ডে এই সাক্ষ্য প্রমাণগুলো উতরে যাবে। তিনি বলেন, ‘পৃথিবীর যেকোনো আদালতে এই সাক্ষ্যপ্রমাণ উপস্থাপন করা হলে আজকে যেসব আসামিকে শাস্তি দেয়া হয়েছে তারা প্রত্যেকেই একই শাস্তি প্রাপ্ত হবে।’
চিফ প্রসিকিউটর বলেন, এই রায় প্রমাণ করেছে অপরাধী যত বড় হোক, যত ক্ষমতাশালী হোক, সে আইনের ঊর্ধ্বে নয়। এটাও প্রমাণিত হয়েছে, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক প্রথা, মান বজায় রেখে মানবতাবিরোধী অপরাধের মতো জটিল অপরাধের বিচার করতে সক্ষম।
এ রায়ের ফলে যে এক হাজার ৪০০ তরতাজা তরুণ প্রাণ দেশে স্বৈরশাসন অবসান করার জন্য জীবন দিয়েছেন, তাদের পরিবারে যদি সামান্য একটু স্বস্তি আসে, সেটাই প্রসিকিউশনের প্রাপ্তি বলে জানান চিফ প্রসিকিউটর। তিনি বলেন, ‘একটি বিচারিক প্রক্রিয়াকে সম্পন্ন করার মাধ্যমে এই জাতিকে বিচারহীনতার কলঙ্ক থেকে মুক্ত করার আমাদের যে ক্ষুদ্র প্রয়াস, সেটা যদি সফল হয় সেটাতেই আমাদের সাফল্য।’
প্রিন্ট করুন











Discussion about this post